'বন্ধুত্ব' সবসময় একটা সরে সরে যাওয়া নাম। সম্পর্কের একটা নাম থাকে। তার একটা স্থায়ী হওয়ার ইচ্ছা থাকে। কোথাও বা একটা দায়ও থাকে। কিন্তু বন্ধুত্ব একটা স্থবিরতার নাম না। একটা ঘটমান চলমান অস্তিত্ব। 'বন্ধু' একটা সম্পর্ক হতেই পারে। কিন্তু বন্ধু নামক সম্পর্কে যে বন্ধুত্বটা টিকেই আছে তা কে জোর দিয়ে বলতে পারে? হয়তো সেটা একটা অভ্যাস এখন। একটা পরিচিতি এখন। কারণ ওই যে বললাম, বন্ধুত্ব একটা গতির নাম। তবে বন্ধুত্বের যে শপথ বা চুক্তি হয় তা কিসের? তা একটা সম্পর্কের নাম, যদিও শব্দটা এক।
সব সম্পর্কের মধ্যেই এই বন্ধুত্বটা থাকতে পারে। আর যতক্ষণ তা থাকে ততক্ষণই তাকে একটা গতিশীল সম্পর্ক বলা যায়। সেখানে ভুল বোঝাবুঝি আছে, মনোমালিন্যতা আছে, অশান্তি আছে। আর এসব যতক্ষণ একটা স্বাভাবিক মাত্রা অবধি আছে, ততক্ষণ বোঝা যায় একটা চলমানতা আছে, সেখানে ভরকেন্দ্রটা খোঁজার প্রয়াস চলছে। এ দ্বন্দ্ব ভালো। এতে বিষ নেই, উত্তাপ আছে।
কিছু সম্পর্কে বন্ধুত্বটা নেই। বরং বিতৃষ্ণাটা কালো মেঘের মত বুকের তলায় জমছে। বিষ তৈরি হচ্ছে। এ হল বন্ধুত্বের ঠিক বিপরীত অবস্থান। এ সংঘর্ষ ভাঙনের। বেরোনোর পথ খোঁজার তাগিদে।
তবে বন্ধুত্বের প্রধান সূত্রটা গতিময়তা। দু'জনকেই সমান তালে এগোবার তৃষ্ণাটা জিইয়ে রাখতে হবে।বন্ধুত্বের ভালোবাসা সেটা পারে। সে এক পা এগোলে, যে পিছোলো তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এসো। সে যদি বলে দাঁড়াও, আমি প্রস্তুত নই এখনো। তবে বন্ধুত্ব বলে, আমি আছি অপেক্ষায়। সে নিজে এগোতে থাকলেও, পিছিয়ে আসা বন্ধুর এগিয়ে আসার পথটার দিকে চোখ রাখে, একটা হাত সবসময় তার দিকে এগিয়ে রাখে আন্তরিকতার সাথে।
আর যদি সে পিছিয়ে থাকা বন্ধু বলে, আমি আর যাব না, অথবা অন্যদিকে যাব? তবে সেই বন্ধুত্ব সাথে সাথে রূপান্তরিত হয় সম্পর্কে। তাতে যদি সহমর্মিতা থাকে, গ্রহনশীলতা থাকে, তবে তা স্বাস্থ্যকর। যদি বিতৃষ্ণা থাকে, ঈর্ষা থাকে, অভিমান থাকে, তবে তা দুর্ভাগ্যের। দুর্ভাগ্যজনকভাবে শেষেরটির উদাহরণই সংসারে বেশি।
বন্ধুত্ব এতই চঞ্চলা, এতই অমোঘ। তার শর্ত বড় কঠিন। সে একই সাথে অপরিহার্য, আবার নিষ্ঠুর। প্রেমের মধ্যে তাও একটা জৈবিক উপাদান থাকে (অবশ্যই আমি প্রচলিত অর্থে প্রেম বলেছি), কিন্তু বন্ধুত্বে সে সহজ আকর্ষণের পথও নেই।
দেখেছি, অত্যন্ত শিক্ষিত আর প্রথাগত বিদ্যায় একেবারে অশিক্ষিত মানুষের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের উদাহরণ। কাছে গিয়ে জেনেছি, তাদের মিলটা হয়েছে মনের গভীরে যে চিরকালীন চলাটা বাইরের সব ঐশ্বর্য্যকে তুচ্ছ করে স্বীয় পথে চলে, সেই চলার মিলে। সেখানে তথ্য লাগে না, তত্ত্ব লাগে না, একটা সংবেদনশীল মন লাগে।
চলতে চলতে সংবেদনশীলতাটা যোগায় শক্তি আর রুচিটা নির্দেশ করে দিক। আমি হয়তো ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের একজন বিদগ্ধ শ্রোতা, আমার বন্ধু হয়তো পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের। তাতে বন্ধুত্বের কোনো অসুবিধা হবে না, পরস্পরকে বুঝতে বোঝাতে কোনো অসুবিধা হবে না। অসুবিধা হবে কোনো কারণে সে এই সংবেদনশীলতার চর্চাটা যদি ছেড়ে দেয়। কারণ চর্চাটা সবক্ষেত্রেই প্রথম শর্ত।
বন্ধুত্ব বন্ধ আবহাওয়ায় হয় না। রুদ্ধদ্বারে হয় না। শর্তের শৃঙ্খলে সম্পর্ককে বাঁধা গেলেও যেতে পারে, বন্ধুত্বকে নয়। কারণ বন্ধু বলে কোনো সম্পর্কই হয় না। যে কোনো সম্পর্কের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকতে আসে, বসতে আসে, বাঁচতে আসে। তাকে জীবনের মত ধারণ করতে হয়, শ্বাস-প্রশ্বাসের মত চালিয়ে নিয়ে যেতে হয়, যত্ন করতে হয়।
যার প্রধান কথা হল - সাথে চলার অঙ্গীকার; কারোর কাছে না, নিজের কাছে।
দেবতা জেনে দূরে রই দাঁড়ায়ে,
আপন জেনে আদর করি নে।
পিতা ব’লে প্রণাম করি পায়ে,
বন্ধু ব’লে দু হাত ধরি নে।।
আপনি তুমি অতি সহজ প্রেমে
আমার হয়ে যেথায় এলে নেমে
সেথায় সুখে বুকের মধ্যে ধ’রে সঙ্গী বলে তোমায় বরি নে।।
ভাই তুমি যে ভাইয়ের মাঝে, প্রভু ,
তাদের পানে তাকাই না যে তবু–
ভাইয়ের সাথে ভাগ ক’রে মোর ধন তোমার মুঠো কেন ভরি নে।।
ছুটে এসে সবার সুখে দুখে
দাঁড়াই নে তো তোমারি সম্মুখে,
সঁপিঁয়ে প্রাণ ক্লান্তিবিহীন কাজে প্রাণসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ি নে।।