Skip to main content

মানুষের সঙ্কীর্ণতার বিশ্বে কোথাও কোনোদিন পাকাপাকি জায়গা হয় না, এটা মানুষ বুঝতে কতদিন সময় নেয় কে জানে। এটা বুঝে গেলেই যে কত ঝক্কি, কত চালাকি আপনি খসে পড়ে, সে যদি আগে জানতে পারে তবে সংসারে রাতদিন সে নিজের পায়ে নিজে এভাবে কুড়ুল মেরে চলতে পারে না।

    এটা খুব কমোন গল্প। আমি যে কষ্টটা পেয়েছি, আমি যেমন অনেক অসুবিধার মধ্যে বড় হয়েছি, ও-র যেন না হয়। তাই ও যা চাইছে সেটাই মুখ থেকে উচ্চারণের আগেই বাড়িতে চলে এলো। 

    এ খুব কমোন ঘটনা। বাবা খুব কষ্ট করে বড় হয়েছেন, তিনি চান না ছেলে সে অভাব, কষ্টের ভিতর দিয়ে যায়। ছেলে নেশা করুক, ছেলে বাজে সঙ্গে মিশুক, ছেলে অল্পস্বল্প অসামাজিক কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলুক --- বাবা অন্ধ। বাবা সেটা দেখেও দেখবেন না। দেখলেও তার নানারকম ব্যাখ্যা থাকবে... 

    ও বয়েস হলে, বুঝতে শিখলেই ঠিক হয়ে যাবে... ভগবান ওকে ঠিক রাস্তায় একদিন না একদিন নিয়ে আসবে…. ওর দোষ না, ও তো ওরকমই তবে ওকে ওসব দায়িত্ব দেওয়া কেন, দায়িত্ব দিয়েছেন যিনি তারই তো দোষ….

    ছেলে বড় হল। লুচ্চা হল। বিয়ে হল। ডিভোর্স হল। বউয়ের দোষ। শ্বশুরবাড়ির দোষ। সঙ্গের দোষ। গ্রহের দোষ। মানসিক সমস্যা আছে ওর…

    এ সব খুব খুব চেনাজানা ঘটনা। পাড়ায় পাড়ায়। ছেলে নেশার টাকা না পেয়ে বাবা-মাকে মারধর করেছে। চুরি করেছে। খুন করেছে। এও নিত্য ঘটনা। 

    কথাটা শাহরুখ খানের ছেলে বলে না। সে তো মিডিয়া ঘটনাটা ধুয়ে ব্যবসা করছে। একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখুন, এ আমাদের আশেপাশে নিত্য ঘটনা কিনা?

    আসলেই এ নিত্য ঘটনা। নানা কাজের চাপ। সংসারে হাজার একটা ঝামেলা। মনমেজাজ ভালো থাকে না। মোবাইল হোক যা হোক ধরিয়ে দিয়ে ছেলেমেয়েদের সরিয়ে দাও। টাকাটা বড় কথা না। চাপ নেওয়া যায় না অত। আর সারাদিন কত ওদের পিছনে ঘুরঘুর করে লেগে থাকা যায়? আমাদেরও তো একটা জীবন আছে নাকি? আমরা কি যা চাই জীবনে সব পেয়েছি? অন্তত কিছুটা পূরণ করে তো নিতেই হবে। ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়েছি বলেই কি ওদের দাসীবাঁদী হয়ে জীবন কাটাব নাকি?

    এও আছে। এও হয়। এও সত্য। 

    আজকাল বলে নয়, শরৎচন্দ্রের গল্প থেকে শুরু করে উড়তা পাঞ্জাব, নেশা করা বকে যাওয়া ছেলের গল্পের কি অভাব আছে?

    কিন্তু যেটা নেই সেটা হল, এগুলো কি আটকানো যায়? অবশ্যই যায় না। ছেলেমেয়ে বকে যাবে, এক অংশ এই হট্টগোলের বাজারে হারিয়ে যাবে - এ বাস্তব। তবে যেটা করা যেতে পারে, কিছুটা হলেও ভাবা যেতে পারে, সেটা হল প্রশ্রয় দেওয়া। 

    প্রশ্রয় দেওয়া মানে ঠিক কি? একটাই বুঝি, তার অন্যায়কে মেনে নেওয়া। কোনো অন্যায়কে একবার যদি মেনে নিই তার মধ্যে অন্যায় করার উপর ভীতি চলে যাবে। এর থেকেও যেটা বড় কথা, অন্যায় করার উপর প্রীতি জন্মাবে। 

    আমি এমন একজন মানুষকে ভালোবাসি যে মানুষটা অন্যায় সহ্য করে না, অগত্যা আমি অন্যায় করব না। এটা হল স্বাভাবিক মনের কথা। শাসনের ভয়ে অন্যায় না করা আর ভালোবাসার মানুষটার ভালোবাসা হারানোর ভয়ে অন্যায় না করার মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য আছে। 

    যে বাচ্চাটা শাসনের ভয়ে অন্যায় করছে না, সে যে কোনো মুহূর্তে অন্যায়ের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে, যদি সুযোগ পায় তো। এ যেন টিটির ভয়ে টিকিট কেটে ওঠার মত। মানে আমার নিজের ব্যক্তিত্বের উপর এমন মর্যাদাবোধ জন্মায়নি যে আমি টিকিট না কেটে উঠলে আমার কিন্তু কিন্তু লাগে, সে আমি উঠতেই পারি, কিন্তু লোকের সামনে হেনস্থা হতে আমার লজ্জা লাগে। কারণ আমার আত্মসম্মানবোধ না থাকুক, চক্ষুলজ্জাবোধ তো আছেই। বলা বাহুল্য, সমাজের একটা বড় অংশ এই চক্ষুলজ্জার দোহাইতেই অন্যায়, অপরাধ থেকে বিরত থাকে। 

    কিন্তু এর থেকে বড় আরেকটা দিক হল, আমি যাকে ভালোবাসি সে এমন মূল্যবান আমার জীবনে যে সে অন্যায়কে ভালোবাসে না বলে আমার মনও অন্যায়ের দিকে যায় না। এ অনেক গভীরে রেখাপাত করে মনের মধ্যে। আমার বাবা বা মা আমি অন্যায় করলে কষ্ট পাবেন। তারা কষ্ট পেলে আমি কষ্ট পাব। তাই আমি ওসব করব না। এই বোধটা মনের গভীরে ধীরে ধীরে একটা আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি করে। অবশ্যই করে। আগে খুব বলা হত আজকাল বড় মানুষের জন্ম হয় না, কারণ সে মা নেই বলে। কথাটা কিঞ্চিৎ অতিকথন হলেও কথাটা সর্বাংশে যে মিথ্যা তা নয়। 

    বাবা, মা বা অভিভাবকের ভালোবাসা আর আদিখ্যেতার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। ভালোবাসা সহনশীল, প্রয়োজনে কঠোর, আবার নিজেকে ভুল বলে জানলে ক্ষমা চাইতেও দ্বিধা করে না। কারণ তার মধ্যে সত্যবস্তু আছে। 
    
    আদিখ্যেতার সে দায় নেই। সে সন্তানের কাছে বা ভালোবাসার পাত্রটির কাছে প্রিয়মুখ থেকে যেতে চায়। তার ভালোবাসায় এই যে ভিক্ষাবৃত্তি সে-ই তাকে নীচু করে ফেলে। সব অন্যায়কে মেনে নিতে দ্বিধা করে না আর, কারণ সে জানে অন্যায়কে যে ভালোবাসে, তার ভালোবাসায় হ্যাঁ-তে হ্যাঁ না মেলালে সে যদি বিরূপ হয়ে যায়। এই বিরূপতাকে সে মেনে নিতে পারে না। তাই ক্রমে দু'জনেই নীচের দিকে নামে। অন্ধকারে সেঁধোয়। দায় পড়ে সঙ্গের, ভাগ্যের, আত্মীয়ের, সব শেষে ভগবানের। 

    ভালোবাসার মধ্যে যাদুশক্তি আছে। আদিখ্যেতার মধ্যে আছে মোহ। অভিভাবকের এই ভালোবাসায় বেড়ে ওঠা বাচ্চাদের মানসিক গঠন অন্যরকম হয়। কিন্তু ভালোবাসাটা যেন সত্য অর্থেই ভালোবাসা হয়। সে হওয়াটা সত্যিই শক্ত। এত এত দুর্বলতা বাসা বেঁধে মনের কোণায় ওঁৎ পেতে থাকে যে, তাদের এড়িয়ে ভালোবাসাটা বড় কঠিন কাজ। তবে তারও একটা সূত্র আছে। যাকে ভালোবাসি সে যদি আমার কেবল ভোগ্য না হয়ে মানের সম্পদও হয়, তবে তার অধঃপতন দেখা আমার পক্ষে সোজা নয়। সে বাচ্চা হলেও তার মানের দিকটা যদি খেয়াল রাখি, তবে সে মানের দিকে তাকিয়েই আমার ভালোবাসা শুদ্ধ হয়। আমি বারবার তাকে তার মান সম্বন্ধে সচেতন করে তুলি আমার অজান্তেই। সেও সচেতন হয়ে ওঠে। যা তার ভবিষ্যতের সম্পদ - সুস্থ আত্মসম্মানবোধ। 

    একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করি। বেশ কয়েক বছর আগে আমার কাছে পড়ত ভীষণ দুরন্ত একটা ছেলে। ক্লাস টেনে পড়ে। তার নানা দুষ্কর্ম্মের কথা তার বন্ধুরা আমার কাছে বলে বলে রেখেছে। তার অনেকটা অতিরঞ্জিত হলেও বুঝেছিলাম সবটা নয়। সে অনেক অভাবের মধ্যে বড় হচ্ছে এটা সত্যি, কিন্তু সব চাইতে বড় অভাব যেটা বুঝেছিলাম ভালোবাসার অভাব। তার স্বভাবে একটা রুক্ষতা তার বাইরের শুষ্কতার সঙ্গে মিলেমিশে ছিল। 

    একদিন সে ব্যাচে এলো একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে। রক্তারক্তি পা। পড়া থামালাম। নানা সরঞ্জাম নিয়ে বসলাম ড্রেসিং করতে। সে কিছুতেই তার পায়ে হাত দিতে দেবে না, আমি দেবোই। অগত্যা সে আমার বকা খেয়ে চুপ করে বসল। আমি ড্রেসিং করে, একটা বন্ধুকে দিয়ে টিটেনাস দেওয়া করিয়ে ব্যাচে আবার আসতে বললাম। 

    এরপর কিছু একটা চেঞ্জ হল। সে এতদিন দূরে বসত। এবার কাছে আমার চেয়ারের কাছে বসতে শুরু করল। আগে আগে আসতে শুরু করল। বদলাতে লাগল। 

    অনেক পরে, সে এখন অনেক বড়, বাঁদরামি ছাড়েনি, কিন্তু দুষ্টুমিগুলো ছেড়ে দিয়েছে। তার নিজেরও পিতা হওয়ার দিন এলো বলে। একদিন সে আমায় বলেছিল, "আমি কিছু ভুল করতে গেলেই মনে হত তুমি জানতে পারলে কষ্ট পাবে, তাই করিনি। তুমি একটুও ভেবো না আমি ভালো হয়ে গেছি।"

    এই দর্শনে আমি খুব বিশ্বাস করি। আমার জীবনেও এমন কেউ ছিলেন বা আছেন, যিনি অজান্তেই আমায় রক্ষা করে এসেছেন, হয় তো আজও করে চলেছেন। কারণ একটাই, তিনি কষ্ট পাবেন। রবীন্দ্রনাথের একটা লেখায় আছে, "তবু বলি ও পথ তোমার না হোক।" এই কথাটার সুরে শাসন নেই, একজন প্রাণের ভালোবাসার মানুষের আবদার আছে। মানুষের সংশোধন হয় ভালোবাসায়। যে ভালোবাসা অপেক্ষা করে, উপেক্ষা করে না আমার আত্মমর্যাদাবোধকে, আমাকে ভোগ্য করে। আমায় সময় দেয়। আমায় আত্মমর্যাদাবোধ শেখায় নিজেকে মিশিয়ে। একাকার হয়ে।

    এর বাইরে কোনো চালাকি, কোনো শর্টকাট, কোনো ঘুরপথে বড় রাস্তার খোঁজ মেলে না। ভালোবাসাকে ভালোবেসে আত্মনিয়ন্ত্রণ আর ভয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের মধ্যে পার্থক্য অনেক।