Skip to main content

 

ইচ্ছে ! –ইচ্ছে !

সেই তো ভাঙছে, সেই তো গড়ছে,

সেই তো দিচ্ছে নিচ্ছে।।

সেই তো আঘাত করছে তলায়, সেই তো বাঁধন ছিঁড়ে পালায়

বাঁধন পরতে সেই তো আবার ফিরছে।।

~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

মানুষ বলে কিছু হয় না। সব মন। মনই দেখে, শোনে, বলে, ভাবায়, ভাবে, রাগায়, রাগে, নাচায়, নাচে। সবই মন।

যদি বলো মন মানে কি? মন মানে ইচ্ছা, মন মানে চিন্তা, মন মানে অনুভব, মন মানে বোঝার আঁকিবুঁকি। মূলে হল গিয়ে ইচ্ছা। আমার ইচ্ছা যেমন আমি ভাবি তেমন, ভাবাই তেমন, দেখি তেমন, দেখাই তেমন। ইচ্ছা যদি মূলে না থাকত তবে জগৎজোড়া সত্যিই কলের কারখানা হত। ইচ্ছা আছে বলেই না এত বৈচিত্র্য। এক এক মানুষ। এক এক মন। এক এক মন, এক এক ইচ্ছা।

ইচ্ছা আবার দু'রকম। 'দেখানো ইচ্ছা' আর 'আসল ইচ্ছা' আরশোলার ডানার মত। বাইরের বাদামীটা দেখানো ডানা। ভিতরের সাদাটা আসল ডানা, যা দিয়ে ওড়ে। সেরকম ইচ্ছা হল গিয়ে দু'ধরণের। লোককে দেখাই আমার এই এত এত ভালো ইচ্ছা। মনের ভিতর তাকালেই দেখো, হাজার হাজার আরশোলার মত ফড়ফড়ানো অন্য ইচ্ছা।

ইচ্ছার মালিক কে? আমি তো ইচ্ছা করলে অনেক কিছু করতে পারি রে, আবার পারিও না। কিন্তু ইচ্ছাটারে ইচ্ছা করি কি করে? তো একটা সমস্যা! মন কি শুধু ভালো ইচ্ছার কারখানা নাকি? তবে আর এত খুনী-ডাকাত হয় কেমনে? ইচ্ছা কখন লোভ হয়, ইচ্ছা কখন ঈর্ষার কথা শুনে খুনী হয়, ইচ্ছা কখন বদলা নেওয়ার জন্য উগ্রপন্থী হয় - সেকি আমার হাতে নাকি রে দাদা! কতজনরে আজ অবধি যে আমরা মনে মনে অ্যাদ্দিন খুন করে ফেলেছি রে দাদা, সে যদি এই বাস্তব জগতে হত তবে জজসাহেব আমায় ফাঁসি দিয়ে দিয়ে থকে যেত না রে! খুব যেত!

তবে এই ইচ্ছাগুলোরে থামাই কি করে রে বাপ! সে তো আকাশের চাঁদ চায় থেকে থেকে। চড়-থাপ্পড় মাইরাও তো ফল পাই না নে। 'দিন ঠিক থাকে তারপর আবার ফড়ফড়ায়। আমায় ডাকে। কি মোহিনী সে ডাক দাদা গো! জ্যোৎস্নারাতে নীল শাড়ি পরে কোনো এক পরী যেন আমার উঠানে সুগন্ধি মেখে আমার অপেক্ষায়। হায় রে হায়, এই তো ইচ্ছার রকম দাদা। এদের পাঠায় কে? নিষিদ্ধ ইচ্ছা, অতিইচ্ছা, অবাস্তব ইচ্ছা - এসবের জন্ম কে দেয় দাদা? ইচ্ছা কি স্বাধীন? আপনি আপনিই জন্মে যায়? এরকম একটা জিনিস আল্লাহ্, ঈশ্বর, গডে কি করে সৃষ্টি করে দাদা! তাঁর সৃষ্টিতে এরকম একটা উটকো অশান্তি ডেকে আনা কি উচিৎ কাম হয় তাঁর? আর যদি আপনি নাস্তিক হন, মানে আপনি যদি বিবর্তনের তত্ত্বে বিশ্বাসী হন, তবে আমারে বলুন দেখি এইরকম একটা উটকো মাল প্রকৃতি অ্যাদ্দিন ধরে সহ্য করে কি মতলবে? বলি আমাদের লেজ, অ্যাপেণ্ডিক্স, কানের পেশী ইত্যাদি ইত্যাদি কিসেরে না প্রায় হাপিশ করে দিল, আর এই উটকো ইচ্ছাগুলানরে ফেলাইতে পারল না! মানুষ ভাবলেই যেন ভালো ইচ্ছা জম্মায়, এমন কেন হল না বলতি পারেন?

কেউ পারে না। শাস্তি দেওয়ার লগে কোর্টে, আসমানে, পরজন্মে সব ব্যবস্থা দেওয়া আছে। কিন্তু উটকো ইচ্ছা কোত্থেকে জন্মায় কেউ বলবারে পারে না। কি আশ্চর্য!

আমি ফ্লাইওভারে চড়ে জগতের দিকে তাকাই আর হাঁ হয়ে যাই। এক এক মানুষ, এক এক ইচ্ছার কল। কে যে দম দিয়ে ছাড়ি দেলো রে দাদা আমার, মানুষ শুধু ঘুরেই মরে, ঘুরেই মরে... লোকে বলে, আমার ইচ্ছা তাই এমন করলাম, বললাম, ভাবলাম। যেন ইচ্ছাটা সে- জন্ম দিয়েছে। যেন সে চাইলেই ইচ্ছাগুলো হুস্ হুস্ করে জন্ম দিতে পারে! এমনই মোহে থাকি গো আমরা দাদারা।

আচ্ছা বাইরের ইচ্ছাগুলো কি কি? এই যেমন সেখানে আসলে বাঁধ দেওয়া আছে। হাজার একটা নিয়মের গুঁতোয় আমার ইচ্ছাগুলোর পায়ে শিকল দেওয়া আছে। লোকে বলে, ইচ্ছানুযায়ী চললেই যেন সবাই স্বাধীন। বোকা, তবে আর সভ্য জগতে থাকা কেন বাপু! জঙ্গলে গেলেই হয়। সভ্য জগতে এসে পড়েছি বলেই না আমার ইচ্ছাদের শাসন করার একটা ফিকির বার করা গেছে। শাস্তি মানে কি? ইচ্ছার ডানা ছাঁটা। সমাজ আমাদের বলে বলে দেয়, এই ইচ্ছাগুলো ভালো, মানে সামাজিক। এগুলো বাজে, মানে অসামাজিক। আবার দেখো, সমাজ বদলায়, ইচ্ছাদের ছাড়পত্রও বদলায়। এই যেমন আগেকার দিন বলে সমাজে কত কত বিধিনিষেধ, অমুক তমুককে বিয়ে করতে পারবে না, অমুকের তমুক হলে আর বিয়ে হবে না, অমুক তমুককে ভালোবাসতে পারবে না। এরকম হাজার একটা নিয়ম ছিল। যে যে ইচ্ছা আটকাতে পারবে, সে যেন তত ভালো সমাজ বানাতে পারবে, এমন একটা মারাত্মক গোঁড়ামি ঢুকেছিল আমাদের মধ্যে। তারপর ধীরে ধীরে আমরা বুঝলাম, আসলে সব ইচ্ছাতেই অত ক্ষতি নেই, তখন অল্প অল্প করে ছাড় দিয়ে দিয়ে দেখতে শুরু করলাম। কেউ কেউ ভয়ানক ভয় দেখালো, বলল সব্বোনাশ হবে! দিদি, দাদা, একি করলেন! কিন্তু আদতে দেখা গেল সব্বোনাশ হল না। এই করে করে অল্প অল্প মানুষ তার ইচ্ছা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছে আর গণ্ডী বড় করছে। তবে আমাদের আবার আরেক বায়নাক্কা আছে। আমাদের সাধ আছে আমরা আমাদের খুব স্পর্শকাতর করে রাখব। সে- হয় না, কিছু বাচ্চা থাকে অ্যাটেনশান চায়, কেঁদেকঁকিয়ে যে করেই হোক। তাই আমাদের সবার মাঝেমধ্যে ইচ্ছা হয় আমরা অপমানিত হব, আমরা ঠোঁট ফুলিয়ে এর ওর দিকে আঙুল তুলে বলব, "ওর ওই বিজ্ঞাপন আমার ভাবাবেগে আঘাত করেছে। আমার মনে ভীষণ দাগা দিয়েছে।" সব্বাই তখন আমার দিকে তাকাবে, আর ভাববে, বাব্বা! কি দামী একটা মন নিয়ে জম্মেছে গো, একটু বেশি নাড়াচাড়া পড়লেই কি আওয়াজ!

বোকাগুলো বোঝে না, যত বেশি প্রাণশক্তি যার তত বেশি সব কিছুকে আত্মস্থ করার ক্ষমতা তার। ভারতের সংস্কৃতি মানেই তো ইনক্লুসিভ। সে আবার কবে, "আমায় ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছি, আমি বেদব্যাসের ঝি", বলে পাড়া কাঁপালো?

আমার একটা গপ্পো মনে পড়ছে। একবার হল কি রামকৃষ্ণ ঠাকুরের ইচ্ছা হল গীর্জায় কেমন করে আরাধনা করা হয় তিনি দেখবেন। কিন্তু গোঁড়া মানুষের ভয় তো আছেই। তো তিনি জগদম্বাকে বলছেন, মা, আমি না হয় বাইরে থেকেই দেখব, ভিতরে গেলে যদি কালীঘরে আবার ঢুকতে না দেয়!

নাও, বোঝো! ওনার মত মানুষেরও ওই গোঁড়াগুলোকে কি ভয়! তা কি হয়নি? হয়েছিল তো, স্বামীজিকে কালী মন্দিরে ঢুকতে দিচ্ছিল না তিনি বাইরে ম্লেচ্ছদের সঙ্গে মিশেছেন বলে! এও আছে। এদের ইচ্ছা হল নিজেদের চারদিকে পরিখা কেটে নিজেদের বেশ জানান দেয়। সব দেশে, সব ধর্মেই আছে। কোথাও বেশি, কোথাও কম।

দেখো দেখি, ইচ্ছার গল্প করতে করতে কোথায় এসে পড়লাম। তাহলে আমাদের কতরকম ইচ্ছা দাঁড়ালো? প্রথমত দুটো, 'লোক দেখানো' আর 'আসল' তারপর এলো, 'সু' আর 'কু' কিন্তু আসল কথাটার কোনো হদিস পাওয়া গেল কি? মানে এসব ইচ্ছারা জন্মায় কোত্থেকে? দাদা শোপেনহাওয়ার জ্যেঠু এত্ত বড় একটা বই লিখে ফেললেন গো, কিন্তু তাও কি কিছু ঠাহর করতে পারলেন? কিস্যু না! "ইচ্ছাময়ী তারা তুমি" বলে তো না হয় সাধক পার পেল? তেনারই বা এত গণ্ডগোলের ইচ্ছা কেন বুঝি না বাপু! কিন্তু আমাদের ইচ্ছার সূত্রটি কি তবে?

যদি বিজ্ঞানের কথা বলা যায়, তবে সে অনেক জটিল ধাঁধা। ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলেম আর পেলেম না। তাহলে তো বেশ হত না! সব খারাপ ইচ্ছাগুলো ট্রান্সপ্লান্ট করে ভালো ইচ্ছা ভরে দেওয়া যেত! সেই মগজ ধোলাইয়ের মত? খানিকটা তাই, তবে ভালোর জন্য। কার মতে কি ভালো বেরোবে, সে এক জ্বালা হবে। উঁহু সে হবে না, সেও ভালো কথা নয়। তবে আসল ভালোটা কি? রবি ঠাকুর সে আসল ভালো কথাটা বলে থুয়েছেন, "সকল দ্বন্দ্ব-বিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো, সেই তো তোমার ভালো।"

এতএব মানে গিয়ে দাঁড়ালো, কুরুক্ষেত্র ছাড়ার জো নেই। তবে কোন ইচ্ছার সারথি কে, সেটা একবার দেখে নিলেই হল।