দর্শন আর ধর্মের উদ্দেশ্যের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। দর্শন জ্ঞান ও সত্যের খোঁজ। ধর্ম শান্তির অন্বেষণ। সত্য, জ্ঞান আর শান্তির একত্র অবস্থানও যে হয়নি তা নয়। পাশ্চাত্যে স্টোয়িক দর্শন মনে হয় এর একমাত্র উদাহরণ। স্টোয়িক দর্শনের সূত্র সক্রেটিসের ভাবনা, দর্শন ও জীবনবোধের দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও, এর সম্পূর্ণ রূপ তৈরি হয় জেনোর মাধ্যমে। তারপর এপিকটেটাস, অরেলিয়াস ও সেনেকার মাধ্যমে মহীরূহ আকার ধারণ করে। স্টোয়িক দর্শনের মূল কথাটা হল আত্মনিয়ন্ত্রণ। অনেকটা গীতার স্থিতপ্রজ্ঞের মত, যে সুখে-দুখে-সম্পদে-বিপদে স্থিরচিত্ত হবে, নির্বিকার হবে। সেনেকার চিঠিপত্র, অরেলিয়াসের মেডিটেশান, এপিকটেটাসের নানা লেখার সংকলন – বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এদের মধ্যে এপিকটেটাস কোনো এক ধনীর দাস ছিলেন। তার আত্মতন্ময়তা এমন হয়ে পড়ত মাঝে মাঝে যে তার কাজের ক্ষেত্রে তা বিঘ্ন ঘটাত। তার মালিক তাকে শারীরিক নিগ্রহ এমন পর্যায়ে করত যে তিনি নাকি প্রায় পঙ্গুই হয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে মালিক হাল ছেড়ে এপিকটেটাসকে মুক্তি দেন, তিনি একটা স্কুল খোলেন, দর্শন শিক্ষা দেওয়ার জন্য। অরেলিয়াস ছিলেন সম্রাট। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের মনকে শান্ত রাখার জন্য নিজের জীবনবোধের যে গভীরে অবগাহন করেছিলেন, সেই জীবনবোধের সাক্ষ্য বহন করছে তার অসামান্য গ্রন্থ, ‘মেডিটেশান’। নোবেলজয়ী সাহিত্যিক নাইপালের বিখ্যাত বই, ‘দ্য হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস’ এ বারবার উল্লিখিত হয়েছে এই বইটার নাম। সেনেকা ছিলেন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী, গভীরভাবে স্টোয়িক দর্শনে বিশ্বাসী। এমনকি তার মৃত্যুও হয় রাজরোষে। শিরাগুলো কেটে জলপূর্ণ বাথটবে শুয়ে প্রাণত্যাগের হুকুম হয়। তিনি সেইভাবেই মারা যান, শান্তভাবেই।
এই হল মোটামুটি স্টোয়িক দর্শনের কথা পাশ্চাত্যে। এরপরের বাকি সব পাশ্চাত্য দর্শন মূলত বুদ্ধিগত, জীবনে কোনো অনুশীলনের দাবি রাখে না। কিন্তু প্রাচ্যে ভাবনাটা অন্যরকম। “শান্তম শিবম অদ্বৈতম” কথাটার মধ্যেই যেন মূলসুরটা। প্রথমে শান্ত হও, তারপর মঙ্গলে নিজেকে নিয়োজিত করো ও ভেদহীন মানসলোকে এ বিশ্বসংসারকে অবলোকন করো একের মধ্যে। এ হল দর্শন ও শান্তির একত্রে অন্বেষণ। ভারতীয় ষড়দর্শনের কথা যদি সরিয়েও রাখি আপাতত, তবু প্রাচ্যের যে তাও-দর্শন ও জেন-দর্শনের কথা আছে, সেখানেও মূল উপপাদ্য হল শান্তি। তাও আর জেন গভীর জীবন দর্শন, বহু প্রাচীন। জেন যদিও বৌদ্ধদর্শনেরই একটা শাখা। আমাদের এখানে যেমন দক্ষিণ ভারতের কবি-দার্শনিক থিরুভাল্লাভুরের লেখা ‘থিরুকুরাল’, খুব অল্প আলোচিত হয় উত্তরভারতে, বা বাংলায় তো প্রায় অনুচ্চারিতই থেকে যায়। যদিও থিরুকুরাল তাও-দর্শনের এর মত অতটা প্রাচীন নয়, কিন্তু এর গভীর চিন্তা অবশ্যই বিশ্ব সাহিত্যে এক মূল্যবান সম্পদ।
ভারতীয় অন্যান্য দর্শনের মধ্যে প্রধান যে উপনিষদ, সেখানেও প্রতিটা উপনিষদের শুরুতে শান্তিপাঠ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, আমাদের মূল লক্ষ্য সেই জ্ঞান, যা আমাদের শান্ত করে। জ্ঞানের পরমগতি চিত্তের শান্তি। বুদ্ধের মতে যার চূড়ান্ত নির্বাণ, গীতার মতেও তাই, দৃঢ়-প্রতিষ্ঠ শান্তি। ইসলাম অর্থেও শান্তি। শিখধর্মের কথাতেও তাই।
অর্থাৎ শান্তি প্রতিষ্ঠা হল ধর্মের মূল উদ্দেশ্য। নিজের মধ্যে, নিজের বাইরে। বাইবেল বলছে, তুমি যদি শান্তিস্থাপক হও, তবেই তুমি ঈশ্বরের সন্তান। এই হল মূল কথা। যে ধর্মের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয় না, বুঝতে হবে আদতে তা ধর্ম নয়। তা হয় কোনো কাল্ট, বা মত, বা কোনো গোষ্ঠীর প্রথাগত বিশ্বাস মাত্র। যা শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাই ধর্ম। কথাটাকে ঘুরিয়ে বললে তাই দাঁড়ায়, এবং আমাদের বোধের পক্ষেও সহজ হয়। বুদ্ধ বলছেন যদি একটা গাথা পড়ে তোমার হৃদয় শান্ত হয়ে যায় তবে জানবে সেই গাথাই তোমার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ। রামকৃষ্ণ বলছেন, যত গঙ্গার দিকে যাবে তত দেহ শীতল হবে। কোরান বলছেন, সমস্ত মনুষ্যজাতি এক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ, নিজেদের মধ্যে শান্তিকে প্রতিষ্ঠিত রাখো। খুশবন্ত সিং নাস্তিক বিদগ্ধ পণ্ডিত মানুষ, একটা বই সংকলন করেছিলেন, ‘দ্য ফ্রি থিংকারস প্রেয়ার বুক’, দুর্দান্ত পুস্তিকা একটা, বিশ্বের নানা মূল্যবান ধর্মগ্রন্থগুলো থেকে বিশেষ করে শান্তি-মৈত্রীর বার্তাবহ উদ্ধৃতিমালা।
আজ আমাদের নতুন দর্শনের কতটা প্রয়োজন জানি না। কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠা একান্তভাবে কাম্য। ধর্ম মানে শান্তি। ধর্ম মানে কোনো বিশ্বাসের গোলামি নয়, নিজের বিবেকবুদ্ধি কারোর পায়ে জলাঞ্জলি দেওয়া নয়, কোনো প্রথা প্রাচীন বলে, বহুমানুষ দ্বারা পালিত বলেই তার অন্ধ অনুকরণ নয়, কোনো ঈশ্বরে বাধ্যতামূলক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের গল্প নয়। মহাত্মা বারবার বলতেন, শান্তি শুধু লক্ষ্য নয়, শান্তি পথও।
কেউ যেন আমাদের কোনো লোভে, মোহতে ধর্মের নাম নিয়ে না ভোলায়। পৃথিবী ধর্মশূন্য হবে না। না হোক, সে মঙ্গলজনকও হবে না। কারণ তবে বহু উচ্চ-উদার হৃদয় নরনারী ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাবে, বহু উচ্চমানের চিন্তা-ভাবনাও হারিয়ে যাবে। ধর্ম বলতে যেন আমরা শুধুই শান্তিকেই বুঝি। যা করলে, যা বললে, যা শুনলে, যা ভাবলে, আমার শান্তি, আমার পারিপার্শ্বিকের শান্তি, তাই ধর্ম। যা কিছু শান্তি পরিপন্থী তা কিছুতেই ধর্ম হতে পারে না। কবীর বলতেন, এমন কথা বলো যাতে তোমার নিজের মন তো শান্ত হয়ই, অন্যের শ্রবণও শান্ত হয়। সারদাদেবী বলতেন, যদি শান্তি চাও তবে অন্যের দোষ দেখা বন্ধ করো, জগতকে আপন করো।
প্রাণের প্রদীপে বোধের শিখা। প্রদীপের শিখাকে নিভিয়ে যে অন্ধকার সৃষ্টি হয়, সে শান্তি নয়, সে নির্জীব জড়ত্ব। শিখার চঞ্চলতাকে নানা রিপুর আঘাত থেকে রক্ষা করে, স্থির রাখার প্রয়াসই হল শান্তি।
শান্তিই পথ, শান্তিই লক্ষ্য, শান্তিই ভালোবাসা, শান্তিই ভ্রাতৃত্ব, শান্তিই মোক্ষ, শান্তিই ভক্তি, শান্তিই জ্ঞান, শান্তিই রাষ্ট্র, শান্তিই নীতি, শান্তিই সমস্ত জীবনের অমৃত।