সৌরভ ভট্টাচার্য
3 August 2014
তাকালেই কি দেখা যায়? না বোধহয়।
তাই যদি হত তা হলে হয়তো বা দেখতাম একটা হনুমান কলার কাঁদি পাশে রেখে ফুলের শোভায় বিমোহিত হয়ে মালা গাঁথতে বসেছে, আর গুনগুন করে গাইছে, "পরাবো বলিয়া তোমার গলায় সাধের মালাটি গেঁথেছি।"
কিম্বা হয়তো দেখতাম গরুগুলো জাবর কাটা ছেড়ে শরতের নীলাকাশে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে, কারোর বা আবার আঁখি ছলছল, "চাহি তোমার পানে।"
না, এরকম কোন ঘটনা ঘটেনা। কারণ তাকালেই আমরা দেখি না। দেখার কতগুলো ধাপ ভাবা যেতে পারে।
১) চর্ম চক্ষুঃ
এ নিয়ে জীব বিজ্ঞানীদের ভান্ডারে প্রভূত তথ্য। কি ভাবে চোখের উৎপত্তি, আর ক্রমবিকাশ। আমাদের চোখ অবশ্যই তার উৎকৃষ্ট নমুনার মধ্যেই পড়ে।
এই চর্মচক্ষে আমরা যা দেখি তা শুধুই ঘটনা। আমি পদার্থ বিজ্ঞানের ভ্রান্তি, প্রতিসরণ এসব জটিলতায় যাচ্ছি না। তাই শুধুই বলি 'ঘটনা'।
২) মানস চক্ষুঃ
আমি জানলা দিয়ে সামনের বট গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই পারি। তবু আমার চোখে পড়বে না তাতে খুব সুন্দর একটা পাখি এসে বসেছে, যদি না আমার মন সেই সময় চোখের সাথে থাকে।
মন চলমান ঘটনাগুলোর মধ্যে পারম্পর্য্য খুঁজে বার করে। তার অর্থ বার করে। তাৎপর্য্য বার করে, এসব অবশ্যই নির্ভর করে তার শিক্ষা ও মানসিক প্রবণতার উপর।
একে এক কথায় বলা যায় অভিজ্ঞতা।
এতটাই সাধারণ দেখার শ্রেষ্ঠ ধাপ।
এরপর আরেকটা ধাপের কথা আছে।
৩) আত্ম চক্ষু বা জ্ঞান চক্ষুঃ
গীতায় একটা কথা বেশ কয়েকবার উচ্চারিত হয়েছে খুব রহস্যের সাথে, "য পশ্যতি স পশ্যতি" - যে দেখে সেই দেখে।
আমার বন্ধুরা যাঁরা বেশ ভাল ক্যামেরা ব্যবহার করেন সেখানে দেখেছি একটা বিশেষ ছবি তোলার পদ্ধতি আছে - 'Panaromic view'. তুমি এ মাথা থেকে ও মাথা নিরবিচ্ছিন্ন ক্যামেরা ঘুরিয়ে একটা ছবি ওঠালে। পুরোটাই একটা ছবি হয়ে একটা ফ্রেমে বাঁধা পড়ল। ব্যাপারটা এরকম।
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে জীবন-মৃত্যুকে একটা প্যানারমিক দৃষ্টিতে দেখালেন। খন্ডিত না করে। অর্জুনের মোহ অপসারিত হল। তিনি এমন কিছু উপলব্ধি করলেন যা তাঁকে তাঁর সংশয়গুলোর হাত থেকে মুক্তি দিল।
তিনি বুঝলেন সংশয় কোন উত্তরে মেটে না, সংশয়ের পারে গেলে সংশয়ের উৎসটা চোখে পড়ে, তখন সংশয়টা উধাও হয়ে যায়।
এরপর?
এরপর সাম্য দৃষ্টির কথা। সব করো, কিন্তু বুদ্ধিটাকে সজাগ রেখে। সাম্যতা মানেই জাগ্রতাবস্থা। কোন রকম সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বা মানসম্মানের তোয়াক্কা কোরো না। তাহলে এদের বিপরীতগুলোও তোমায় আর পেড়ে ফেলবে না। ফলস্বরূপ যতটা উদ্বিগ্নতা মন তৈরি করে কাজের বাইপ্রোডাক্ট হিসাবে, ততটা হবে না।
করা শক্ত। অবশ্যই। তাই গীতা বলছেন, ধীরে ধীরে এগোও। কেউ তাড়া দিচ্ছে না। আর যতটাই এগোবে ততটাই তোমার লাভ। কারণ ততটাতেই তুমি স্ব-প্রতিষ্ঠিত, স্থির, নির্ভীক।
তাই আমাদের শাস্ত্রে গুরুর প্রণাম মন্ত্রে বলেছেন, "যিনি চক্ষু উন্মীলিত করেন তাঁকে প্রণাম করি।" অন্য অর্থে যিনি দেখতে শেখান তিনিই গুরু।
বুদ্ধদেবও তাঁর 'অষ্টাঙ্গিক মার্গে'-এ বলছেন, বাপু প্রথমে দেখাটা ঠিক করো। অর্থাৎ 'সত্য দৃষ্টি' আনো। বাকিটা এমনিই শুধরে যাবে।
স্বর্গে যাওয়ার মতলব ছাড়। ওখানেও pollution, politics, frustration আর সর্বোপরি corruption. যা হওয়ার এখানেই হবে। জগতে একটাই অপরিবর্তনীয়, স্থির সত্য - 'সব কিছুই পরিবর্তনশীল।' এইটাকে বুদ্ধিতে স্থির রাখো, শান্ত হও। ইহলোকেই ইসপার কি উসপার। দেখার ভঙ্গীটা শুধু বদলাও।
সাম্য দৃষ্টিটাকে রপ্ত করো। তাতে এমন কিছু হবে যা তোমার পুরো জীবনটাকেই অন্য স্রোতে বইয়ে দেবে।
তাই বলছিলাম কত রকম দেখার কথা। সব শেষে বলি, চন্দ্র সূর্য্য আকাশ বাতাস বন জঙ্গল বর্ষা বসন্ত নদী পাহাড় সমুদ্র সবই তো ছিল, কিন্তু রবি ঠাকুর না থাকলে দেখতে শেখাতো কে?