আয় দেখে যা নতুন ভাব এনেছে গোরা।
মুড়িয়ে মাথা গলে কাঁথা
কটিতে কৌপীন পরা।।
গোরা হাসে কাঁদে ভাবের অন্ত নাই
সদাই দীন দরদী বলে ছাড়ে হাই।
জিজ্ঞাসিলে কয় না কথা
হয়েছে কি ধন হারা।।
গোরা শাল ছেড়ে কৌপীন পরেছে
আপনি মেতে জগত মাতিয়েছে।
মরি হায় কী লীলে কলিকালে
বেধবিধি চমৎকারা।।
সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি হয়
গোরা তার মাঝে এক দিব্য যুগ দেখায়।
লালন বলে ভাবুক হলে
সেই ভাব জানে তারা।।
লালন সাঁইয়ের বিখ্যাত একটি গান। সেই সময়ের একটা পূর্ণছবি এই গানটায়। কোন সময়ের? কোনো ঐতিহাসিক শতাব্দীর অঙ্ক না। একটা সময় যখন পাণ্ডিত্য ছিল, জ্ঞানচর্চা ছিল, অর্থ ছিল ইত্যাদি সব ছিল। তবে কি ছিল না? ছিল না ভাব।
এই 'ভাব' শব্দটার খুব সোজা কোনো অর্থ দাঁড় করানো সম্ভব না। চিত্তের একটা জড়ত্ব এসেছিল। অনুভব ছিল না। রস ছিল না। ছিল শুধু শুষ্ক পাণ্ডিত্য। সংকীর্ণ চরিত্রের শাসন। বিধিনিষেধের অমানবিক অত্যাচার।
ইতিহাসে এ ঘটনা নতুন না। যখনই চিত্তের জড়ত্ব সভ্যতাকে গ্রাস করেছে, শুকিয়ে ফেলেছে মানুষের নিজের তৈরি বেড়াজালে মানুষকেই- তখনই কোনো না কোনো মহাত্মার আবির্ভাব। তিনি আনেন ভাবের বন্যা আমাদের চিত্তে লাগে গতি। আমরা এক ধাক্কায় অনেকটা পথ দিই পাড়ি।
মহাপ্রভুর অবদান নিয়ে আলোচনা করার ধৃষ্টতা করব না। সে পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনাও আমার কাছে অসার লাগে। যা দরকার, তা হল চিত্তে সেই রঙ যতটা লাগে, ততটা ধারণ করার সাধনা। চেষ্টা না। চেষ্টা আর সাধনায় বিস্তর ফারাক। শ্রদ্ধার ফারাক। চেষ্টার সে জোর নেই, সেই সহনশীলতা, ধৈর্য্য, স্থৈর্য নেই; যা সাধনার আছে।
মহাপ্রভুর সাধনা - উদারতার সাধনা। প্রেমের সাধনা। বিশুদ্ধ প্রেমে। যে বিশুদ্ধ প্রেম, সহনশীলতার কথা বলে তরুর মত। যে বিশুদ্ধ প্রেম, মর্মকর্ষিত নম্রতার কথা বলে তৃণের মত। যে স্থির ভালোবাসা, নিজেকে সরিয়ে অন্যের পথ তৈরি করার কথা আগে ভাবায়।
এ সাধনায় সফল হলে, তবে চিত্ত দ্রবীভূত হবে সেই পরমের মাধুর্য রসে। কিরকম মাধুর্য? যেমন পলাশের রঙের মাধুর্য। তা ফুলে নেই। আছে চিত্তে। ফুল তো উদ্দীপক মাত্র। সে তত্ত্বকথা থাক।
কথা হল সেই মাধুর্যের সন্ধান কিসে মেলে? আগের কথাগুলো তো সাধনার কথা। কিন্তু সেই সাধনায় যে আমার মতি নেই। আমার ইচ্ছা থাকলেও শক্তি নেই। তবে? কোথায় পাব সেই মাধুর্যের পথ। আরো ভেঙে বললে, সহজ পথ?
আছে। যে মানুষ সে মাধুর্যে ডুবে মাধুর্যময় হয়ে আছে, পাব তার কাছে। শরীর পুষ্টি পায় মুখ থেকে গৃহীত বস্তুগত খাদ্যে। মন পুষ্টি পায়, শ্রবণেন্দ্রিয়ের কাছ থেকে। শ্রবণমঙ্গলম্!
তাই বলছেন, "সাধুসঙ্গ সাধুসঙ্গ সর্বশাস্ত্রে কয় / লবমাত্র সাধুসঙ্গে সর্বসিদ্ধি হয়"। সাধু মানে Monk না, Saint না, সাধু মানে যিনি সচ্চরিত্র। শুধু সচ্চরিত্র নয়, পরম কারুণিক। যিনি আমার মনের মল ধুইয়ে দেবেন নিজের হাতে, আমাকে তাঁর মাধুর্যে অবগাহন করিয়ে। যদি না শুনতে চাই? তবু আমার গায়ে সে চন্দন চন্দন গন্ধ মাখা হয়ে যাবেই যাবে। কথায় আছে না, চন্দনতরুকে যে কুঠার- আঘাত করে, ছিন্ন করে; সেই কুঠারের শরীরেও লাগে চন্দনের সৌরভ। ঠিক সেইরকম।
মহাপ্রভু সেই মাধুর্যের পূর্ণ ভাণ্ডার। পরম কারুণিক। অযাচিত প্রেম তাঁর প্রতি পদক্ষেপে ধুলায় লুটিয়ে পড়ে। সে জাত মানে না, ধনী দরিদ্র মানে না, ভালো মন্দ বোঝে না। বোঝে একটাই কথা, নম্র চিত্তের আকুল ডাক।
সারাটা ভারতে আজও গ্রামে গ্রামে ঘুরলে, তাঁর কণ্ঠ নিঃসৃত সেই মহামন্ত্রের ধ্বনি শোনা যায়। সে নাম চিত্তের দরজায় আঘাত করছে, ডাকছে আজও দীনদরিদ্র থেকে ধনী বিত্তবানকে। সে নামে সহায় খুঁজছে নিজের নিঃসঙ্গতার সাথী। পরপারে যাওয়ার সাহস খুঁজছে কেউ। কেউ খুঁজছে ভরসা, জটিল জীবনযাত্রার আবর্তে পড়ে, অসহায় হয়ে। কি পাচ্ছেন? "যেই ভকত সেই জানে, ওগো তুমি জানাও যারে সেই জানে"।
তবে সে কি শুধু পাওয়ার? না। যার মনের গভীরে ঢুকেছে নামের রস, সে ছাড়ছে খোলস। বাইরের যা কিছু তা অত্যন্ত ভারী হয়ে উঠছে তার কাছে। হয়েছে অবহ। সে মজছে ভিতরে। প্রেমের ডাক তার দরজায়। একান্তভাবে তারই জন্য। তারই হাতে সে আবীর, যে আবীরের রঙের স্বপ্ন তার ঘুমে অনেকবার তাকে ছুঁয়ে গেছে। রঙীন করে গেছে তাকে।
মহাপ্রভু সেই ডাক। ঊর্দ্ধবাহু এই উন্মাদ মানুষটির একটাই আবেদন - ডাকতে শেখো। যদি না পারো আমায় দেখো। আমি শুধু ডাকতে শেখাতেই তো এসেছি। সব সহায়, সব গর্ব, সব আড়ম্বর দূর করে শুধু ডাকো। একান্তে তাঁকে ডাকো। শুধু ডাকো ডাকো ডাকো। তিনি সাড়া দেবেনই দেবেন। চিত্তরথে লাগুক অনুরাগের টান। ছোটাও রথ। সার্থক করো জীবন। ধন্য করো তোমার চারপাশ সুগন্ধে। তোমার অস্তিত্বের সুগন্ধে, আনন্দে। শুরু করেছিলাম লালন দিয়ে, ইতি টানি গুরুদেবে -
"আনন্দময়ের আনন্দ আলয় নব নব তানে ছাও রে
পড়ে থাকো সদা বিভুর চরণে আপনারে ভুলে যাও রে"
(ছবি - নেট)