পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কঠিন সময় এখন। কোনদিকে যাবে, কার দিকে ভরসায় তাকাবে, এ ভেবে আকুল, বিশেষত ভদ্রকূল।
সবাই জানেন, বঙ্গে ‘ভদ্রলোক’ বলে এক বিশেষ শ্রেণী আছে। বাঙলার তথা বিশ্বের যাবতীয় সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসাবে যাদের এককালে খ্যাতি ছিল। এখন খ্যাতি হারিয়েছে, যে যা খুশী এসে বলে যাচ্ছে বাইরে থেকে। মায় ঘরে ঢুকে বলে যাচ্ছে। ভদ্রশ্রেণী প্রতিবাদ করছে। কিন্তু আওয়াজ পাশের পাড়া অবধি পৌঁছাচ্ছে না।
তো কথাটা হল, ভীষণ সংকটের সময়ে দাঁড়িয়ে বঙ্গ। বঙ্গে রাজনীতিতে একটা বড় মুদ্দা হল, সংস্কৃতি। আমাদের সংস্কৃতি কি ওরা বোঝে? ইত্যাদি। বেকারত্ব নয়, দুর্নীতি নয়, স্বাস্থ্য নয়। যতবারই ভোট আসে ততবার এই একটা জিনিস নিয়েই বাঙালি গেল গেল রব তোলে, সেটা হল তার সংস্কৃতির গর্ব। সে যতই এখন 'জলসাঘর’ সিনেমার ছবি বিশ্বাসের মত অবস্থায় পড়ুক না কেন, তবু গর্ব আছে। আমাদের সত্যি অর্থে এখন সংস্কৃতি সে অর্থে নেই, কিন্তু তার জীবাশ্মটা আছে। আর মাঝে মাঝে সেই জীবাশ্মে আমাদের বাৎসরিক দীপ-ধুপ দেখানোর রেওয়াজও আছে।
এখন বাঙালি সমাজে অনেক আয়রনির মধ্যে দুটো আয়রনি ভীষণ প্রবল।
এক, বাঙালি দুর্গা অন্ত প্রাণ। তাই দেখা যায় অবাঙালি যত সিনেমা-সিরিয়ালে বাঙালিদের দেখায় বাড়িতে দুর্গাপ্রতিমা, পাড়ায় পাড়ায় দুর্গামন্দির ইত্যাদি।
আরেকটা হল, বাঙালির রাজনীতি অবসেসান। কথাটা হল আমাদের মধ্যে রাজনীতি বিশেষজ্ঞ যে মাত্রায় আছে, সে মাত্রায় সক্রিয় রাজনীতির লোক কোথায়?
বাংলায় অনেক বদল এসে গেছে। সমাজে। একদিন বাংলায় রাজনীতে বাম আদর্শে বহু শিক্ষিত ছেলেমেয়ে এসেছিল। বাঙালির একটা নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয় তৈরি হয়েছিল। তার ছাপ সঙ্গীতে, সিনেমায়, সাহিত্যে পড়েছিল। তাই হয়। কোনো সামাজিক পরিবর্তনই একমাত্রিক হয় না। ভালো-মন্দ দু'দিকেই তার প্রভাব পড়ে। পড়েওছিল তাই।
ক্রমে দিন বদলালো। সে আদর্শের উপর তরুণ তরুণীর আস্থা বা রোম্যান্টিসিজম আগের মত আর থাকল না। কেন থাকল না তার জন্য একটা বিশদ আলোচনা হতে পারে। অনেক অনেক ফ্যাক্টর কাজ করল। কিন্তু যে পরিবর্তনই হোক না কেন, শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকের ছেলেমেয়ে আর আগের মত সক্রিয় রাজনীতিতে এলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডীর মধ্যে অনেক কিছু হল, কিন্তু সে আর পরিণত রাজনীতিতে এলো না। আমাদের মানসিকতা তখন ঝুটঝামেলা এড়িয়ে, একটা নিশ্চিত জীবনে বাস করার উপর। বছরে দু' কি একবার বেড়াতে যাওয়া, মাঝারি মাপের নার্সিংহোমে চিকিৎসা করাবার মত আর্থিক সঙ্গতি, আর কিছু বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা, যেমন রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা, দুর্গাপুজো, কালীপুজো ইত্যাদি।
ক্রমে আইটিমুখী তরুণ প্রজন্ম হল। আরো সহজ হল মধ্যবিত্তীয় জীবনধারাকে কায়েম রাখা। যেহেতু আরো সহজ হল, আরো তথাকথিত গ্লোবাল মার্কেটে যাতায়াত হল, তত ‘সংস্কৃতির’ উপর টান কমল। রইল কিছু মধ্যবিত্তীয় বিলাস, শখ। কিন্তু এর মধ্যে রাজনীতি নিয়ে তর্কাতর্কি বন্ধ হল না। সে চলতেই থাকল। যদিও তরুণ প্রজন্মের এক বৃহৎ অংশ এই ব্যাপারে উদাসীন।
এখন সমস্যা হল আমি রাজনীতি নিয়ে উদাসীন হলে কি হবে? রাজনীতি তো আমাকে নিয়েই। আমি ডিঙিই চালাই, কি বিলাসবহুল বজরা, নদীর স্রোতের গতি আমাকে প্রভাবিত তো করেই। সেটার উপর উদাসীন থেকে আমি নিজেকে কিভাবে সুরক্ষিত রাখতে পারি?
এখন সারা বিশ্বে এক দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান হচ্ছে। কেন হচ্ছে, তার ব্যাখ্যাও এক-এক দেশে এক-এক রকম। যে কারণে মার্কিন মুলুকে দ্বন্দ্বটা বাইডেন বনাম ট্রাম্প হয়ে এসেছে। সে অবস্থাও খুব আশাপ্রদ নয় তাদের সমাজেও।
এখন ভারতের এক-এক রাজ্যে রাজনীতির রসায়ন এক-এক সমীকরণে চলে। বঙ্গে দীর্ঘদিন বামপন্থী রাজনীতি একটা কাঠামো তৈরি করেছে। তারপর তৃণমূল এসেছে। যতটা নতুনের আগমনের সমাজ উৎফুল্ল হয়েছিল, তার থেকে বেশি আমোদিত হয়েছিল পরিবর্তনে। কিন্তু যে সময়ে এই পটভূমিকা বদলাচ্ছে তার কয়েক দশক আগে থেকেই শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম সক্রিয় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। কোনো আদর্শগত ভাবধারা দিয়ে বাঙালি সমাজ তখন পুষ্ট নয়। সবটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে।
এমন সময় কেন্দ্রীয় সরকার আর রাজ্য সরকারের সংঘাত। যা কোনো সাংগঠনিক ইস্যু নিয়ে নয়। সবটাই দুর্নীতি নিয়ে। করাপশন নিয়ে।
এইখানে বাংলার সমাজের সঙ্গে বিজেপি’র কেন্দ্রীয় ভাবধারার একটা বড় অমিল। বাঙলায় ধর্মের ব্যাপারটা অন্য ধারার। বেশ কয়েক বছর ধরে হিন্দিভাষী তরুণদের মধ্যে একটা বড়সড় পরিবর্তন এসেছে। তারা পোশাকে, আচার-আচরণে, সাজে অনেক বেশি হিন্দু সেন্টিমেন্টের কাছাকাছি আসছে। যেমন তারা পায়জামা, পাঞ্জাবি পরে রিল বানাচ্ছে, মন্দিরে বেশি বেশি যাচ্ছে, মিডিয়াখ্যাত নানা সাধু, বাবাজী, গুরুদের আশীর্বাদ নিচ্ছে, নানা বিষয়ে নিজের অধ্যাত্ম বিশ্বাস, চিন্তাকে প্রকাশ্যে ব্যক্ত করছে। হয় তো একেই প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ভারতীয় তরুণ প্রজন্ম হীনমন্যতা ছেড়ে আত্মবিশ্বাসী হচ্ছে।
কিন্তু এই কাজটার সঙ্গে বাঙালির ভাবনার পার্থক্য আছে। এক, বাঙালির দেশাত্মবোধ আর হিন্দুত্ব সেন্টিমেন্টের বোধ এক সমীকরণে বসে না। বাঙালির দেশাত্মবোধে রবীন্দ্রনাথ, নেতাজী, চিত্তরঞ্জন প্রমুখের উপস্থিতির জন্য তার সেণ্টিমেন্টটা অনেকটা সেক্যুলার। দেশকে মা বললেও, তাকে চণ্ডীর আদ্যাশক্তির সঙ্গে এক করে দেখে না।
দ্বিতীয়, বাঙালির ধর্মবোধ কোনো কেন্দ্রীয় গ্রন্থে গ্রথিত নয়। যেটা হিন্দীভাষীদের ক্ষেত্রে রামচরিতমানস। তার দোঁহা সে দিকে ভীষণ জনপ্রিয়। লোকের মুখে মুখে জীবন্ত। আমি ধর্ম বলতে সেন্সাস বলছি না, সক্রিয় ধর্মের অনুষ্ঠান বলছি। বাঙালি সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় গ্রন্থের অনুশাসনে নেই। নানা গুরুতে বন্টিত সমাজ। রামকৃষ্ণ, অনুকূল ঠাকুর, লোকনাথবাবা, হরিচাঁদ, চৈতন্যদেব প্রমুখদের নানা গোষ্ঠী আছে। এবং কথামৃত আর চৈতন্যচরিতামৃত বাদ দিয়ে সে অর্থে তেমন কোনো গ্রন্থও বাঙালি সমাজকে প্রতিষ্ঠিত ধর্মের দিক দিয়ে প্রভাবিত করেনি।
আরেকটা কথা হল, হিন্দিভাষী সমাজের অধ্যাত্মিক তৃষ্ণা যেমন তুলসীদাস মিটিয়ে চলেছেন, বাঙালি সমাজের সে তৃষ্ণা তেমন মিটিয়ে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ। তার গান দিয়ে। কিন্তু সে তো কোনো প্রতিষ্ঠিত ধর্মমত না যা দিয়ে লোককে বাঁধা যাবে।
শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজকে তাই রাজনীতির কোনোদিকই আজ আর আকর্ষণ করে না। না, বাম আদর্শ। না তুলসীদাসের ধর্মীয় আবেগ। এই শূন্যস্থানকে কতদিন আর রঙ্গমঞ্চ থেকে বিনোদনমঞ্চের কলাকুশলীদের দিয়ে কাজ চালানো চলবে? বাঙালির স্বপ্ন এখন আগের মধ্যবিত্তীয়তা থেকে যেভাবে ঊর্ধ্বগামী, যেখানে এসি থেকে, গাড়ি, আইফোন তার হাতের নাগালে সেখানে আচমকা ‘সর্বহারা’ ইত্যাদি, সম্পদের সমবণ্টন ইত্যাদি বড় কানে শোনায়। ধর্মের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, বিশেষত হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু বলে সহজে পার পাওয়াও দিনে দিনে কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তবে?
তবে একটাই রাস্তা পড়ে থাকল, সংঘাত। ভায়োলেন্স। আদর্শ না। শিক্ষিত মানুষের ইস্যু বা মুদ্দাকেন্দ্রিক সাংগঠনিক তর্কবিতর্ক নয়। জোর যার মুলুক তার। ভায়োলেন্স সব সময়েই মিথ্যা থেকেই জন্মায়। মিথ্যা থেকে ভয়। ভয় থেকে ভায়োলেন্স। এই আদি পথ। তাই সবাই আজকাল জোর গলায় বলে, পশ্চিমবঙ্গের ভোটে যা ভায়োলেন্স হয়, তা দেশের আর কোথাও হয় না।
কথাটা সত্যি। কিন্তু এটা লক্ষণ। কারণ আমরা। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের সাবধানী করে বিদেশে পাঠাচ্ছি, দক্ষিণভারত, পশ্চিমভারত পাঠাচ্ছি। জানি সেখানে সব “সিকিওর”। এখানে কি আছে? বলে হাপিত্যেশ করছি। কিন্তু তার দায় যে আমাদেরও, সেটা কি ভেবেছি? এখন আমরা তুলসীদাসের ভাবাবেগকে আপন করব, না বর্তমান সরকারকে আধাবিশ্বাসে মেনে নেব, না আর কোনো বিকল্প ভাবব? চণ্ডীমণ্ডপে বসে রাজনৈতিক তরজাতেই শিক্ষিত তরুণ সমাজ থাকবে, না কি সংসদে প্রবেশের লড়াইয়ে নামবে? বড্ড দেরি হয়ে গেছে না?