মঙ্গলের উপর আস্থা হয় তো মানুষের একসঙ্গে থাকার প্রাথমিক আস্থা। এত অমঙ্গল, এত ক্ষয়ক্ষতির পরও মানুষ বিশ্বাস করে, আস্থা রাখে, ভালো হবে। অবশেষে সব ঠিক হয়ে যাবে। এ বিশ্বাস হারিয়ে যাওয়া মানে মানসিক অসুস্থতার দিকে চলে যাওয়া। অবসাদ, বিষাদ। সে সব মানে অবশেষে আস্থা হারানো জীবনে।
এই মঙ্গলের উপর আস্থায় মানুষ মনে মনে এক মঙ্গলময়ের মানবিক রূপের ছবি আঁকে। সে ছবি এতটাই প্রবল যে এতবড় একটা অতিমারিও তাকে ম্লান করতে পারেনি। ক'দিন আগে পড়ছিলাম এবারে নানা ধর্মস্থানে মানুষের ভিড় রেকর্ড সংখ্যা ছাড়িয়েছে।
না, এত লক্ষকোটি মানুষের আস্থাকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেব, এতটা স্পর্ধা আমার নেই। একি পরীক্ষিত সত্য? অবশ্যই নয়। তবু এ কল্পনার সত্য। মঙ্গলের প্রতি আস্থাটুকু হারালে তো সবই হারালো। আর কিসে যে মানুষের মঙ্গল সে উত্তর নিশ্চিতভাবে কার কাছেই বা আছে? নেই যখন তখন অন্যের শ্রদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধা রাখাকেই শ্রেয় বলে মনে হয়।
আজ গঙ্গার ঘাটে এসে জানলাম আজ 'জিতিয়া'। বিহার, উত্তর প্রদেশের উৎসব এটা। মায়েরা উপোস থাকেন সন্তানের মঙ্গল কামনায়। নানা উপাচার নিয়ে খালি পায়ে আসেন নদীর তীরে পুজোর জন্যে। সন্তানের মঙ্গলের জন্য।
এর কি ইতিহাস সে গল্প থাক। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে যা অনুভব করছিলাম তা এক নম্র শ্রদ্ধা। কোথাও কোনো উদ্ধতভাব নেই। মা সন্তানকে ভিড়ের মধ্যে বসে স্তনপান করাতে করাতে ব্রতকথা শুনছেন। ছোটো ছোটো হাতপাখা নিয়ে বাচ্চাদের মাথায় হাওয়া দিচ্ছেন। মোবাইলে ছবি উঠছে। সেল্ফি উঠছে। গান হচ্ছে একসঙ্গে।
পিচের রাস্তার উপর সার দেওয়া খালি পা। খালি পা আমাদের সংস্কৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর উপায়। মন্দিরে খালি পায়ে ঢুকতে হয়। পৃথিবী তখন সেই মুহূর্তে পবিত্র। রোগশোক, ভয়, দুঃখ --- সব আছে। কিন্তু সবার উপর আছে আমার সে সব মাড়িয়ে যাওয়ার তৃষ্ণা। আমার সে সব মাড়িয়ে এগোবার স্পৃহা। এ কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। পারবেও না। নইলে এত এত ভয়ংকর উগ্রপন্থীর হামলার পরেও মানুষ রাস্তায় নামত না। যদি বলো সে কাজের তাগিদে? তবে বিনোদনের জায়গাগুলোয় এত মানুষ কেন? না, মানুষ কোনো সিসিটিভি-র ভরসায়, হাজার একটা নানা উপায়ের সিকিউরিটি চেক ইত্যাদির ভরসায় বাইরে বেরোয় না। মানুষ অদম্য বলেই বাইরে বেরোয়। ভয় মানুষকে চিরকালের জন্য দমিয়ে রাখতে পারে না বলেই মরণশীল মানুষ অমর আত্মার কল্পনার স্পর্ধা দেখায়। নইলে মানুষই তো একমাত্র প্রাণী যে জ্ঞান হওয়া থেকেই জানে সে মরণশীল। ভয়ে কুঁকড়ে বাঁচে না কেন সে? কারণ মানুষের আত্মায় চিরকালই ভীরুতার উপর এক তীব্র ঘৃণা আছে, 'না' আছে।
মানুষ বিশ্বাসে হাঁটে, যুক্তিতে ভাবে, ভালোবাসায় আর ভয়ে কল্পনা করে। সে ভাবনাকে করার দিকে এগিয়ে দিতে বিশ্বাসের হাত ধরতে লাগে। মানুষের পবিত্রতম বিশ্বাস, মঙ্গলের উপর আস্থা। একজন ঠাকুমা নাতির হাত ধরে কাঁপতে কাঁপতে উঠছেন সিঁড়ি দিয়ে। মাথা ভিজে। গঙ্গা স্নান করেছেন। নাতির বয়েস দশ পেরোয়নি। কিন্তু ঠাকুমা সে-ই হাতেই তাঁর আস্থা রেখে উঠছেন। আমি একটু উপরে দাঁড়িয়ে। আমার থেকে দুটো সিঁড়ি আগে একবার মনে হল মাথাটা ঘুরে গেল ওনার। পাশের দেওয়াল ধরে দাঁড়ালেন। ক্ষণিকের জন্যে চোখ বন্ধ করেই আবার খুললেন। আমার চোখে চোখ পড়ল। হাসলেন। কি অপূর্ব সে হাসি। ওনার মাথার পিছনে গঙ্গার ওইপারে সূর্য ডুবছে। ওনার জীবনও পশ্চিমের দিকে ঢলে। জীবন যে সচ্ছল ছিল না, আজও নেই সে ছাপ স্পষ্ট।
আমি এগিয়ে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলাম, ঠিক আছেন?
উনি একগাল হেসে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক আছি।
হাতটা এগিয়ে বললাম, উঠে আসুন।
উনি আরেকবার হেসে, উদ্বিগ্ন খুদে মুখটার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই যে নাতি আছে।
নাতি আবার তার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়ে ঠাকুমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, আও।
আমার সামনের সব কিছু মুহূর্তে ঝাপসা হল। "আও"-এ আস্থার ডাক। বিশ্বাসের ডাক। ভালোবাসার ডাক।
মানুষের যুক্তি, বিশ্বাস, কল্পনা সব থাকুক, ভালোবাসার হাত ধরে। ভালোবাসা না থাকলে বিজ্ঞানও কুসংস্কারের মতই ধ্বংসাত্মক। মঙ্গলের তৃষ্ণা না থাকলে সত্যও তথ্যের প্রাচীরে আবদ্ধ হয়ে অচল। আমার আভূমি প্রণাম মানুষের সমস্ত মঙ্গলের ইচ্ছায়, যেখানে মানুষ হাত বাড়িয়ে বলছে, "আও"।