Skip to main content

KK বনাম রূপঙ্কর থামতে চায় না, এদিকে আবার শুরু হল হার্ট অ্যাটাকের পাঁচালি। এমনিতেই বাঙালির ঘরে ঘরে ডাক্তার, সে এমবিবিএস পাস করুক চাই না করুক। স্বাস্থ্য ও ওষুধ নিয়ে নিজের কোনো বিধান নেই এমন বাঙালি দুর্লভ। তার উপর মেডিক্যাল ক্লাস এখন খবরের কাগজের পাতার পর পাতা জুড়ে শুরু হয়েছে। বিষয় --- হার্ট অ্যাটাকের সাতকাহন। কি করে বুঝবেন, আপনার কখন হার্ট অ্যাটাক হবে, কি কি করবেন, করবেন না ইত্যাদি। ওরে ভাই, UN থাকতেও যেমন একশো দিন ধরে যুদ্ধ চলে, তেমন হাজার একটা বিধিবিধান জানা থাকলেও ও হবেই। কতদিক সামলায় মানুষ! তাছাড়া স্বাস্থ্য নিয়ে অতি আদিখ্যেতা আর বাড়াবাড়ি করার সময় ক'জন মানুষের আছে?

    একবার আমার এক আত্মীয়ের ভীষণ শরীর খারাপ। তার বয়েস হয়েছিল। তো একজন পাড়ার ডাক্তারকে ডাকা হল, যিনি আদতে কম্পাউণ্ডার ছিলেন, কিন্তু তারপর চেম্বার করে বসেন এবং অনেকের অগতির দুর্গতি হন। তো তিনি স্টেথো, ব্যাগপত্তর নিয়ে তো এলেন। এসে আমার সেই আত্মীয়কে ভালো করে দেখেশুনে বললেন, ওনার মনে হচ্ছে আজ বা কাল বা পরশু'র মধ্যে একটা হার্ট অ্যাটাক হবে, আপনারা তৈরি থাকবেন।

    ব্যস! বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রিস্ক না নিয়ে ওনাকে একটা নার্সিং হোমে ভর্তিও করে দেওয়া হল। আমার সেই আত্মীয় এবং আমরা সবাই অপেক্ষা করছি কখন টুক্ করে হার্ট অ্যাটাক হয়। তো সে আর তিনদিনেও যখন হল না তখন আমার সেই আত্মীয় ভীষণ বিরক্ত হয়ে, বণ্ড সই করে বাড়ি চলে এলেন। তবে ওনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল সে আরো বছর চারেক পর।

    এখন কথা হচ্ছে মানুষকে ভয় দেখিয়ে কাগজের বিক্রি বাড়ানো কি ভালো কথা? এমনিতেই বর্তমানে সাইবারকণ্ড্রিয়া বলে একটা মানসিক গড়বড় বাজারে ঘুরছে। মানুষ যা-ই হয় গুগল করে ফোঁড়া থেকে ক্যান্সারে পৌঁছায়, নানাবিধ প্যানিক অ্যাটাকে ভুগতে ভুগতে ডাক্তারের পর ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তারের মাথাটা চিবিয়ে খায়, সঙ্গে নিজের, আত্মীয়-স্বজনের, সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। তার মধ্যে এই এক শুরু হল খবরের কাগজের প্রোভোকেশান। মানুষ যায় তো যায় কোথায়? 

    আসলে এই 'বাজার বনাম আমি', না 'আমি বনাম বাজার', এ দ্বন্দ্বের এখন তুঙ্গবস্থা। তুমি জন্ম হইতেই বাজারের জন্য বলিপ্রদত্ত --- এই হল এখনকার স্লোগান। আমার হাতের মোবাইল থেকে শুরু করে শোয়ার ঘরের টিভি অবধি বাজার। আর মোবাইলের যাতায়াত কোথায় নেই? সেই অর্থে আমার শৌচালয়েও বাজার। এই বাজারে আমার স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ধর্ম, দর্শন, সুখ, সাহিত্য, সিনেমা, শিল্প সব দাঁড়িয়ে। কেউ বাদ নেই। কিছুই বাদ নেই। বাজারকে ছাড়িয়ে দাঁড়ানো যাবে না। সে আত্মহত্যার খবর হোক, কি অর্থনীতির। সব পণ্য হবে। সমান আগ্রহ গড়ে তুলতে হবে বাজারে। বাজারে চাহিদা উৎপন্ন করাটাই মূলমন্ত্র। সে চাহিদা কৃত্রিম কি আসল কে দেখবে? আর দেখতে চাইলেই বা দেখতে দেবে কেন? 

    মুক্তি? ওরে মুক্তি কোথায় পাবি? আপনি প্রভু বাজারের লাভ-ক্ষতিতে বাঁধা! শান্তি? সে কি জিনিস? সে তো মহামূল্যবান বস্তু। গুরুর আশ্রমে সিট বুক করো। শ্বাসের গতি নিয়ে ইতিউতি করো। তারপর শান্তির সাদা পায়রাকে খাঁচায় ভরে বাড়িতে নিয়ে যাও। প্রতিবেশীকে দেখাও, এই দেখুন আমার শান্তিলাভের সুখ। আসুন আপনি আমি দু'জনেই জ্বলি। হিংসায়। প্রাণ জ্বালিয়ে, তৃষা জাগিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও লোভ। আরো ঈর্ষা, আরো হিংসা, আরো ষড়যন্ত্রের দীক্ষা... আরো আরো আরো দাও লোভ। 

    বাজার খেয়ে নিচ্ছে সব। তবু, বাজারের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। বাজারকে কোলে করে হয় মাটি, নয় আগুন। আমাদের বাজারে জন্ম, বাজারে জীবন যৌবন, বার্ধক্য, শেষে বাজারেই মৃত্যু। উপায়? লোভহীনতা? সেটা কি জিনিস? ওতে কেউ বাঁচে নাকি? বাজার বলে, ওসব অলসের কথা। বিবেক দোকানের তলায় রুগ্ন কুকুরের মত শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে বলে, ওটাই খাঁটি কথা। কিন্তু তার ঘেউ ঘেউ কেউ শোনে না। একটা লাথি দিয়ে ক্ষীণ চীৎকার থামিয়ে দেয়। বাজার জিতে যায়।