সৌরভ ভট্টাচার্য
24 February 2020
শ্রদ্ধা আর প্রয়োজন, দুটো শব্দ আছে। একজন মানুষ শাস্ত্র, মন্দির, পুজো-আচ্চাকে শ্রদ্ধা করে। একজন মানুষ সব মানু্ষের মধ্যে সমান সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারার আদর্শকে শ্রদ্ধা করেন। একজন মানুষ নানা ধরণের খেলাধুলাকে শ্রদ্ধা করেন। একজন মানুষ রাজাকে কি রাজতন্ত্রকে শ্রদ্ধা করেন।
এরকম নানা রকমের শ্রদ্ধার সমাবেশ এই বৈচিত্রময় সমাজ। সবাই ভাবছেন তার শ্রদ্ধাই সব চাইতে বাস্তবানুগ, বাস্তবমুখী, কেন সবাই সেই শ্রদ্ধায় নিজেকে নিয়োজিত করছেন না? ক্রমে শ্রদ্ধা প্রগাঢ় ভক্তিতে রূপান্তরিত হয়। সেই ভক্তি ক্রমে অন্য ভক্তির সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। ভক্তি হয় আক্রোশে পরিণত। তখন সমনস্কের সাথে সে নিরাপদ, সুখী, খুশী। যেই ভিন্ন মতের মানুষ এল, অমনি সে ক্রুদ্ধ, নয় কপট নম্রতায় তাকে স্বমতে আনার কৌশলে লিপ্ত, নয় রুদ্রমূর্তি ধারণ করে রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
এর অন্যদিকে আছে প্রয়োজনের রাজ্য। সেখানে শৌখিন লড়াইয়ের অবকাশ নেই। অন্ন, বস্ত্র, জল, বায়ু, বাসস্থান, শিক্ষা - নিয়ে কারোর কোনো মতবিরোধ হয় না। এইসব নিয়ে কোনো পৃথকভাবে উদযাপনের দিনও হয় না। কারণ এগুলোর উপরে আমরা বাঁচি, এগুলো নিয়ে আমরা বাঁচি না। একজন শিশু তার খেলাঘরে নানা কিছু উদযাপন করে, কিন্তু নিজের মা-বাবার অস্তিত্বকে নিয়ে কোনো উৎসবের আয়োজন করে না। কারণ সে মা-বাবার উপরে বাঁচে, আর খেলনাকে নিয়ে সে থাকে। সেই যখন বড় হয়, মা-বাবার উপর নির্ভরতার দিন শেষ হয়, সেদিন সে মা-বাবার অস্তিত্বের নানা উৎসব আয়োজন করে।
আমাদের ভাষার মধ্যেও সেই বিভাজন স্পষ্ট। আমরা ইংরাজি ও খানিক হিন্দীতে নির্ভর করে বাঁচি, কিন্তু বাংলা নিয়ে থাকি। এই 'নির্ভর' আর 'নিয়ে' র মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। আমার বাড়িতে যিনি কাজ করেন, যিনি বাংলা ভাষা ভিন্ন অন্যকোনো ভাষা বলতে জানেন না তার কাছে মাতৃভাষা উদযাপন নিতান্তই আদিখ্যেতা। আমাদের তা বললে চলে না, আমাদের এই দিনটা এলেই খুব জোরের সাথে মনে করতে হয় আমাদের অস্তিত্বের সাথে আমারা একটা ভাষা প্রাপ্ত হয়েছিলাম। যে ভাষাটা এই প্রযুক্তিপ্রাণ যুগে ক্রমশ নিজের প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে। আমাদের শিক্ষার ভাষা আর কাজের ভাষা দুই এখন আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে গেছে। আমাদের ঘর নেই আজ, কিন্তু মাঠ আছে। আমাদের নিজেদের জল খাওয়ার পাত্র নেই আজ, নিজেদের পুকুর দীঘি নেই, আছে সমুদ্র। আমাদের কথায় কথায় আজ আন্তর্জাতিক হতে হচ্ছে। তবে নিজের ঘর হারিয়ে আন্তর্জাতিক হওয়ার মধ্যে অভিনবত্ব কিছু না থাকলেও বেশ উত্তেজক কিছু আছে বইকি, নইলে এত মানুষ পোশাকে, আচারে, চলনে, বলনে, ভালোবাসায়, স্বজাতি অভিমানে এত পাশ্চাত্যমুখো কেন? কারণ আমাদের ঘর চাইনে, মাঠ চাই, আন্তর্জাতিক মাঠ।
একটা মজার উদাহরণ বলি। যখন 'সেপারেশন' বলে ইরানি সিনেমাটা অস্কার পেল, এবার আবার যখন 'প্যারাসাইট' বলে কোরিয়ান সিনেমাটা অস্কার পেল, তখন দুই পরিচালকই সমস্ত আন্তর্জাতিক চ্যানেলের সাক্ষাৎকারগুলোতে নিজেদের ভাষাতেই প্রধাণত কথা বলেছেন, আর মাঝে মাঝে ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে কখনও কখনও। আমরা সব্বাই কিন্তু বেদম হেসেছি, অবশ্যই মনে মনে, তাজ্জব হয়েছি, ওমা! এতবড় একটা পুরস্কার পেলি, ইংরাজি জানিস নে? কতবড় নেমকহারাম রে তোরা? কি অশ্লীল দাম্ভিকতা!
আমরা সে নেমকহারামি করিনি কিন্তু। আমরা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে, মৃত্যু অবধি সব শিক্ষার ভার ইংরাজি ভাষাকে দিয়ে আন্তর্জাতিক হয়েছি। আমরা আমাদের ঘর পুড়িয়ে এসে বলেছি আমাদের মাঠ আছে, আকাশ ভর্তি তারা আছে, এক সমুদ্র জল আছে, জঙ্গল ভর্তি ফল পাকুড় পশু আছে। মোদ্দা কথা আমরা আন্তর্জাতিক। তাই আমাদের সব ভাষা অবশেষে সব নদীর যেমন সাগরে এসে পড়ে, তেমন ইংরাজিতে এসে পড়ে।
আজ হঠাৎ করে যেহেতু প্রতিবেশী দেশে অমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে, যেটা আমাদের সেন্টিমেন্টে আঘাত করে, আমরা কেঁদেকঁকিয়ে "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো" গাইতে গাইতে যখন বলি, "আমি কি ভুলিতে পারি?" তখন আসলে মনে মনে বলি, "বেশ ভুলিতে পারি বাইশে ফেব্রুয়ারী থেকে বিশে ফেব্রুয়ারী অবধি। শুধু প্রকাশ্যে বলিতে পারি নে"। কারণ কি? কারণ এসব আমাদের সেন্টিমেন্ট, তাগিদ নয়। সেন্টিমেন্ট বড় স্পর্শকাতর বিষয়, ওই রামমন্দিরের মত, রামের শিক্ষাটা যেমন বড় নয়, বড় রামের আইডিয়াটা তেমনই আমাদের ভাষার মাথা উঁচু করে ইংরাজি ভাষার পাশাপাশি রাজপথে কাজের ভাষা হয়ে হাঁটার মান নেই, কিন্তু আমাদের সমস্ত সেন্টিমেন্ট অধিকার করে সে বসে। কারণ সেন্টিমেন্ট কখনও আন্তর্জাতিক হয় না। সেন্টিমেন্ট সব সময় প্রাদেশিক। কারণ সেন্টিমেন্ট এর মধ্যে একটা আদেখলাপনা আর পরশ্রীকাতরতা শুরু থেকেই থাকে। তাই আমাদের ভাষাটা আমরা চাই হাসপাতালে আইসিইউতে খুব প্রিয় বয়স্ক আত্মীয়ের মত নাকেমুখে নল গুঁজে শুয়ে থাকবে, আমরা আমাদের তুঙ্গে চড়া সেন্টিমেন্ট নিয়ে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে দেখা করতে যাব। কাঁদব, গাইব, হাসব, বলব আমরা কত ভালোবাসি। এও বলব এই আইসিইউ এর বাইরে তুমি এসো না, আমরা পুরোদস্তুর আন্তর্জাতিক আজকে, তুমি বুঝবে না। আমরাও রবীন্দ্রনাথ নই, আর তুমিও সে বাংলা নও আজকে, তাই চুপটি করে শুয়ে লক্ষ্মীটি।
আচ্ছা ঘর যে নেই, তবে ঝড়ের সময় কি হয়? কেন আমাদের আন্তর্জাতিকতা মানে কি তবে? সেকি ইরাক, ইরান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ নাকি? সে তো আমেরিকা গো, আমেরিকা। মায় লন্ডন যাওয়াকেও এখন আমরা পুরোনো শখ বলি। তবে আমাদের দুর্দিনে আমেরিকাই তো হবে আমাদের ছাতা, আশ্রয়। আমাদের প্রাণের কথা, কাজের কথা সবই তো ওদের ভাষাতেই বলতে পারি আমরা। তবে আর এই ডোবায় থাকব কেন?
তবে যে বইমেলায় এত বাংলা বই বিক্রি হল? তা তো হল, মানুষের সাধ আর তাগিদ দুটো আলাদা কথা বললাম যে বাপু, আগে গ্রন্থাগার খুলুক আর বিদ্যালয়গুলোয় বাংলা মাধ্যম ফিরুক, তবে ও যুক্তি শুনব। তদ্দিন আদিখ্যেতাই বলব।