Skip to main content

স্বামীজী যে ভারতবর্ষ চেয়েছিলেন, মহাত্মা গান্ধী যে ভারতবর্ষ চেয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ যে ভারতবর্ষ চেয়েছিলেন, তার কোনোটাই হয়নি। তাদের চাওয়াতে ভুল ছিল। তারা মানুষের দিকে যতটা গুরুত্ব দিয়েছেন, সম্পদের দিকে ততটা নয়। মানুষ আগে, সম্পদ পরে। তিনজনেই শিক্ষা বলতে বুঝেছিলেন, চরিত্র। অবশ্যই ভুল বুঝেছিলেন। শিক্ষা মানে স্বনির্ভর হতে পারা। স্বনির্ভর হতে পারা মানে উপার্জনক্ষম হতে পারা। উপার্জনক্ষম হতে পারা মানে নিজের ইচ্ছা শখ বাসনা স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষাপূরণে সক্ষম হতে পারা।


       মানুষকে কে চালায়? শিক্ষা। ভুল। মানুষকে চালায় তার সংস্কার। তার অভ্যাস। ব্যক্তি অভ্যাসকে চালায় পারিবারিক পারিপার্শ্বিক অভ্যাস। পারিবারিক পারিপার্শ্বিক অভ্যাসকে চালায় সামাজিক অভ্যাস। সামাজিক অভ্যাসকে চালায় ঐতিহাসিক অভ্যাস। শিক্ষা মানে ভারতের ব্যর্থ রথীমহারথীরা ভেবেছিলেন সংস্কারকে বদলে দেওয়ার পদ্ধতি। হল না। তাই উপায় একটাই সংস্কারের কোয়ালিটি না বদলিয়ে, তার ইউটিলিটি বদলিয়ে তাকে ব্যবহার উপযোগী করে তোলার ব্যবস্থা করা। তার জৈবিক, মানসিক, বৌদ্ধিক সংস্কারকে ঘাঁটিও না। তথ্য দাও। সে তার সংস্কার অনুযায়ী সে তথ্যকে ব্যবহার করে নিতে পারবে। পশুকে যেমন খাদ্য দিয়ে বশ করো, মানুষকে তেমন তথ্য ও কৌশল শিখিয়ে বশ করো, কাজে লাগাও।

       সংস্কার মানে কি? আত্মকেন্দ্রিক অভ্যাস। নিঃস্বার্থপরতার কোনো সংস্কার হয় না। নিঃস্বার্থপরতা চেতনার জ্যোতি। চেতনার আদি-অন্ত-ভবিষ্যৎ হয় না। চেতনার শুধুই বর্তমান। সংস্কারের আদি হয়, মোটিভ থাকে। চেতনার কোনো মোটিভ থাকে না, চেতনা নিজেই নিজেতে পূর্ণ। চেতনা নিজেই নিজের উপায়। সংস্কার তা নয়, সংস্কার একটা মোটিভ না হলে কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে পারে না। অন্ধকারে গোল গোল ঘোরে। তাই তাকে কাজে লাগাতে একটা নিয়ম বার করা হয়। তুমি আমার কাজ করে দাও, আমি তোমার স্বার্থটা দেখে দেব। আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতি এই গিভ এণ্ড টেক পলিসিকে আরো সুক্ষ্ম, আরো ব্যাপক পদ্ধতিতে ব্যবহারের পথ দেখায়। কারণ সে জানে তার চালিকাশক্তি চেতনা নয়, সংস্কারের বুনোশক্তি। তার আলো না, ভোগের সামগ্রী চাই। পথ না, খুঁটি চাই; যাতে বেঁধে দিলে সে গোল গোল ঘোরে, নিজেকে সুরক্ষিত ভাবে।

       চারদিকে তাকিয়ে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায় আমাদের শিল্পসত্তা থেকে শুরু করে যাবতীয় সৃষ্টিশীল কাজের মূল লক্ষ্যই এই আমাদের আদিম সংস্কারকে তৃপ্ত করা। আমাদের গান, আমাদের সিরিয়াল, আমাদের সিনেমা, আমাদের গল্প ইত্যাদি যাবতীয় যা কিছু। খুব মোটা দাগের হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। সূত্র একটাই, কনফ্লিক্ট ফ্রি হতে হবে। কিভাবে হবে? জোয়ারে বা ভাটায় ভাসিয়ে দাও নিজেকে। সময়ের সাথে সে নিজের জায়গা খুঁজেই নেবে। শুধু কনফ্লিক্ট তৈরি করো না। মানুষ কনফ্লিক্ট ভালোবাসে না। মানুষ অন্ধ আবেগ ভালোবাসে। রাগ, হিংসা, আকর্ষণকেন্দ্রিক ভালোবাসা ইত্যাদি। মানুষ গিলে খাবে। তার আদিম যত আবেগকে জাগিয়ে তোলো। মানুষকে ঘর দাও। মাঠ দিও না, আকাশ দিও না। মানুষ মরে যাবে।

       কেন কনফ্লিক্ট ভালোবাসে না মানুষ? কারণ কনফ্লিক্ট হল চেতনা আর সংস্কারের সংঘাত। মানুষ ঈশ্বরের গল্প ভালোবাসে, শয়তানের গল্প ভালোবাসে, যুদ্ধের গল্প ভালোবাসে, কেউ একজন হারল, কেউ একজন জিতলে সে খুশী হয়। কিন্তু কনফ্লিক্টের চক্করে সে ক্লান্ত। কারণ চেতনাটা মানুষের সহজাত নয়, সংস্কারটা সহজাত।

       মানুষের ধর্মের দুটো স্পষ্ট দিক আছে। একটা চেতনার, একটা সংস্কারের। যে কোনো ধর্মের চেতনার দিকটা সব সময় প্রাসঙ্গিক, বাকিটা না। কিন্তু সংস্কারের দিকটাকে মজবুত না করলে কোনো ধর্মকে একটা বাস্তবিক সামাজিক রূপও দেওয়া যায় না। শুধু ইন্টেলেক্টে ধর্ম হয় না। তার অনেকগুলো বাহ্যিক অভ্যাসগত আনুষ্ঠানিক দিক তৈরি করতে হয়। তবে সেগুলো মানুষের মজ্জাগত হয়। সেইসব অনুষ্ঠান যুগের পর যুগ থেকে যেতে পারে। তার একটা মোটিভ তৈরি করতে হয়। ওই যে একটু আগেই বললাম, সংস্কারের মোটিভ থাকে, চেতনার কোনো মোটিভ থাকে না। সেই মোটিভ যতই অবাস্তব হোক না, তবু সে একটা নিজের তৈরি খেলা খেলেও একটা ধাতব ট্রফির দিকে ছুটে যাবে। হাতে ধরে বলবে, আমি জিতেছি।

       অন্যদিকে কর্তব্যবোধ। কর্তব্যবোধ মানুষের চেতনাজাত। তাই সেই কর্তব্য সমাধা হতেই মানুষের সার্থকতা। কর্তব্যের কোনো মোটিভ হয় না। সে নিজেকে সম্পূর্ণ করতে পারলেই নিজের মধ্যেই সুখ পায়। কিন্তু মোটিভের দাসত্ব করে যে সংস্কার সে কাজের শেষে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে, তার পুরষ্কার চাই। কারণ যে কাজটা সে করল তার সাথে তার আত্মার কোনো যোগ নেই, আছে তার সংস্কারের। তার লোভের, তার নানা বাসনার। সে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তার মনের মধ্যে জমে থাকা আদিম চালিকাশক্তি সে। তাই দেখা যায় যে মানুষের চেতনার বিকাশ যত অল্প তার সুখ তত বেশি। কারণ সুখ কনফ্লিক্টের বিপরীত। পূর্ণ চেতনার বিকাশ হয়েছে এমন মানুষ বাস্তবে সম্ভব না। তাই আমরা আমাদের থেকে চেতনায় অধিক বিকশিত মানুষের সংস্কারবশত সাধারণ দোষযুক্ত দিকের আলোচনা বেশি করি, সুখ পাই। বারবার করে বলি, ওই তো উনিও তো এরকম করেছিলেন...বা করেন। আবার যার মধ্যে অল্প হলেও চেতনার ডানার ঝাপট জেগেছে, সে বলে, আমি ওর কাছে যে আলো পেয়েছি, সে আমার অনেক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়েছে, আমি কৃতজ্ঞ, সে মহৎ, অন্তত আমার থেকে মহৎ এ আমি বুঝেছি। সে তার দিকে ছুটে যেতে চায়। তার মনে হয় সেই মহতের আলোর মধ্যে তার বুকের মধ্যে আটকা ছটপট করা ডানাদুটোকে সে স্বাধীনতা দেবে। সে যত এগোয় সেই আলোকপ্রাপ্ত মানুষ তার থেকে আরো দূরে সরে সরে যায়, তার ডানার ব্যথা আরো বাড়ে। হঠাৎ শুনতে পায় কেউ যেন বলছে, যে আলোকে খুঁজছ সে আলোর সমুদ্র তোমার ভিতরে। যা জানছ, যাকে জানছ, সে তোমার উদ্দেশ্য নয়, যার মাধ্যমে জানছ, সেই তোমার উদ্দেশ্য। তোমার সংশয়কে যে জানে তাকে প্রশ্ন করো, কে তুমি যে আমার সংশয়কে জানো? যতদিন উত্তর পাবে, ততদিন জেনো সব মিথ্যা। যেদিন কোনো উত্তর পাবে না, সেদিন জেনো আসল উত্তর পেলে।

       কিন্তু এতো হেঁয়ালি।

       আসলেই তাই। কারণ তুমি নিজের কাছে নিজেও এক হেঁয়ালি নও কি? বিশ্বজনীন সূত্রকে পাওয়া বাস্তব। আর বিশ্বজনীন সত্যকে পাওয়ার তাগিদ হল ধর্ম। নানা মতের সংস্কারগত অভ্যাস না। সে কুয়াশা।

       শুরুতেই এই কথাটাই বলেছিলাম, এই আলোর দিকে যে তীর্থযাত্রার কথা তারা ভারতের মাটিতে চেয়েছিলেন, তা হল না। কারণ জীবনটা তীর্থ না, আমোদ। চেতনাপরতা না, আত্মপরতা। আলোর থেকে ছায়ায় সুখ অনেক বেশি। জাগার থেকে যেমন ঘুমে। তাই ভুল ভিত স্থাপনের উৎসবই হোক, আসল ভিত খুঁড়তে কে যাবে?