মানুষের নিজেকে দুঃখ-শোক থেকে বাঁচানোর ক্ষমতা আছে। কিন্তু দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচার ক্ষমতা নেই। দুশ্চিন্তার সাগরে উদ্বেগের ঢেউ। সে সামাল দিতে দিতে আত্মশক্তির অনর্থক অপচয়। অতিষ্ঠ জীবন। এর থেকে ত্রাণের রাস্তা নেই। কারণ এ আমারই সৃষ্টি। সৃষ্টি? না, তা হয় কি করে। সৃষ্টির সঙ্গে একটা আত্মনিয়ন্ত্রণ আর সংযম শব্দের যোগ থাকে। কিন্তু দুশ্চিন্তার অভ্যাসের সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই। সে অনিয়ন্ত্রিত, অসংযত, এবং সর্বোপরি অবাস্তব।
দুশ্চিন্তার বড় যুক্তি হচ্ছে সে নাকি সাম্ভাব্য বাস্তবতাকে আগাম কল্পনা করে নিতে পারে। তার সমান্তরাল বাস্তবতা তৈরি করার ক্ষমতা। তার সে ক্ষমতার পাল্লায় পড়ে ইমোশনাল আমি, আর র্যাশেনাল আমি দুই-ই কুপোকাত তখন। দুশ্চিন্তা তো আর যাবে বলে আসে না। সে জ্বালাবে বলেই আসে।
সাপ নিজের বিষে মরে না। মাকড়সা নিজের জালে আটকায় না। কিন্তু মানুষ নিজের বিষে নিজেই মরে। তার দুশ্চিন্তার বিষ। তিলে তিলে মারে। “চিন্তা চিতা সমান”। কিন্তু এ চিতা বৈদ্যুতিকও না, কাষ্ঠলও না। এ চিতা ধিকিধিকি।
এ বিষ মহাবিষ। কেউ কম আক্রান্ত। কেউ বেশি। কেউ অতিরক্তি বেশি। এ মহাবিষ আছে বলেই মানুষ অমৃতের পরিচয় পেয়েছে। সে অমৃত হল শান্তি। সে জিনিসটা যতক্ষণ আছে টের পাওয়া যায় না। চলে গেলে টের পাওয়া যায়। সংসারে যত মাধুর্য, যত আনন্দ, যত মঙ্গল সব এই এককে ভিত্তি করে, তা অবশ্যই - শান্তি।
শান্তিই অমৃত। শান্তিই সঞ্জীবনী। শান্তিই আনন্দ। শান্তিই সত্য আর মঙ্গলের মূল। কিন্তু শান্তি জীবনের উদ্দেশ্য নয়। শান্তি জীবনের উপায়। গোলমালটা হয় এইখানে। আমরা শান্তি চাই। শান্তি চাওয়া যায় না। শান্তি আশীর্বাদ। শান্তি কৃপা। সে পাওয়ার যোগ্য করে তুলতে হয় নিজেকে। যেমন বুকের খাঁচাটা নিজেকে বাইরের বাতাস থেকে অক্সিজেন নেওয়ার যোগ্য করে তৈরি করে, তেমন। শান্তি উপায়। শান্তি পথ। শান্তি উদ্দেশ্য হতে পারে না।
বুদ্ধের একটা অমোঘ বাণী আছে ধম্মপদের শুরুতেই। সেটা হল -
মনই শ্রেষ্ঠ। যদি কেউ দূষিত অন্তঃকরণে কথা বলে বা কোনো কাজ করে, তবে গরুর গাড়ির চাকা যেমন গরুর পদচিহ্ন অনুসরণ করে, তেমন দুঃখও তাকে অনুসরণ করে। (ধম্মপদ)
আমি অপমানিত, আমি তিরস্কৃত, আমি লুণ্ঠিত-বঞ্চিত - দিনরাত যে এ চিন্তায় অতিবাহিত করে তার বৈরভাব, রাগ কখনও শান্ত হয় না। (ধম্মপদ)
এ বাণী পীযূষ। অমৃত শরীরের আকাঙ্খা নয়। শরীরের আকাঙ্খা সুখ। অমৃত চিত্তের আকাঙ্খা। সে অমৃত হল শান্তিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। তারপর তাকে যে নামেই ডাকি না কেন। শান্তিতে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে শান্তির রাস্তাতেই হাঁটতে হবে। যতবার শান্তি আর সুখের দ্বন্দ্ব সামনে আসবে, “সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো” এই কথা মনে রেখে শান্তিকেই বেছে নিতে হবে। খ্রীষ্ট বলছেন, সেই ধন্য যে শান্তিপ্রতিষ্ঠাতা, তাকে ঈশ্বরের সন্তান বলে আখ্যায়িত করা হবে।
সংসারে শান্তি নেই তা নয়। নিজেকে শান্তির যোগ্য করে তুলিনি “লোভে আর ভয়ে লাজে” এই হল কথা।