সেদিন কি ছিল না তবে? পণ্ডিত ছিলেন, তত্ত্ব ছিল, টোল ছিল, জ্ঞানী-গুণী সব ছিলেন, কি ছিল না? ছিল না অনুভব। সব কিছু ছিল শুষ্ক। প্রাণে শান্তি নেই, বোধে নিশ্চয়তা নেই। মানুষ দিশাহীন। রাস্তা আছে, কিন্তু গন্তব্য নেই। জীবনে সব কিছু যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে, মালা করে গেঁথে নেওয়ার সুতো নেই। মানুষ ব্যর্থতা মেনে নিতে পারে, কিন্তু অগৌরব মানতে পারে না। এক একটা যুগ আসে যদিও, যখন মানুষ কোনোদিকেই নিজের গৌরবের পথ খুঁজে পায় না। সব দিকে সে নিজেকে দীন, হীন করে তোলে লোভে, ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে। এক বিষাক্ত পরিবেশ তিল তিল করে অন্ধকার করে দেয় চেতনা, শুভবুদ্ধি আসার পথ। শোষণ-পীড়ন সহস্র ফণা দিয়ে গ্রাস করে মনুষ্যত্ত্বের সবটুকু রস, মানুষকে বিশ্বাস করাতে বাধ্য করে, সে আসলে নীচ, স্বার্থপর একটা জীব। শুধুই আহার-নিদ্রা-মৈথুনেই তার জীবনের পরমার্থতা। ভোগই একমাত্র পুরুষার্থ। যা কিছু মহান, যা কিছু নিঃস্বার্থ, যা কিছু দিব্য - তাই মিথ্যা, অলীক। খুব অন্ধকারে যখন হাতড়ে হাতড়ে কোনো জিনিস খুঁজি, তখন যাই হাতে বাধে তাকেই ভয়ংকর অথবা মনমুগ্ধকর কিছু একটা কল্পনা করে হয় ত্রস্ত্র হই, নয়তো মোহগ্রস্থ হই। দুই-ই বিনাশক।
সেই সময় জন্মালেন বাংলার ঘরে নিমাই পণ্ডিত। নিমাই পণ্ডিত দাম্ভিক, জ্ঞানচূড়ামণি। কিন্তু তাতে তো যুগপ্রয়োজন সমাধা হবে না। আগেই বললাম, সেই রকম পণ্ডিত, জ্ঞানী, নৈয়ায়িকের তো অভাব ছিল না দেশে। তারাই তো ছিলেন সমাজের মাথা। নিমাই পণ্ডিত গয়া থেকে ফিরলেন শ্রীচৈতন্য হয়ে। অন্ধকার ঘরে যেমন 'অন্ধকার অন্ধকার' বলে চেঁচালে কিছু হয় না, আলো আনতে হয়, ঠিক তেমনই শ্রীচৈতন্য হলেন সেই আলো। তিনি নিজে কি জানলেন তা? বোধহয় না। তাঁর বুকে তখন অসীম যন্ত্রণা। পরমসত্যের আভাস পাচ্ছেন, কিন্তু ধরা যাচ্ছে না। চৈতন্যভাগবতে চমৎকার বর্ণনা আছে সে সবের। তিনি টোলে পড়াতে এসেছেন, কিন্তু কিছুতেই পড়ানো আর হয়ে উঠছে না। তিনি আত্মমগ্ন হয়ে ছাত্রদের কৃষ্ণোপদেশ করছেন। মানব জীবনকে সার্থক করার আহ্বান করছেন। কোথায় ব্যকরণ, কোথায় নীতিমালা। সব ভেসে যাচ্ছে। তারপর যখন হুঁশ হচ্ছে, লজ্জিত হয়ে জিজ্ঞাসা করছেন, কি বললাম আমি! ততক্ষণে ছাত্ররাও প্রেমে বিহ্বল, আবেশিত। তারা বললেন, আপনি এতক্ষণ আমাদের কৃষ্ণোপদেশ করছিলেন। বলছিলেন জীবনের কোনো স্থায়িত্ব নেই, নিশ্চয়তা নেই, তাই আমরা যেন যত সত্ত্বর কৃষ্ণে মন আনয়ন করি।
"আজি আমি কেমত সে সূত্র বাখানিলু?”
পড়ুয়া সকলে বলে, - "কিছু না বুঝিলু।।
যত কিছু শব্দে বাখানহ 'কৃষ্ণ' মাত্র
বুঝিতে তোমার ব্যাখ্যা কে বা আছে পাত্র?”
তিনি তো শুধু শ্রীচৈতন্য নন। চেতনা থাকলেই তো হবে না। চেতনার গতিশক্তি হলেন গুরু - প্রভু। এইক্ষেত্রে - মহাপ্রভু। তিনি মাকে বলছেন, -
"চণ্ডাল 'চণ্ডাল' নহে, - যদি 'কৃষ্ণ' বলে।
বিপ্র 'বিপ্র' নহে, - যদি অসৎ পথে চলে।।
আরো বলছেন, -
ভক্তিহীন-কর্মে কোনো ফল নাহি পায়
সেই কর্ম ভক্তিহীন, - পরহিংসা যা'য়।।
(চৈতন্যভাগবত)
এই জন্ম হল মহাপ্রভুর। ক্রমশঃ টোল গেল। বিশ্বসংসারের গুরুকে কি আর ওই ছোট্ট টোলে ধরে? নদীয়া ক্রমশঃ উত্তাল হয়ে উঠল প্রেমে। রাজশক্তি বাধা হয়ে দাঁড়াল। মানব প্রেমের পথ রুখে দাঁড়াবে কোন শক্তি। মহাপ্রভু বেরোলেন নগর সংকীর্তনে। বর্ণনা আছে, সেদিন নাকি সারা গ্রাম সুসজ্জিত হয়েছিল দীপে, মালায়, আলপনায়। সন্ধ্যায় শুরু হল নগর সংকীর্তন। কঠিন পথ কিছু নয়। ডাকার পথ। কোনো মহাপুরুষের প্রাণে পরমসত্য সংজ্ঞায়িত না, তা প্রেমায়িত। তাই যখন মহাপ্রভুর ডাকে কৃষ্ণনাম আসে, সে ভেদসূচক নয়, তা প্রেমসূচক। সেখানে বাক্য অথবা শব্দবন্ধ কথা বলে না, কথা বলে প্রাণের গভীর আবেগ, যা শুদ্ধ, নির্মল, অসূয়াশূন্য, পরম করুণ, স্বার্থগন্ধশূন্য। সে ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকা যায় না। সাড়া দিতেই হয়। বলা হয়, নগরের যারা চোর ছিল, তারা সেই সন্ধ্যের সুযোগকে কাজে লাগাবে বলে নাকি ষড়যন্ত্র করেছিল। একজন তাদের মধ্যে বলে, "এরা তো সারাটা রাত এই করবে, চল না প্রথম প্রহরটা মজা দেখে নিই, পরের প্রহর থেকে কাজে লাগলে হবে।"
তাই কি হয়! তাদের সমস্ত কুপ্রবৃত্তি সে পরমকরুণ মুখারবিন্দে পড়ার সাথে সাথে লুপ্ত হয়ে গেল। কখন ভোর হল তারা টের পেলে না। শুধু দেখল, সারা রাত সেই অপরূপ সুন্দর মানুষটার পিছনে পিছনে কৃষ্ণনাম গেয়ে গেয়ে ভোর হয়ে গেল; তাদের গণ্ডদেশ, বুক ভেসে গেছে তাদেরই চোখের জলে। এত জল কোথায় ছিল? ছিল ছিল, মানুষের গভীরে কত কান্না থাকে! কত অনুশোচনা, কত পাপের অসহনীয় জ্বালা, বলবে কোথায়? কার কাছে? হয় ব্যঙ্গ করবে, নয় তো ধিক্কার দিয়ে সমাজের বাইরে নিক্ষেপ করবে, অচ্ছুত করে রাখবে। মানুষ কাঁদবে কার পায়ে? কার করুণায় শুদ্ধ হয়ে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে? এত পাপের গ্লানি থেকে মুক্ত করবে কে? তাকে কাঁদিয়ে শুদ্ধ করবে কে? যীশু বলছেন, 'আমি যদি তোমাদের দোষী করার জন্য আসতাম, তবে কেউই আমার পিতার রাজ্যে প্রবেশের অধিকার পেতে না। আমি সে জন্য আসিনি। পিতা আমায় পাঠিয়েছেন তোমাদের দোষ ক্ষমা করার জন্য। বিশ্বাস করো। আমিই সেই ভাল রাখাল যে তার ভেড়াগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে পারে। আমিই সেই খোঁয়াড়ের দরজা।"
মানুষকে এমন সুন্দর সাজিয়েছে কেউ আগে? তার কপালে চন্দন, গলায় মালা, তার সারা অঙ্গ সুবাসিত চন্দনে। সে যে ডাকতে এসেছে। সে যে ভালোবাসতে এসেছে। কি ভাবে ডাকবে? ওই দেখো, ঊর্দ্ধবাহু, গৌরবর্ণ, দু'চোখে করুণাকাতর অশ্রু, তিনি নীলাচলের তীর বেয়ে ছুটে চলেছেন, নিনাদিত কণ্ঠস্বরে বাজছে -
কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব পাহি মাম পাহি মাম
রাম রাঘব রাম রাঘব রাম রাঘব রক্ষ মাম রক্ষ মাম
ওই শোনো তিনি গাইছেন, -
হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলম
কলৌ নাস্তেব্য নাস্তেব্য নাস্তেব্য গতির্ন্যথা
শুনেছো মহামন্ত্র?
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে
মন আর কবে রাজী হবে? পেলে তো ভিক্ষা। পাত্র নেই? সে পাত্রও দিচ্ছেন মহাপ্রভু, শোনো-
তৃণাদপি সুনীচেন, তরোরিব সহিষ্ণুনা
অমানিন মানদেন কীর্তনীয় সদা হরি
উত্তম হঞা আপনাকে মানে তৃণাধম।
দুই প্রকারে সহিষ্ণুতা করে বৃক্ষসম।।
বৃক্ষে যেমন কাটিলেও কিছু না বোলয়।
শুকাইয়া মৈলে কারে পানী না মাগয়।।
সেই যে মাগয়ে তারে দেয় আপন ধন।
ঘর্ম বৃষ্টি সহে করে আনের রক্ষণ।।
উত্তম হইয়া বৈষ্ণব হবে নিরভিমান।
জীব সম্মান দিবে জানি কৃষ্ণ অধিষ্ঠান।।
এই মত হঞা যেই কৃষ্ণ নাম লয়।
শ্রীকৃষ্ণ চরণে তার প্রেম উপজয়।।
(চৈতন্যচরিতামৃত)
[আজ শ্রীশ্রীমহাপ্রভুর পূণ্য জন্মতিথি]