মতুয়া শব্দটা আমি প্রথম শুনি ‘শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত’ তে। মতুয়ার বুদ্ধি - রামকৃষ্ণদেবের ভাষায়। সে মতুয়ার বুদ্ধি মানে কি? নিজের মত সম্বন্ধে অন্ধবিশ্বাস। অবশ্যই রামকৃষ্ণদেব যতবার মতুয়া শব্দটা উচ্চারণ করছেন, ততবারই নিন্দাত্মক ভাবেই উচ্চারিত হচ্ছে। ফলে আমার ধারণা জন্মেছিল খুব সঙ্কীর্ণ অন্ধবিশ্বাসী কোনো সম্প্রদায়ের কথা রামকৃষ্ণদেব নিশ্চয় বলছেন।
এরপর গত কয়েক বছর ধরে শুরু হল রাজনৈতিক মহলে মতুয়াদের নিয়ে চর্চা। আগ্রহ বাড়ল। হঠাৎ মতুয়ারা এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কেন? পড়তে গিয়ে বিস্মিত হলাম। যা জানতাম তা সম্পূর্ণ ভুল।
আমাদের অধ্যাত্মিক জগত যতই সমস্ত ব্রহ্মময়ত্বের কথা বলুক, আসলে আমাদের ধর্মে, বিশেষ করে হিন্দুধর্মে বর্ণবিভেদের বিষ কতটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে সমাজে ঢুকে আছে, সে নিজের ‘কম্ফোর্ট জোন’ এর বাইরে না গেলে অনুভব করা সম্ভব নয়। অনুমান অভিজ্ঞতা নির্ভর। অভিজ্ঞতা অর্জন করতে গেলে কিছু করতে হবে। না করতে চাইলে বর্ণ বিভেদের তথা কথিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, সুফল ইত্যাদির উপর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রবন্ধ লিখে আত্মতুষ্টির রাস্তা সব সময় খোলাই আছে।
কোনো কিছুই শূন্য থেকে জন্মায় না। ধর্মও না। মানুষ সত্যকে দিনের আলোর মত করে পায় না। আকরিক থেকে ধাতু নিষ্কাশনের মত করে পায়। মানুষ সত্যকে পায় না, অর্জন করতে হয়। তাই মানুষের সমস্ত কল্পনা, আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা, সুখ, দুঃখ, স্বপ্ন, ভয় ইত্যাদিকে সত্য করে ধর্মের উদ্ভব হয়। ঈশ্বর সত্য কিনা সে নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু ঈশ্বরকে খোঁজার জন্য মানুষের মধ্যে যে অসহায়ত্বের বোধ, সে নিয়ে তর্ক চলে না। সে সত্য। বাস্তব।
আধুনিক ভারতে নতুন করে যখন নবজাগরণ হল, নতুন করে ধর্মের সংজ্ঞা খোঁজার চেষ্টা হল বেদ উপনিষদ ঘেঁটে, নতুন অবতারবাদের সূচনা হল, তখন আমরা খেয়াল করলাম না সমাজের একটা বড় অংশ এই তত্ত্ব থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিন তাতে আমাদের কিছু যায় আসেনি, কারণ তারা চিরটাকালই বাদের খাতাতেই থাকত। তাই নতুন করে কিছু আমাদের অনুভবে আসেনি। সেই কিছুটা অজ্ঞাতে আর সজ্ঞানে উপেক্ষাই জন্ম দিয়েছে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের, আম্বেদকরের, জ্যোতিরাও ফুলের। তাই আশ্চর্য লাগলেও যে রামকৃষ্ণের কথায় ‘মতুয়া’ শব্দটা উঠে আসছে, সেখানে বিবেকানন্দের লেখায়, ভাষণে ‘শূদ্রজাগরণ’ ইত্যাদি কথা এলেও, একবারও হরিচাঁদের উল্লেখ সসম্ভ্রমে আসছে না। না তো রবীন্দ্রনাথের কোনো লেখায়। অন্তত আমি পড়িনি। আমাদের ইতিহাসেও এই নামটা কি সচেতনভাবে চেপে যাওয়া হয়েছে, যে সমাজসংস্কারকদের নাম উচ্চারণের সময় রামমোহন রায়, বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগর প্রমুখের নামের সঙ্গে সঙ্গে একবারটিও হরিচাঁদ ঠাকুরের নাম উচ্চারিত হয় না। অথচ যে মানুষটা বাল্য বিবাহ রোধের প্রচার করছেন, শিক্ষা বিস্তারের কথা বলছেন, নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলছেন, জাতপাতের বিরুদ্ধে বলছেন, দীক্ষা-তীর্থভ্রমণ নানা বাহ্যিক আচারসর্বস্ব ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে বলছেন, যিনি সহজ শিক্ষা দিচ্ছেন, “জীবে দয়া, নামে রুচি আর মানুষে নিষ্ঠা/ ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা”। কথা হল, “হাতে কাম, মুখে নাম”।
হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্ম ১৮১২ সালের ১১ই মার্চ আধুনিক বাংলাদেশে, মৃত্যু ১৮৭৮ সালের ৫ই মার্চ। জন্ম বৈষ্ণব পরিবারে। হরিচাঁদের মধ্যে মহাপ্রভু প্রচারিত বৈষ্ণব ধর্মের মানবতাবাদ ঢুকল, কিন্তু ততদিনে বৈষ্ণব ধর্মে যে সঙ্কীর্ণ শুচিবাইতা, আচারসর্বস্বতা ঢুকে পড়েছে, সেটাকে তিনি বাদ দিলেন। জোর দিলেন শিক্ষা, চরিত্র গঠনে আর সরল মনে দীক্ষানুগামী না হয়ে ‘হরিবোল, নামকে সর্বস্ব করে মেতে থাকতে। যদিও সে শিক্ষা পেতে নাভিশ্বাস উঠেছিল সেদিনের সমাজে নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষের। কে দেবে তাদের বিদ্যালয়ে, টোলে জায়গা? সে নিয়ে পরবর্তীকালে বড়সড় আন্দোলন হয়েছিল গুরুচাঁদের তত্ত্বাবধানে, কিন্তু সে অন্য ইতিহাস।
হরিচাঁদের শিক্ষায় চরিত্র গঠন মানে কি? “পবিত্রতা, সত্যবাক্য, মানুষের বিশ্বাস/ তিন রত্ন যার আছে হরি তার বশ”। আরো আছে, “যত যত তীর্থ আছে অবনী পরে/ সত্যবাক্য সমকক্ষ হইতে না পারে”।
ঠাকুর তবে কে? “যে যাহারে ভক্তি করে সেই তার ঈশ্বর।”...”যে যাহারে উদ্ধার করে, সেই তার ঈশ্বর”। শেষের কথাটা ভেবে দেখলে বোঝা যাবে কেন মহারাষ্ট্রে বুদ্ধের জায়গায় ক্রমে আম্বেদকর প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। যে অত্যাচারিত হয় সেই জানে “উদ্ধার” শব্দটা মানে কি। যে অত্যাচার করে, সে জানবে কি করে? সে নিজেকে নিজের অধিকারকে চরিতার্থ করেছে এই জানে।
হরিচাঁদ ঠাকুরের দ্বাদশ আজ্ঞা ছিল।
১. সদা সত্য কথা বলবে;
২. পিতা-মাতাকে দেবতাজ্ঞানে ভক্তি করবে;
৩. নারীকে মাতৃজ্ঞান করবে;
৪. জগৎকে ভালোবাসবে;
৫. সকল ধর্মের প্রতি উদার থাকবে;
৬. জাতিভেদ করবে না;
৭. হরিমন্দির প্রতিষ্ঠা করবে;
৮. প্রত্যহ প্রার্থনা করবে;
৯. ঈশ্বরে আত্মদান করবে;
১০. বহিরঙ্গে সাধু সাজবে না;
১১. ষড়রিপু বশে রাখবে এবং
১২. হাতে কাম ও মুখে নাম করবে।।
মজার কথা হল এই দ্বাদশ আজ্ঞার পঞ্চম আজ্ঞায় কোথাতেও বলা হচ্ছে না যে অন্য ধর্মকে অসম্মান করবে। তবে মতুয়া কেন ব্রাত্য হল তথাকথিত ‘ভদ্রলোক’ এর ধর্মে? কারণ হরিচাঁদ ঠাকুর বেদের অথোরিটিকে অস্বীকার করলেন, ব্রাহ্মণ্যবাদকে অস্বীকার করলেন। এতেই গোল বাধল।
তবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল কেন পরবর্তীকালে, মানে গুরুচাঁদের সময়ে। এখানে বুঝতে হবে, আম্বেদকরের আন্দোলনের ধারাকে। আম্বেদকর গান্ধী তথা গোটা স্বাধীনতা আন্দোলনকে উচ্চ সম্প্রদায়ের আন্দোলন হিসাবে দেখেছিলেন। গুরুচাঁদের মতও তাই ছিল। সমাজে তারা এতটাই ব্রাত্য, পীড়িত শোষিত ছিল যে বাইরের শত্রু আর ঘরের শত্রু আলাদা করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। বরং মতুয়ার শিক্ষা বিস্তারে ইংরেজ মিশনারীরাই এগিয়ে এসেছিল এমন তথ্যও আছে। গুরুচাঁদের পর মতুয়ার মধ্যে ভাগ দেখা যায়, রাজনীতি, বঙ্গভঙ্গ ইত্যাদি নানাভাবে সে আন্দোলন বিভ্রান্ত হয়, এও সত্য। তবে দোষ শুধু যে সেদিকের ছিল তাই নয়, আমাদেরও কম ছিল না। আজও আমাদের আচরণ সে প্রমাণ দেয়। আমাদের এই উদাসীনতা। আমাদের এই ‘ভদ্রলোক’ এর মুখোশ, আমাদের সমাজের তলায় যে কি পচন ধরিয়ে চলেছে, সে হিসাব কে রাখে? তাদের ক্ষোভ, অপমানের হিসাবের কিছু খবর দেবেশ রায়ের সাহিত্য দিয়েছে, কিন্তু সেকি খুব যথেষ্ট? “নীচ হয়ে করিব যে নীচের উদ্ধার, অতি নিম্নে না নামিলে কিসের অবতার?” এই যদি অবতার বিচারের পরাকাষ্ঠা হয়ে থাকে তবে আধুনিক ভারতের অনেক অবতারই তাদের অবতারত্ব হারাবেন, যারা ভদ্রলোকের গণ্ডীর বাইরে পা না রেখে আধ্যাত্মিক নানা বিলাসিতায় দিন কাটিয়েছেন। যতই “যেথায় থাকে সবার অধম সবার অধীন” গানে বাজুক না কেন, সেই “সবার নীচে, সবার পিছে, সব হারাদের মাঝে” সত্য অর্থে দাঁড়িয়েছিলেন যে হরিচাঁদ ঠাকুর, আজ তাঁকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই। ক্ষমা চাই। আরো অনেক অনেক কথা লেখা বাকি হয়ে থাকল। সে লেখা টুকরো টুকরো হয়ে আমার “গোঁসাই”তে ফুটে উঠুক, এই প্রার্থনা। আমাদের যুগ যুগ ধরে এত উপেক্ষা, অপমানের বিপরীতে আজ যে তাদের মাদল, কাঁসা, ডঙ্কা, শিঙা তীব্র স্বরে বেজে ওঠে, আজ যে মত্ততায় “হরিবোল” ধ্বনি বেজে ওঠে, মনে রাখতে হবে, সে ওদের মত করে প্রতিবাদের ভাষা। সে আমাদের ‘ভদ্রলোক’ এর কানে কর্কশ শোনালেও, তাদের আচরণ আমাদের মত ‘ভদ্রলোক’ এর চোখে ‘লাউড’ লাগলেও, সে সত্য। কিন্তু সে সত্যকে উপলব্ধি করতে গেলে তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। কৌতূহলী হয়ে নয়, আত্মীয় হয়ে।