Skip to main content
 
 
       যিনি পশুকে শাসন করেন তিনি পশুপতি। শিব। তিনি মঙ্গল। সে মঙ্গলের সাধন নেই। যে পশুর কথা শুনলাম সে পশু প্রাণিবিদ্যার কোনো শাখায় নেই। কিন্তু সে পশুর ডাক শোনা যায়। ভীষণ তার আচরণের সাক্ষীও হওয়া যায়। 
       ভূত প্রেত সব শোনা যায় সে পাড়ায় বশীভূত। সেই ভূত-প্রেতরূপী নানা বিকার, পশুরূপী নানা অতি-ইচ্ছার যিনি হালধারক, তিনি শিব, মঙ্গলস্বরূপ। মঙ্গল তবে কি? মঙ্গল হল সংঘর্ষ, দ্বন্দ্বপরায়ণ নানা বিরুদ্ধ ইচ্ছার সিদ্ধান্ত। সচেতন সিদ্ধান্ত। কল্যাণকে আবাহন জানানো। যে কল্যাণ বাইরে কোথাও নেই। ওই দ্বন্দ্বের মধ্যেই স্থিত। এই গ্রহ-তারা-নক্ষত্র, অণু-পরমাণু যে প্রবল শক্তির ধারক বাহক হয়েও যে সংহতি সৃষ্টি করেছে সেই সংহতি, তিনিই শিব। "নৃত্যের বশে সুন্দর হল বিদ্রোহী পরমাণু, / পদযুগ ঘিরে জ্যোতিমঞ্জীরে সাজিল চন্দ্র ভানু"। ব্যক্তিজীবনে সেই সামঞ্জস্যই শিব। সমাজ জীবনে বৈচিত্রের সাম্যাবস্থানই শিব। 
       "সকল দ্বন্দ্ববিরোধ -- মাঝে জাগ্রত যে ভালো / সেই তো তোমার ভালো"। 
       তবে আমার মধ্যে প্রতি মুহূর্তে যে বিরোধ? আজ চতুর্দিকে যে এত বিরোধ, এত হিংসা, এত হানাহানি, এর মধ্যে মঙ্গল কোথায়? ক্ষীণ আশাও তো দেখছি না। এই চরম অন্ধকারের মধ্যেই তাই হয়ত আহ্বান শিবের। অসুন্দর, বিষ, পশু, ভূতপ্রেত - মধ্যে শিব। কল্যাণ। মঙ্গল। মঙ্গলকে খুঁজতে ওই বিষ, ওই পাশবিকতা, ওই অসুন্দর - ওরই মধ্যে খুঁজে বার করতে হবে। তবে মুক্তি। তবে কল্যাণ। তবে শান্তি।
 
       প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশে মানুষ যায় পর্যটক হয়ে। কিন্তু তার সেই বাইরের নৈসর্গলোকের নেশা কাটতে কতক্ষণ? তার পর্যটকের বেশ আর কদ্দিনের? ফিরে এসে তার সঞ্চিত মধু মুহূর্তেই যায় শুকিয়ে। সে আবার রুক্ষ হতে শুরু করে। রূঢ় হয়ে ওঠে। তার মধ্যের মাধুর্যের গভীর আকুতি চারদিকের বদ্ধ দেওয়ালে মাথা কুটে মরে। তখনই তার মনে করার সময়, বাইরে নয়, স্বর্গীয় নৈসর্গিক মাধুর্যে নয়, প্রতিদিনের এই আটপৌরে সংসারেই মঙ্গলকে জাগাতে হবে।
       রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের কথা বলে বলেন, শান্তং শিবম অদ্বৈতম। আমি যখন শান্ত হই তখনই পাই শিবকে, মঙ্গলকে। সেই মঙ্গলের মধ্যেই আমার বিরোধ ঘুচতে থাকে। আমার অশান্তি মরতে থাকে। আমি আমার চিত্তের মাধুর্যে ডুবি। বলি, আহা বাঁচলাম। যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে কিসের থেকে বাঁচলে, কার থেকে বাঁচলে? কি বলি? বলি নিজের ভিতরে নিজের হাত থেকে বাঁচলাম। 
       এই শান্তির সুখটা পাব বলে কোথায় কোথায় না দৌড়াই, নিজেকে মিথ্যা আর নানারকম প্রবোধে ভুলিয়ে ভুলিয়ে দু'কিলোমিটারের রাস্তা দুশো কিলোমিটার ছুটিয়ে মারি। কিছুতেই হার স্বীকার করি না। মাথা নীচু করি না। অন্তরের সেই শান্তিময় সত্তা আমার রকম সকম দেখে হাসে। আমি আরো রেগে যাই। ভাবি সে মিথ্যা। বাইরে এত আয়োজন, এত সুখের প্রতিশ্রুতি, তুমি কে? চির বৈরাগী তুমি, কাঙাল তুমি। তোমার সাথে আমার কি মিল? তুমি যাও, তুমি যাও, তুমি যাও।
       তারপর কি হয়? তাই হয়, সবার সাথে যা হয়, কারোর আগে, কারোর পরে। বাইরের আলো একটা একটা করে নেভে, বাইরের সুখের প্রতিশ্রুতিগুলো একটা একটা করে অর্থহীন হয়ে পড়ে। বাইরের জৌলুস যত কমে, ভিতরের সে চিরকালের বৈরাগীর রঙ তত উজ্জ্বল হতে শুরু করে। তার মুখের উদাসীন জ্ঞানতৃপ্ত হাসিতে মন জুড়াতে শুরু করে। ক্রমে শান্ত হতে শুরু করি। বুঝতে শুরু করি, আমিই এই বিশ্বাসংসারের খেলায় একমাত্র খেলোয়াড় নই, আমার আগে অগুনতি খেলোয়াড় এসেছে, আমার পরেও বহু'র আসার প্রতীক্ষা। খেলা চলবেই। নানা দ্বন্দ্বে বিরোধের মধ্যে সেই কল্যাণময়কে মানুষ খুঁজে বার করবেই। এর অন্যথা কোনো যুগে হবে না। হতে পারে না। আমার অহং-এর উৎপীড়ন জ্বালা জুড়াতে শুরু করে। এই বিপুল বিশ্বে তখন আমার একটা ছেঁড়া চট জুটলেই নিজেকে ধন্য মনে করি। সেই চটের উপর প্রাণের অফুরান আনন্দকে সাথে নিয়ে বসি। সবার খেলা দেখি। আনন্দে মন মত্ত হয়ে বলে, এত কাছেই ছিল এতবড় আনন্দের খনি? দেখিনি কেন? কে চাপা দিয়ে রেখেছিল? নিজেই বুঝি, সে আমি আমি আমি, সেই ছেঁড়া চটের থেকে দূরে ছোটা আমি।
 
শান্তি শান্তি শান্তি।