সৌরভ ভট্টাচার্য
23 December 2016
প্রেমের জ্বলন্ত বহিঃপ্রকাশ আমার যতদূর মনে পড়ে স্কুলের দেওয়ালেই প্রথম দেখি। আমাদের একদম ছোটবেলায় বাড়িতে বাড়িতে টিভির প্রচলন হয়নি। আর টিভিতে দূরদর্শন ছাড়া চ্যানেলও কিছু আসত না। রবিবারের বাংলা সিনেমা দেখার উৎসাহ দেওয়া হত, কিন্তু হিন্দী সিনেমা সেরকমভাবে বারণ না করা হলেও উৎসাহও দেওয়া হত না। অবশ্যই কিছু বিশেষ বিশেষ সিনেমা ছাড়া।
সুতরাং প্রেম শব্দটা অভিধানের বাইরে শুধু ছিল তাই-ই না, একরকম নিষিদ্ধই ছিল বলা চলে গুরুজনদের সামনে। তো স্কুলের অমুক নামের পাশে তমুকের নাম যোগচিহ্ন দিয়ে লেখা থাকত। ক্লাসরুমে, প্র্যাক্টিকাল রুমে, বাথরুমের দেওয়ালে; তার সাথে নানান আলোচনা তো আছেই। প্রেমের প্রতিশব্দ তখন শুনেছি বড়জোর ‘লাইন মারা’। ‘ঝাড়ি মারা’ ইত্যাদি শব্দ তখন শুনেছি বলে তো মনে হয় না। ঠিক যেমন 'পটি' শব্দটাও আমি অন্তত ছোটবেলায় কোনো বাঙালী পরিবারে শুনিনি, অন্তত মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে তো নয়ই। এই শব্দগুলো অভিধানে স্থান নিশ্চই পাবে, বা হয় তো ইতিমধ্যে পেয়েও গেছে। সে যাক, যেটা বলছিলাম, ‘প্রেম’ বস্তুটার সাথে পরিচয় সেই স্কুলের দেওয়াল থেকে।
সে সব আলোচনাতে যাচ্ছিও না। যেটা বলতে চাইছি সেটা হল, দিন দিন আমার একটা জিনিস গুলিয়ে যাচ্ছে, প্রেম কি ভদ্রতার বিরোধী শব্দ, না পরিপূরক, না অন্যকিছু?
যত চারদিক প্রেমের বহর দেখছি, মনে হয় কোনটা জীবনে বেশি প্রয়োজন - একজন প্রেমিক/প্রেমিকা না একজন ভদ্র বন্ধু? এখন কথা হল ‘ভদ্র’বলতে আমি কি বোঝাতে চাইছি? ‘ভদ্র’ মানে প্রচলিত অর্থে যে ‘ন্যাকা’, ‘ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না’, ‘ভিজে বেড়াল’, ‘মিনমিনে’ ইত্যাদি সমার্থক শব্দ আসে সে অর্থে ভদ্র বলতে চাইছি না। ‘ভদ্র’ অর্থে অভিধান অনুযায়ী যে শব্দগুলো আসে, যেমন ‘শিষ্টাচারসম্পন্ন’, ‘সাধু’ (গেরুয়াধারী না, বদ মতলবরহিত), ‘সজ্জন’ ইত্যাদি সেই কথা বলছি। যিনি, ইংরাজীতে ‘Gentle’ বলতে যা বোঝায় সেরকম, অর্থাৎ ‘Mild and kind in nature or character’.
তো সে অর্থে কাকে আমার বেশি প্রয়োজন জীবনে? বা কোনটা বেশি দরকার - প্রেম না ভদ্রতা? চারদিক দেখে মনে হয়, আগে ভদ্রতাটাই শিখি, তারপর না হয় প্রেমের দিকে এগোনো যাবে। তবে তো পুরো ব্যাপারটা খুব শুকনো রসকষহীন হয়ে পড়বে না? উত্তরে বলি - ঝগড়া, মারামারি, মান-অভিমান ইত্যাদি রোম্যান্টিকতা সম্পর্কে থাকবে না, তা বলছি না। কিন্তু তারও তো একটা মাত্রা থাকে, নাকি? মাত্রা অর্থে নিজের ভুলটা অনুভব করার ক্ষমতা। মুখ থেকে খারাপ কথা বেরোবে না, কি সব চাইতে কাছের মানুষটার সাথে সব সময় মেপে ব্যবহার করে চলতে হবে - এ কখনো সম্ভব না। কিন্তু ভুলটা হয়ে গেলে তাকে অনুভব করার মত মানসিকতা না থাকলে তো বিপদ! ভুল করবার স্বাধীনতা আর ভুলটা বুঝতে পেরে তাকে শুধরে নেওয়ার অথবা শুধরাতে দেওয়ার উদারতা যদি কোনো সম্পর্কে না থাকে তবে তো তা ধ্বংসের দোরগোড়ায়। হয় সে সম্পর্ক স্থবির হয়ে জীবাশ্ম হবে, নয় তো সংঘর্ষের তাপে পুড়ে নিঃশেষ হবে। এর প্রধান শর্তই হল ধৈর্য্য। আর সেই ধৈর্য্যটাও ততক্ষণই রাখা সম্ভব যতক্ষণ সেই মানুষটার ওপর আমার অনুভূতিটা গভীরভাবে জীবিত থাকে। তার মধ্যে একটা অপরিহার্য্যতার বোধ থাকে। প্রেমের মানুষটা optional হলে সে টান জন্মায় না, এটা compulsory হওয়ার ক্ষেত্র।
তবে ভদ্রতাকে আগে রাখতে চাই কেন? কারণ ঠিকভাবে কলম ধরতে না শিখলে যেমন অক্ষর প্রকাশ সঠিক হয় না, আর অক্ষরের প্রকাশ সঠিক না হলে যেমন ভাব প্রকাশ অস্পষ্ট হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা, ঠিক তেমন, যদি নিজেকে নিজে না সংযত রাখতে শিখি তবে সামান্য ঝড়েই তরী ডোবার সম্ভাবনা প্রবল। তাই বলি প্রেমিক অথবা প্রেমিক না পেলেও জীবনে বড়সড় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম, সজ্জন না পেলে প্রাণ যায়!
আলোচনার ধারা কিঞ্চিৎ অন্যদিকে ঘোরাই। আচ্ছা এমনও তো আছে, আসলে সে সজ্জন না কিন্তু বাইরে তার মত ভদ্র মানুষের জুড়ি মেলা ভার? নেই আবার? বিলক্ষণ আছে। আর তারাই তো আছে। ভদ্র অর্থে এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুজনে এসে দাঁড়িয়েছে – এক, যে যাচক অর্থাৎ needy আর দুই, যে দুর্বল। এরা সাত চড়ে রা কাটে না, গালমন্দ করে না ইত্যাদি। কিন্তু চাকা ঘুরতে দাও এদের সাথে শয়তানিতে এঁটে ওঠার লোক পাওয়া ভার হবে। কারণ সে তখন ভাববে আমি যখন মাথা নীচু করেছি সেদিন (অর্থাৎ যাকে সেদিন ভদ্রতা বলা হয়েছিল) আজ সে করুক! তবে সে তো গেল এমনি সামাজিক আলোচনা। প্রেমের সম্পর্কে এর গতি কি তবে?
মুখোশধারী ভদ্রতা চিনব কি করে? খুব সোজা নয় যদিও। তবু চেনা যায়। মুখে গালাগাল করলেই সে অভদ্র, আর যে প্যাঁচের পর প্যাঁচ কষে মিষ্টি কথা বলে, বা বাক্যের ফেরে তিলকে তাল করে ভালোবাসার ট্যাক্স চেয়ে ভদ্রতার সাথে চিমটি কাটে…সে হল গিয়ে ভদ্র, এমন হিসাব হলে বিপদ। যে সত্যিকারের ভালোবাসে তার উদ্দেশ্য কোনোদিন অসাধু হতে পারে না। এই তার সব চাইতে বড় পরীক্ষা- তার নিজের কাছে, তার ভালোবাসার মানুষটার কাছেও। সেই ভদ্রতাটুকু, সৌজন্য বোধটুকু হারিয়ে গেলে শুধু রোম্যান্টিকতায় বেশিদিন সম্পর্কের জোড় টেকে না। তাই বলছিলাম, ভদ্রতাটা বা সজ্জন মানুষের সঙ্গ বোধহয় প্রেমের চাইতে বেশি প্রয়োজন বাঁচতে। আমাদের পরিবারগুলোয় আগে তাই বোধহয় এমন জ্বর জ্বর প্রেমের বাতিক ছিল না । অথবা থাকলেও তার উপদ্রব এত বেশি ছিল না। মানুষ বুঝত ওই আঁচে চড়ানো প্রেমের চাইতে সজ্জন ব্যক্তির সাথে জীবনটা অনেক নিশ্চিত। কারণ ওদিকে আঁচ কমে গেলেই সব ঠাণ্ডা হতে শুরু করবে যে!
নতুন শব্দ দিয়ে শুরু করেছিলাম, আবার নতুন শব্দ দিয়েই শেষ করি। শুধু ভদ্র জীবনসঙ্গী নাকি আজকাল ম্যাড়ম্যাড়ে... জলভাত... পান্তাভাত... পানসে... ইত্যাদি লাগছে। চাটনির মত ভালোবাসা চাই, টকঝালমিষ্টির সম্পর্কের দিকে কি ছুটোছুটি... খোঁজাখুঁজি... ওয়াটস অ্যাপ... ফেসবুক... “অনলাইন আছি... কই তুমি এসো...”
“ও তো শুয়ে পড়েছে...” “ওর কথা ছাড়োতো...” “বাচ্চাটা যেন জানতে না পারে...” “ডিলিট করে দিও... বা পাসওয়ার্ড দিয়ে রেখো... বুঝলে... হাঁদারাম!!!!!!!!”