Skip to main content

   “There is nothing wrong in absorbing the culture of other peoples; only we must enhance, raise and purify the elements we take over, fuse them with the best in our own"
        কথাটা ছিল আগামী দিনের ভারতবর্ষের। রাধাকৃষ্ণান যা ভাবতে চেয়েছিলেন তা হল আগামী ভারতের চিন্তাধারা কেমন হবে তা নিয়ে। তিনি দুই ধরণের ভারতীয়দের কথা বলেছিলেন। এক, যারা গোঁড়া, যারা মনে করেন ভারতীয় ষড়দর্শনে যা লেখা হয়ে গেছে সেগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করলেই ভারতীয় সংস্কৃতি বেঁচে যাবে; আর দুই, সেই ধরণের ভারতীয়েরা যারা মনে করেন ভারতীয় সব চিন্তাধারাই ভিত্তিহীন, সেগুলো থেকে সরে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ পাশ্চাত্যপন্থী হয়ে বাঁচাটাই পথ।
        এই দুই শ্রেণী আমি আজও দেখছি। আমি যদি বেদান্ত'র সমর্থনে কোনো কথা বলেছি, তখন ধরে নেওয়া হচ্ছে আমি সতীদাহ প্রথাও সমর্থন করছি; আবার আমি যখন বেদান্ত'র বিরোধিতা করছি তখন ধরে নেওয়া হচ্ছে ভারতীয় সংস্কৃতিটাই আমার কাছে একটা প্রহসন। এই দুই চিন্তাধারার মধ্যে যে কোনো একটা যোগসূত্র থাকতে পারে সে চিন্তাই অনেক ক্ষেত্রে নেই। আমি একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে আলোচনাটা শুরু করি।
        তখন আমার বয়েস অল্প। রামকৃষ্ণ নামাঙ্কিত একটা প্রতিষ্ঠানে যেতাম। গানের প্রতি বরাবরই ভীষণ ঝোঁক, তো সেখানে কয়েকটা ভক্তিগীতি গেয়ে বেশ সুনাম হচ্ছে, গানের মহড়া দিচ্ছি বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে, মাঝে মাঝে মহারাজ তোষণেও ভাগ নিচ্ছি ইত্যাদি। কিন্তু কোনো একটা জায়গায় খুব খটকা লাগছে। এরা কথামৃত, বিবেকানন্দ রচনাবলী ইত্যাদি পড়ছেন, আলোচনা করছেন --- অথচ যেই না আলোচনাটা শেষ হল অমনি যাবতীয় সঙ্কীর্ণ কূটকচালি, ইত্যাদি আলোচনা এসে পড়ছে মুহূর্ত যেতে না যেতেই, তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে উদারতার ছদ্মবেশে একধরণের গোঁড়ামিও বাসা বাঁধছে যেন কোথাও। কয়েকজন সংসারে ঘা খাওয়া মানুষ একটা অলীক বিশ্বাস নিয়ে বাঁচতে চাইছেন - আত্মা, পরমাত্মা, ব্রহ্ম, সাকার, নিরাকার, মায়া ইত্যাদি কিছু অসম্ভব কথাকে জীবনের পাথেয় করে, কি চূড়ান্ত অবাস্তব জীবনদর্শনের আলোচনা! তার সাথে 'আমরা-ওরা' গল্প তো আছেই। আমার মনে হত তবে কি আমরা একটা গোঁড়ামি ছাড়তে গিয়ে আরেকটা গোঁড়ামির মধ্যে ঢুকতে চাইছি? রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ আবার সেই অথোরিটি হয়ে দাঁড়াচ্ছেন? তাঁদের চিন্তার সাথে না মিললেই তুমি ম্লেচ্ছ? অন্য দলের? একবার একটা অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের 'বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি' গাইলাম। একজন বরিষ্ঠ সদস্য উঠে এসে আমায় বললেন, “এ সব গান অনেক হয়েছে, এবার একটা ভক্তিগীতি গাও"। মনে মনে বললাম, তবে কি এতক্ষণ খেমটা গাইলাম কত্তা? আরেকটা অনুষ্ঠানে, একজন বললেন, 'হরি' নাম তো অনেক হল, এবার রামকৃষ্ণের নাম গাও দেখি।" বললাম, "হরি আর রামকৃষ্ণ কি আলাদা?" বললেন, "হ্যাঁ তো, হরি মানে তো কৃষ্ণ, ও তো বৈষ্ণবদের ঠাকুর।" ক্রমে বুঝলাম আমি একটা অদ্ভুত গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়ছি। এখানে উদারতার নামে আস্তে আস্তে সেই বস্তাপচা শৌখিন মৌলবাদ ঢুকছে। আরো গভীরে গিয়ে জানলাম স্টেজের বক্তৃতা দেওয়া মানুষ আর আশ্রমের নিভৃতে বসা গেরুয়াধারী মানুষটা অনেক ক্ষেত্রেই এক নন। একটা মুখোশ, আরেকটা মুখ। যে মুখটা ততটা সুবিধের নয়। পালিয়ে এলাম সব ছেড়ে। নিজের স্বাধীন চিন্তাধারা জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যের মুখের ঝাল খাওয়া যদি একমাত্র পথ হয়ে থাকে তবে নিতান্ত মুখ্যু থেকেই মরা ভালো। অতঃপর ফেসবুকে বিস্তর গাল খেলাম, আগের সৌরভের সাথে পরের সৌরভের মিল পাওয়া ভার হল, বন্ধু-বিচ্ছেদ হল, বলা হল আমি 'চিপ' পাবলিসিটির জন্য এসব করছি। "নইলে হাঁড়ির খবর যা জেনেছ তা জেনেছ, সেই নিয়ে বাজারে বলার কি দরকার বাপু!, আমরা তো একটা পরিবার, পরিবারের কথা বাইরে কেন?” বোঝো! দলতন্ত্রের বিষ চাপা দিতে চাওয়া হচ্ছে 'পরিবার' নামের বিশুদ্ধ শব্দের আড়ালে। কিন্তু আমার যে স্বভাব খারাপ দাদা, যা সত্য বলে বুঝি তাই ঢাক পিটিয়ে বলি, লুকিয়ে করা এক শৌচাদি ছাড়া আর কিছুই হল না জীবনে।
        এবার এই গোঁড়াদের কথা রাধাকৃষ্ণানের কলমে শুনি। উনি বলছেন, “now reverence for authority has become the imprisonment of human spirit. To question the belief of the scriptures is to question the authority of the great dead. Inquiry and doubt are silenced by the citation of ancient texts, scientific truths are slighted, if they cannot be fitted into the procrustean bed of established belief. Passivity, docility and acquiescene become the primary intellectual virtues.”
        কিন্তু এটাই তো ভারতের অতীত ছিল না। সেখানে তর্ক ছিল, প্রশ্নের অবকাশ ছিল। রামকৃষ্ণ স্বয়ং নিজের কথায় বলেছেন, ল্যাজামুড়ো বাদ দিয়ে নিবি। এখন পাল্টা অপযুক্তি হচ্ছে, তবে কি তুমি রামকৃষ্ণ'র থেকেও জ্ঞানী? আরে তা কেন, একজন বিজ্ঞানী যদি বলে থাকেন যে পৃথিবী ঘুরছে, সূর্য স্থির, তবে আমার বেলায় কি বলা হবে তুমি কিন্তু জেনো উল্টোটাই সত্য, ওসব কথা বিজ্ঞানীর জন্য। যা সত্য তা সবার জন্যেই সত্য, তাই সে সত্য। প্রাচীন ভারতের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলছেন, “The ancient seers desired not to copy but to create. They were ever anxious to win the fresh fields for truth and answer the riddles of experience, which is ever changing and therefore new. The richness of inheritance never served to enslave their mind. We cannot simply copy the solutions of the past, for history never repeats itself. What they did in their generation need not to be done over again.”
        রাধাকৃষ্ণান বলছেন, আমাদের স্কলার বেড়ে গেছে কিন্তু চিন্তাবিদ পাওয়া যাচ্ছে না, সব সেই চর্বিতচর্বণ। কারণ যে ধর্মের কথা আমরা বলছি সেও তো নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়েই এগিয়েছে। তাকে একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে এইটাই তার চরম রূপ বলে যেই মনে করেছি, অমনি চিন্তা স্রোত হারিয়ে শিকল হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেকে তাতে বেঁধে ভাবছি, যাক আমার একটা হিল্লে হয়ে গেল; আর যারা সেই শিকলে বাঁধা পড়ল না, তাদের সেই শিকলে আনার জন্য দরদ আর অভিশাপ একসাথে উথলে দিচ্ছি। দুটোই সব্বোনেশে। রাধাকৃষ্ণান ঠাট্টা করে বলছেন, যদি সেই আড়াই হাজার বছর আগের কোনো ঋষি এসে তোমাদের কাণ্ড-কারখানা আজকের দিনে দেখেন, তিনি তো তাঁর যোগ্য উত্তরসূরীই পাবেন না, সবাই অনুকরণে ব্যস্ত। অতীতের সমস্যায় অতীত বেঁচেছিল। বর্তমানের সমস্যায় সেই প্রাচীন পুঁথি কতটা কাজে আসছে ভালো করে খুঁটিয়ে পড়ে নিজে ভেবে দেখো দিকি কত্তা। তারপর যতটা থাকল নিলে, বাকিটা না হয় ফেলেই দিলে। আজ এই শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে কার মাথা খারাপ হচ্ছে বলো ব্রহ্ম সাকার কি নিরাকার ভেবে? কে ভাবতে যাচ্ছে তুমি ব্রাহ্মণ কি শূদ্র? কে ভাবতে যাচ্ছে আত্মার দর্শন হল না ঈশ্বরের সাক্ষাৎকার হল? আজ আমাদের অন্যান্য নানান সমস্যা। সেগুলোর হাল কি লেখে তোমার বইতে কও দেখি? আছে আছে, ভালো করে পড়ে দেখো, প্রচুর এমন কথা আছে যা কাজে লাগে। শুধু অথোরিটি থেকে বাঁচো। নিজেকে বাঁচাও অন্যকেও রেহাই দাও। গীতা তো তোমার বেদকেও 'যামিমাং পুষ্পিতাং বাচং' বলে ঝেড়ে কাপড় পরিয়েছে; বলেছে, ওসব স্বর্গ-নরক যাওয়ার মতলব ছাড়ো দিকিনি বাপু, মনটাকে স্থির করে এখানেই একটা কিছু করে দেখাও, হুম... স্বামীজি ঠাট্টা করে বলছেন না, বউ-বাচ্চার মুখের ভাত জোগাড় করতে পারো না, তুমি দৌড়াচ্ছ মোক্ষ নিতে।
        এরপর এর বিপরীত পক্ষের কথা হল, ভারতের যা কিছু সব বুজরুকি। এদের কথা হল, “more English than the English themselvs... if India is to thirve and flourish, England (আজকের দিনে আমেরিকা পড়ুন, কারণ বইটা প্রথম ছাপা হয়েছিল ১৯২৩ সালে) must be her ‘spiritual mother’ and Greece her ‘spiritual grandmother’."
        রাধাকৃষ্ণান শেষ করছেন আশার বাণী দিয়ে। বলছেন, এই রক্ষণশীল আর আমূল সংস্কারক --- দু'জনকেই মুখোমুখি হতে হবে, নিজেদেরকে বুঝতে হবে। রাধাকৃষ্ণান নাম উল্লেখ করে বলছেন, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা, অরবিন্দ'র লেখা পড়লে একটা ক্ষীণ আভা মিলতে পারে ভারতকে কোন পথে যেতে হবে। বিজ্ঞানের সাথে প্রাচীন প্রজ্ঞাকে মেলাতে হবে।
        আইনস্টাইন তথা আমাদের আবদুল কালাম মহাশয়ের নানা লেখাতেও এর আভাস আছে। কিন্তু প্রজ্ঞার সাথে বিজ্ঞানের মিলনে কেউ অথোরিটির ভূমিকা নেবে না। স্বাধীন চিন্তা আর সদিচ্ছাই থাকবে মূল চালিকাশক্তিতে, তবেই নতুন দিশা পাবে মানুষ।
        আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ এখনও অনেক অনেক বছর আমাদের সামনে আলো ধরে দাঁড়াতে পারে, অমন নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী খুব কম দেশই নিজের ভাষায় এতগুলো দিকে পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছে; আর আমাদের মত খুব কম দেশই তা অগ্রাহ্য করে কয়েকটা গানে-কবিতায় অবহেলার চূড়ান্ত জায়গায় রেখে নিজেকে অন্ধকারের দিকে সগর্বে নিয়ে যাওয়ার দুঃসাহস দেখাতে পেরেছে।