Skip to main content
 
 
        বিশ্বাসঘাতকতা পাপ না অপরাধ জানি না। তবে বিশ্বাসঘাতকতায় বহু মানুষকে মানসিক ভারসাম্য হারাতে নিজের চোখে দেখেছি। খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমার মনে হয়, একটা মানুষকে এর থেকে গভীরে আহত করার বোধহয় আর কোনো উপায় নেই। বিশ্বাস যত গভীর আঘাত তত গুরুতর। যে মাটিতে ভুমিকম্প ঘনঘন হয়, সে মাটিতে নাকি মানুষ কাঠের বাড়ি বানায়। কেন? যাতে কম আঘাত লাগে? যাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয়? হয়ত বা। যে সম্পর্কে একবার বিশ্বাসঘাতকতা ঢুকেছে সে সম্পর্কের পাটাতনে এমন কাঠের বাড়ি, বালির বাড়ি, ক্রমে তাসের ঘর গড়ে তোলা ছাড়া উপায় থাকে না। 
        আমাদের জীবনের দর্শন এমন কি আর বড় তত্ত্বকথার উপর দাঁড়িয়ে থাকে? কয়েকটা ছোটোখাটো বিশ্বাস, আস্থা আর আশ্বাসেই জীবন কেটে যায়। সেই ছোটোখাটো আশা-আকাঙ্ক্ষার তাগিদেই জীবন চলে যায়। তারপর সময়ে অসময়ে, যেখানে সেখানে মৃত্যুর পরিহাস তো আছেই।
        হায় বুদ্ধিহীন মানবহৃদয়! ভ্রান্তি কিছুতেই ঘোচে না, যুক্তিশাস্ত্রের বিধান বহুবিলম্বে মাথায় প্রবেশ করে, প্রবল প্রমাণকেও অবিশ্বাস করিয়া মিথ্যা আশাকে দুই বাহুপাশে বাঁধিয়া বুকের ভিতরে প্রাণপণে জড়াইয়া ধরা যায়, অবশেষে একদিন সমস্ত নাড়ী কাটিয়া হৃদয়ের রক্ত শুষিয়া সে পলায়ন করে, তখন চেতনা হয় এবং দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে পড়িবার জন্য চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠে।
 
        আমি নিজের চোখে যে জীবনটাকে শেষ হয়ে যেতে দেখি উপেক্ষায়, জেদে, তাকে নিয়ে গল্প লেখার কোনো সাহস আমার হল না। যাকে বিয়ে করেছিল সে কালের কবলে গেল বড় তাড়াতাড়ি। বেঁচে থাকার সঞ্চয় বলতে যা কিছু ছিল তাও নিল জ্ঞাতিগুষ্ঠী। সমাজ বলো, নিয়ম-নীতি বলো নিরপেক্ষ তো কেউ হয় না বলো? হয় কি? অতটা ন্যাকা সাজা আর যা হোক একজন গরীবের তো হয় না। কবে কার ভাগ্যে কোন শিঁকে ছিঁড়েছিল তার উপাখ্যানে মন আশা বাঁধবে কতদিন? বাঁধে না। বিধবা, দরিদ্র আর সুশ্রী হলে একটা সমাজে যা যা অনায়াসে ঘটে তা তা সব ঘটেছিল তার সাথে। সে মেনে নিয়েছিল। কিছুটা জৈবিক কারণে আর কিছুটা পরিস্থিতির চাপে। জৈবিক কারণ বলতে নিশ্চই কামের কথা বলছি না, একটা খিদেও তো আছে। 
       মজার কথা হল, তার একটা ঘরের ভাঙা টালির ফাঁক দিয়ে আসা জ্যোৎস্নার ফাঁদে সেও পা দিয়েছিল। কোনো খিদে মেটাতে আসা পুরুষের প্রেমের কামড়কে মধুর লেগেছিল হয়ত কোনো একটা বসন্তের রাতে। নির্মম একাকীত্বের নিষ্ঠুর চাহনি থেকে বাঁচার জন্য। হতেও তো পারে। ভুল জেনেও ভুলের জন্যই বাঁচতে ইচ্ছা করে? সবসময় ঠিকটা করার অবকাশ আমাদের বাংলার মেয়েদের ভাগ্যে বিধাতা আর কতটুকু অবসর দেয়? আর তার মুল্যই বা কত? একদিকের ভুলের পলেস্তারা খসে পড়তে পড়তে আরেকদিকের ভুল কেঁপে ওঠে। তাকে সামাল তো দিতেই হয় না? দিতে হয়। এতবড় সমাজ যে তার প্রতিটা অঙ্গুলিহেলনের হিসাব রাখে গো। পুরুষ হয়ে পুরুষের শাসন ভোলা যায়, মেয়ে হয়ে যায় না। সেখানে ঈশ্বর থেকে বাড়ির পাঁচিল --- সবাই বিধান দেয়। তাকেও দিয়েছিল। সে মাথা পেতে নিয়েওছিল, শুধু সবার অলক্ষে নিজের কুলুঙ্গিতে জমিয়েছিল একটুকরো অবৈধ ভালোবাসা। একপক্ষেরই সে কি জানত না? জানত তো। আমি জানি সে জানত। সে যে লিখে রেখেছিল। অবাক হচ্ছেন না? লিখে রেখেছিল? হ্যাঁ, সে দরিদ্র ছিল, সার্টিফিকেটহীন ছিল, কিন্তু নিরক্ষর তো ছিল না। তাই নিজের কথা নিজের ভাষায় লিখে রেখেছিল। 
        পাঠক বলবেন সে কথা আমি কি করে জানলাম? জানা যায়। 'দরদ' বলে একটা শব্দ আছে। সে বাতাসের থেকেও সুক্ষ্ম। এক হাতের গন্ধ মেখে আরেক হাতে এসে পড়ে। তেমনভাবেই এসে পড়েছিল। ভুল বানানে, ভুল ব্যাকরণে একটা আদ্যন্ত মানুষের কথা পড়েছিলাম, লুকিয়ে। সে জানতে পারেনি। জানলে লজ্জায় মারা যেত। বাহ রে, যেত না? একে পুরুষ, তায় বয়সে ছোটো। তবু হাতে এসে পড়েছিল আমার। একজন বলেছিল, তুমি তো লেখ, এ লেখার মর্ম তুমি বুঝবে। 
        স্পর্ধা! মর্ম বুঝব আমি? সারা গা দগদগে একটা জীবনের মর্ম বুঝব আমি? বুঝিনি। দূর থেকে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনের আঙুল দিয়ে তার জীবনের গাটায় হাত বুলিয়ে দেখার চেষ্টা করে দেখেছি কতটা টাটায়। 
        , আরেকটা কথা তো বলাই হয়নি। তার একটা ছেলেও ছিল। মানে এখনও আছে। তার মৃত স্বামীর সন্তান। সে যখন বুঝল তার প্রেমের শরীরে পোকা লেগেছে, সে পোকা তার রক্ত চুষে তার ছেলের গায়ে হাত বাড়াচ্ছে, সে নির্মম হল। এই প্রথম সে নির্মম হল। বুকের মধ্যে নিজের ধারালো নখ দিয়ে উপড়ে বাইরে নিয়ে এসে মাটি চাপা দিয়ে রাখল তার পোকায় ধরা প্রেমের হৃৎপিণ্ডকে। নিজের উঠোনেই পুঁতল। কতদূর যাবে? কোন শিকারি কুকুর কোথা থেকে খুঁড়ে বার করে পুরোনো রক্তের দাগ বরাবর হাজির হবে, কে বলতে পারে? 
        ছেলেটা বড় হল। দরদী হল না। দারিদ্র্যের সব দায় দিল মাকে। ও হ্যাঁ, এখন সে তো মা। কখন যে এই মাহওয়াটা হয়ে যায় সে নিজেও টের পায়নি আর পাঁচটা মেয়ের মত। কিন্তু তার মধ্যে তবু একটা স্বতন্ত্রতা ছিল। যতবার সে মেরুদণ্ডটাকে সমঝোতার খাতিরে একটু বেঁকাতে গেছে, ততবার সেটা এমন বিচ্ছিরি আওয়াজ করে সোজা দাঁড়িয়েছে, পাড়ার লোকে কি, তার নিজেরই বড্ড কানে বেজেছে। সমাজে বাজার আগেই যেহেতু কানে বেজেছে তাই সে আরো শক্ত হয়েছে আগে থেকেই। সমাজ বিধান দিতে এসে অমন শক্ত, প্রেমে গলে না মেয়েমানুষ সহ্য করবে কি করে? দিয়েছে তাকে একঘরে করে। পুরুষগুলো তাকে ঘৃণার চোখে দেখেছে। যেন ফ্রীজে পচানো সুস্বাদু খাবারের অপচয় মেনে নিচ্ছে উদারতায়, এমন তাদের দেমাক। সে শক্ত চোখে তাকিয়েছে। কড়া জবাব মিষ্টি সুরে দিয়েছে। আসলে সে অক্ষর চিনেছে যে। নিজের মনকে নিজের সামনে সাদা পাতায় অক্ষরে বাঁধা দেখতে শিখেছে যে। তাকে বাঁধবে কি করে বলো? 
        তার বউমাও পারল না। বউমা স্বাধীনতা বলতে স্বেচ্ছাচারিতা, আর আত্মসুখ বোঝে। অমন বুড়ি, তাও নাকি বেশ্যামাগী, হোক শাশুড়ি, কিসের দায়? সে বলেছে বেশ্যা না হলে অমন সোজা চোখে চোখ রাখে পাড়ার অত শিক্ষিত পুরুষের চোখে। কি যাদুতে বশ করেছে সেই জানে। দুকলম কি লিখতে জানে, ধরাকে সরা জ্ঞান করে। নিজের কেচ্ছা নিজেই লিখেছে এমন মেয়েমানুষকে যমে নেয় না? হ্যাঁ গো তোমার মা-টা কি গো? ছেলের চোখ লজ্জায় নেমে এসেছে। সত্যিই তো আলাদারকম মেয়েমানুষ তার মা। নইলে বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীপূজো দেয় না! বড়লোকের বাড়ির থেকে চেয়ে এনে নভেল পড়ে? অলক্ষী... বাবাকে খেয়েছে... এবার আমাদেরও...
 
 
        আচ্ছা বলো, একটা মানুষ কতটা সইবে? ওই যে বললাম, বিশ্বাসঘাতকতা। তার উপরে বালির বাড়ি। চোরাবালিতে ঘূর্ণী লাগল। তার মনের পিছে শরীর ভাঙল। ক্রমে কুঁজো হল। এক পা চলতে দুমিনিট দাঁড়ায়। হাঁফ ধরে এলে এর বাড়ির দরজায়... ওর বাড়ির দরজায় বসে জিরোয়। তবু কারো সাহায্য নেবে না। একটা মজার কথা কি জানেন, ওকে কেউ অমুকের মা, তমুকের বউ বলে ডাকত না। এইখানেই ওর জিত। ওকে সবাই ওর নাম ধরে, কিম্বা ওর নামের শেষে দিযোগ করে ডাকত। এতটা জেদ কোন ছেলে-বউ মানবে বলো? দিল ভাত বন্ধ করে। সে নালিশ জানালো না। শুধু মারা গেল। চুপ করে। একা একা মারা গেল। 
        এখন বলো আমি একে নিয়ে কিসের গল্প লিখব? সে খাতাগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে ছেলের বউ। জেনেছি অনেকদিন আগে। আমার এই কটা কথা তার স্মৃতির তর্পণে লেখা থাকল। কেন লিখলাম জানো? আজ যখন হেঁটে ফিরছি একজন কুঁজো হয়ে আসা বুড়ি, উশকোখুশকো চুল, ছেঁড়া শাড়ি, একটা স্টোভ নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে যেতে যেতে বলল, “আমার কাছ থেকে নিয়ে যাস বাবারা এটা, আমার থাকা এখন তখন। কখন যাই। 
        আমার বুকে বিঁধল। আমি আছি এই কথাটা ভুলতে তো কিছুতেই পারা যায় না। আমার এতবড় গুরুত্ব সংসারে যে সে হিসাব করে করে তো আশই মেটে না। সেখানে সে এত সহজে এমন শূন্য নিজেকে করে ফেললে কি করে? কিসের যন্ত্রণায় এতবড় নির্বাণ পেল? কোন গাছের তলায় সে সারাটা জীবন কাটালো এ বোধিলাভের জন্য? কতটা পোড়ালো সংসার তাকে? 
        জানি এ শোকের হিসাব হয়ত বিধাতার খাতাতেও লেখা নেই। বাংলার গ্রামেগঞ্জে এমন মেয়েমানুষদের মত মূল্যহীন, অর্থহীন, বাড়তি জীবনের হিসাবে সমাজ আর বিধাতা দুই-ই উদাসীন। ভাগ্যে মৃত্যু নয়। 
        ও! শেষ করার আগে আরেকটা কথা বলে নিই। আমি কিন্তু নাম জানাবো না। কোনোভাবেই না। সে আপনি / তুমি যত পরিচিত বা কাছেরই হোন না। যে জীবনটা অমন অলক্ষ্যে গেল, সে জীবনটার কথাই বলার দায় আমার, তার পরিচয়ে কি এসে যায়?