দ্বন্দ্ব তো আছেই। ঘুম থেকে উঠে থেকে রাতে শুতে যাওয়া ইস্তক দ্বন্দ্বের বিরাম নেই। আমি চাই একটা তো মন চায় আরেকটা। আমি যেটা ঠিক বলে মানি, মন সেটার বিপরীত রাস্তায় পা বাড়িয়ে বসে। যা বুঝে গেছি হওয়ার নয়, মন সেটাকেই হইয়ে ছাড়ানোর জন্য সর্বস্ব নিলেমে তুলে দিতে প্রস্তুত। ভাবলাম হব ভালো। বাস্তবে সেরকম ভালো হয়ে ওঠা আর হল না। হতে চাইলাম পাইলট, হয়ে গেলাম অফিসবাবু।
মুশকিল হল বাইরের সমস্যাগুলোকে ভাগ্যের কি এর-ওর দোহাই দিয়ে পার পাওয়া যায়, কিন্তু ভিতরের গণ্ডগোলগুলোর কি হাল হবে? পাইলটের জায়গায় অফিসবাবু - মেনে নিলাম। গ্রেটা গার্বোর জায়গায় নিস্তারিণী - চলে যাবে। আয়নায় দেখতে চাইলাম সৌমিত্রবাবুকে, দেখলাম নৃপতি - তাও সই। কিন্তু মনের মধ্যে রাত-দিন যেসব উচিত-অনুচিত, ঠিক-বেঠিক, কর্তব্য-অকর্তব্য, বিশ্বাস-সংশয়, সত্য-মিথ্যার ঘ্যাঁচোরঘ্যাঁচ, তাকে থামায় কোন বদ্যি? মাথার মধ্যে কুটুর-কুটুর করে কেটেই চলেছে ঘিলুর পাঁপড়। উপায় কি? বলি উপায় কি কিছু আছে? না গোটা জীবনই এই কেত্তন শুনতে শুনতে জান কয়লা হবে? পাড়াশুদ্ধো বউ মানুষের বেস্পতিবার নকুল দানা দিয়ে, পাঁচালী পড়ে পূজো সেরে চাট্টি খেয়েদেয়ে সংসার গড়াতে কোনো অসুবিধা নেই, তোর ব্যাটা হতচ্ছাড়া মুখপোড়া মন অ্যাতো প্রশ্ন কিসের? - মা লক্ষী কি নকুলদানা চেয়েছিলেন? বলি পাঁচালীর ওই এডিশানটা কি পুরোনো সিলেবাসের মনে হচ্ছে না?... এ সব কি নষ্টামি কথা ভাবো? সব চাইতে বড় প্যাঁচাল হল - কোনটা করা উচিত কোনটা না। বাবা রে বাবা! রাম-শ্যাম-যদু-মধু যাকেই শুধাও, সব্বার নিজের নিজের আইনশাস্ত্র আছে (আমিও অবিশ্যি কম যাই না কিছু)। মাথা পুরো আউলা-ঝাউলা।
এখন যে কোনো এই ধরণের ট্যাঁড়া প্রকৃতির দ্বন্দ্বের দুটো সমাধানের পথ আছে। এক, মেজরিটিতে দ্বন্দ্বকে চাপা দাও। উদাঃ ধরা যাক পানকেষ্ট বামুনের ছাওয়াল, পেরেম হল খালেদার সাথে। বিয়ের কথা কিম্বা নিকার কথা যখন উঠল, তখন সে পানকেষ্ট আমাদের পড়ল একগলা জলে। বাড়িতে রাজি নয়। ত্যাজ্যপুত্র করবে। কি করা যায়? গো উইথ দ্য মেজরিটি ম্যান! ধরো বামুনের মেয়ে, আনো ছাদনাতলায়!... দ্বন্দ্ব? নিকুচি করেছে দ্বন্দ্বের ইয়ের। সব লোকে সব কালে যা ঠিক মেনে করে এয়েচে তাই তো করলুম না কি? বলি ছামাজিক ছিক্যুরিটিটা ভেবে দেখতে হবেনি? বলি, যাই ব্রিগেড তাই কি শোয়ার ঘর? যাই গীতা-বাইবেল, তাই কি চণ্ডীমণ্ডপ?
এমন কত দেখলাম আপনাদের আর কি বলি? কত কথা দেওয়া, কত সিকনি গড়ানো ভালোবাসা, কত শপথের মায়ের ক্যাঁতায় আগুন করে দিলে গা এই মেজরিটির যাদুকাঠি! যাহাই মেজরিটি তাহাই সত্য। শালা বিবেক মারিও না। ওসব মিনমিনে-পিনপিনেরা দুই ধরণের হয় - এক, যারা ফটোর মধ্যে থাকে, যাদের নামে রচনা লিখতে হয়, আর দুই, শালা খালি পকেট, না তো লোকবলহীন ন্যাজ নামানো লেড়িকুত্তার মত লোকগুলো। এদের যত বায়ানাক্কা মাইরি। সততা, বিবেচনা... আরো কত * জানো!
বলা বাহুল্য, এই পথের পথিক প্রচুর। উঁচুদরের থেকে নিম্নমানের অভিনেতাতে ভরতি চাদ্দিক। নিম্নমানের অভিনেতারা চেল্লায় বেশি। উঁচুদরেরা মিষ্টি কথায় কাজ সারে। মানে আর কি পাষাণ হৃদয়টা মসলিনের চাদরে মোড়া। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ তো থেকেই যায় না? যারা ঠিক মহাপুরুষও হতে চান না, আবার গড্ডালিকায় গা-ও ভাসাতে চান না! তারা সম্পূর্ণভাবে তারা, মানে 'নিজে যা তাই হতে চায়'?! কি স্পর্ধা না? বিনা মেক-আপে স্টেজে? শালারা ভাবে কি নিজেদের? নিন্দুকদের কেউ এদের ভাবে আরো বড় খেলোয়াড় তো কেউ ভাবে শালা বোকা পাঁঠার অণ্ডকোষজাত। এরা তবু নিজে নিজে হাঁটতে চায়। নিজে নিজে সব প্রশ্নের মানে খুঁজতে যায়, বুঝতে যায়। কি রোয়াব না? হুঁ, তবু সেটুকুও যদি বুঝত তারা। এদের অসম্ভব আত্ম-সম্মান টিকিয়ে রাখার ঝোঁক সেটাও বুঝতে দেয় না যে! এদের দ্বন্দ্ব মেটে কি করে?
রাত জেগে। অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রকার পথ। দ্বন্দ্বকে থামাতে চাইলে দ্বন্দ্ব মেটে না। দ্বন্দ্বের উত্তর চাইলে দ্বন্দ্ব যায় আরো বেড়ে। দিন-রাতের দ্বন্দ্বের অবসান যেমন হয় আহ্নিকগতিকে বুঝে নিলে, ঠিক তেমন সব দ্বন্দ্বের অবসান হয়, দ্বন্দ্বের অবসানে না, মূলের অবসানে, দ্বন্দ্বের কারণটাকে খুঁজে বার করতে পারলে। আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্বন্দ্বের অবসান বলতে বুঝি কোলাহলটার অবসান। তা তো নয়। কোলাহলটাকে থামালেও বিরোধটাকে কি থামানো যায়? না যায় না। তাতে চাপ বাড়ে বরং আরো বেশি। তাই উপায় হল - বোধের ক্ষমতাটা বাড়ানো। যাতে সে যুযুধান দুইপক্ষকেই বুঝতে পারে। তাদের লড়াইয়ের কারণটাকে খুঁজে বার করতে পারে। চিন্তার দ্বারা না, চিন্তার বাইরে গিয়ে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। তখন সে দেখে, যারা সামনের দিকে লড়াই করছে, তারা পিছনের দিকে একে অপরের পরিপূরক হয়ে অবস্থান করছে। ভুলটা ছিল তার দেখার। তাকে প্রথমে এটা বিশ্বাস করতে হবে, সব দ্বন্দ্বের মূল তার মন। তার মনের বাইরে কোথাও কোনো দ্বন্দ্ব নেই। "নেই যে রে ভয় ত্রিভুবনে, ভয় শুধু তোর নিজের মনে"। 'আমি প্রকৃত অর্থে কি' - এটা না বুঝে, 'আমার কি হওয়া উচিৎ' এটার পিছনে ছুটলে আত্ম-প্রবঞ্চনা ছাড়া কোনো পথ দেখি না। "তুমি আমার অন্তঃস্থলের খবর জানো, ভাবতে প্রভু আমি লাজে মরি", কান্তকবির ঢঙে গাইতে হয়। সব দ্বন্দ্বের মূল এই 'যা চাই' আর 'যা প্রকৃত' তার মধ্যে। অনেকে বলবেন, “আমার মধ্যে অনেক গোলমাল, তার কি হবে?” উত্তরে বলি, তার উপর কার্পেট চাপা দিলে তো সমাধান হয় না কিছু। কার্পেট চাপা দেওয়া সামাজিক সমাধানের পথ, আত্মগত সমাধান ওতে হয় না। নিজের মুখোমুখি না হওয়ার সাহস থাকলে, নিজে যা, তা বিনা অভিযোগে অন্তত নিজের কাছে স্বীকার করে না নিলে, সারাটা জীবন মুখস্থ পাঠ বলেই কাটবে। একটা কস্টিউম ছাড়তে না ছাড়তেই আরেকটা কস্টিউম পড়ার ডাক আসবে। কি লাভ ওভাবে বেঁচে? বরং কিছু ভুলই না হয় হোলো, সে হোক। তবু তা আমার নিজের হোক, অন্যের ভূমিকায় নির্ভুল অভিনয় না হোক। সে যথাযথ অভিনয়ও আমার লজ্জার। তাই রাস্তা একটাই - নিজের মুখোমুখি হয়ে নিজেকে নিজের আকরিক থেকে চিনতে শেখা। সেই অনাদি প্রার্থনা -
অসতো মা সদ্গময় / তমসো মা জ্যোতির্গময়