Skip to main content
কথা বলার একটা ছন্দ থাকে। হাঁটাচলার ছন্দ থাকে। গান-কবিতার ছন্দ থাকে।
তেমন আমার দেখার আর শোনারও একটা ছন্দ আছে। বাইরের দুনিয়ায়, কি আমার ব্যক্তিগত দুনিয়ায় যা কিছু ঘটে চলেছে, সবেতে কি আমার মন সাড়া দিচ্ছে? না, দিচ্ছে না। আমি যা সব চোখের সামনে দেখি না কেন, সে প্রত্যক্ষ হোক কিম্বা টেলিভিশানের পর্দায় হোক - আমার মন সেই সেই ঘটনাগুলোকেই নথিভুক্ত করবে যে ঘটনাগুলো তার অন্তঃকরণের ছন্দের সাথে মেলে।
শ্রবণের ক্ষেত্রেও তাই। যা শুনছি, সরাসরি হোক কিম্বা যন্ত্রের মাধ্যমে, সব কি নিচ্ছি? না, নিচ্ছি না। সেই শ্রবণের মাধ্যমেও যা কিছু পাই, তাকে অন্তঃকরণের ছন্দের সাথে মিলিয়েই আমার মত করে পাই।
এই ছন্দের স্রষ্টা কে? এর সঠিক উত্তর কারোর জানা নেই। কিছুটা সে নিয়ে জন্মায়, যা তার মূল রসদ। বাকিটা পরিবেশ তৈরী করে দেয়। ইমানুয়েল কাণ্টের মতে প্রাথমিক জ্ঞান আমরা নিয়েই জন্মাই। ভারতীয় দর্শনের সাথে এই দর্শন বেশ খানিকটা মেলে। গীতা বলেন, শ্রদ্ধার কথা। যা মানুষ নিয়ে জন্মায়। সেই শ্রদ্ধা অনুযায়ী তার অন্তঃকরণের ছন্দ গড়ে ওঠে। আমার হয়তো মার্ক্সের তত্ত্বের উপর খুব বিশ্বাস, আপনার হয়তো বুদ্ধের তত্ত্বের উপর, আবার কারোর হয়তো বা খ্রীষ্টের তত্ত্বের উপর। জেনেটিকালি একে ব্যাখ্যা করা খুব শক্ত। একই পরিবারে ভিন্ন রুচির ভাই-বোন হয় কি করে তা হলে? একই বাহ্যিক পরিবেশে বড় হয়ে একই পরিবারের দুই ভাই দু'রকম হয় কি করে? তার মানে তারা জন্মলব্ধ একটা default mode নিয়েই আসে।
মানুষের দুটো সত্য নিয়ে চলতে হয়। এক, তার দর্শিত, শ্রুত সত্য। আরেক তার বিশ্বাসোচিত সত্য। যেমন ক'দিন আগে লিখেছিলুম -

গোলাপ লাল হয়
    এ ধ্রুবসত্য, ইন্দ্রিয়লব্ধ সত্য
অস্বীকার করার যো নেই
আমার কাছে গোলাপের চেয়েও সুন্দর
                     রজনীগন্ধা
  এ আমার বিশ্বাসের সত্য
        সারা সংসার অস্বীকার করলেও
তাই আমি মন্দিরে না গিয়েও -
    প্রণত এ মাটির সব ধূলিকণার কাছে
মন্দির সংসারের সত্য
ঈশ্বর সত্য আমার বিশ্বাসের

এই যে বিশ্বাসের সত্য, এর মাধ্যমেই বাইরের সম্পদ হয় আমার অন্তরের সম্পদ। বাইরের ছন্দের সাথে পা মেলায় আমার অন্তরের ছন্দ। আমি শীতের সকালে ছাদে দাঁড়িয়ে। নীলাকাশের বুকে টুকরো টুকরো কিছু সাদা মেঘ। সামনের বড় দীঘিটার সবুজ জল হিমেল হাওয়ায় শিহরিত হয়ে উঠছে। পাড় বরাবর নারকেল, সুপারি, আম ইত্যাদি গাছের সারিতে সবুজ উজ্বল চারপাশ। পাখিদের রোদ পোহানো। সব মিলিয়ে যে ছবিটা আমার সামনে তা মনোহর। কিন্ত এই মনোহর পরিবেশটা কি সম্পূর্ণ পরিবেশের উপকরণেই গড়া? আমার কি কিছুই অবদান নেই? যদি বলো নেই! তবে মিথ্যা কথা বলা হয়। আমার মনের অন্তঃছন্দ এই রূপের ছবিটাকে একটা নিবিড় অনুভূতি দিয়ে প্রাণের উৎসবে নিয়ে আসছে। আমি ভিতর থেকে বলে উঠছি - বাহ্, অপূর্ব! আমি মুগ্ধ। আমি ধন্য।
এ তো গেল সুন্দরের কথা। নান্দনিক দিকের প্রসঙ্গ। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের সাথে এর কি সম্পর্ক? আছে। আমার কাগজে সই করতে গেলেও লেখা থাকে - This is true according to best my of knowledge and belief. তাই হল মোদ্দা কথা। অর্থাৎ, আমার বিশ্বাসের সত্যের দাবী শুধু শৌখিন মহলে না, নিতান্ত কেজো জগতেও।
আমরা বিশ্বাস করি আমাদের যোগ শুধুমাত্র ছোট সংসারের সাথে না, বড় সংসারের সাথেও। তাই যে কারণে যোগী ধ্যানে বসে বিশ্বাত্মাকে নিজের অন্তরে বসিয়ে সেই বৃহত্তর আস্বাদ পেতে চান, সেই কারণেই একজন ব্রিগেডের মাঠে লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে আপ্লুত হয়ে যান। পার্থক্য হল, একজন নিঃস্বার্থভাবে সেই বৃহতের সাথে যোগসূত্র খুঁজছে, আরেকজন স্বার্থের জন্য। তাই প্রকার আলাদা। ফল আলাদা। প্রয়োগ আলাদা। কিন্তু উদ্দেশ্য এক।
যখন কেউ বলেন আমাদের এই ছোট সংসারকে জানলেই সব হয়ে যায়, তখন তাই তা হাসির কথা হয়ে ওঠে। যিনি সকাল বিকাল সংসারের মাসকাবারির বাজার থেকে শুরু করে নানান খুঁটিনাটিতে ব্যতিব্যস্ত, তিনিই যখন স্কুলে ভুগোল ক্লাসে ঢুকে মহাকাশের তত্ত্বে ডুব দেন তখন অন্য মানুষ। এটি করতে পারলেই তিনি সার্থক শিক্ষক। আমাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে তাই বড়কেই ডাকতে হয়েছে। সারা বিশ্বের ইতিহাস, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ঠিকানা, মানবসভ্যতার উন্মেষের কথা ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ ছোটকে জানায় আমার জীবনের সার্থকতা নেই।
এই ভিতরের ছন্দটি ঠিক থাকে যদি নিজের বিশ্বাসের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা যায়। তবে সবকিছু অমনি অমনি আমাদের পেড়ে ফেলতে পারে না, সবকিছুই গায়ে এসে অসভ্যের মত লাগে না। যতই পরিবেশ পরিস্থিতি জটিল হোক না কেন, ভিতরের দৃষ্টিতেই আলো পাওয়া যায়।
সব সমস্যা সমাধানেরই দুটো পথ। এক, সমস্যাটাকে তুচ্ছ করে দেওয়া। দুই, নিজেকে এত বড় করে ফেলা যে সমস্যাটা আপনিই তুচ্ছ হয়ে যায়। বিশ্বাসের সত্য এই দ্বিতীয়টার পথ খুলে দেয়।