Skip to main content

বাঁচাটাকে easy করার চেষ্টায় আছি। তাই আইন কানুন তৈরি হল, বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে দূরত্ব কমানো গেল, আয়ু বাড়ানো গেল, শ্রম কমানো গেল আরো কত কি, কত কি হল। এসব হয়ে চলেছে আর হবেও। সেটাই স্বাভাবিক। যদি জীবনটাতে আরেকটু স্বাচ্ছন্দ্য আনা যায়। আসছেও তো। তবু?
     হ্যাঁ ওই তবুটাকে আর কিছুতেই পাশ কাটানো যাচ্ছে না। কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকেই যাচ্ছে। প্রথম প্রথম ভাবতাম আমার বুদ্ধিশুদ্ধি কম বলে হয়তো ঠিক বাগে আনতে পারছিনা জীবনটাকে। ও বাবা! চারিদিকে তাকিয়ে দেখছি না তো! মার্বেল পাথরে বাঁধানো মেঝে খুঁড়লেই তো সেই ধুলো বালি পোকা। তাই মার্বেলে এখন আর বিশ্বাস নেই। সে বাইরেই ভাল।

     আমাদের আশ্রমিক (আশ্রমিক মানে গেরুয়াধারীদের আখড়া না। যে অর্থে চতুরাশ্রম সেই অর্থে) জীবনগুলোতে একটা সাধারণ ভাব চোখে পড়ত। সহজভাব। এই শব্দটার যে কি মাহাত্ম্য তা ভাবলে আশ্চর্য্য হতে হয়।

     ধরা যাক আমাদের অভিব্যক্তি। আমি সহজভাবে দেখব, চলব, কথা বলব, খাব বলে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে প্রকৃতি কি পরিশ্রমটাই না করল।
     এক একটা মডেল আনল, কিছুদিন চালাল। যদি সে মডেল সহজ সুরটা ধরতে পারল, তো পেল ছাড়পত্র। না তো বাতিল। তার ঠাঁই হল Hall of Fame-এ।
     এই শরীরটার দিকে তাকাই। সেখানে কোষে কোষে কি পরিশ্রমটাই চলেছে আমার বেঁচে থাকাটাকে সহজ রাখতে। তার উপর আছে বিদেশী জীবাণুর আক্রমণ। প্রতি মুহুর্ত্তে তাকে সজাগ থাকতে হয়, যেন তাল না কাটে।

     এবার মনের কথায় আসা যাক। সেখানেই যত গোল। তার ধর্মই গোল পাকানো। তার হাজার প্রশ্ন, কৌতুহল, চাহিদা। তার সাথে রাগ, অভিমান, ক্ষোভ। চূড়ান্ত পর্যায়ে অবসাদ, ভারসাম্যহীনতা, আত্মহনন।
     তার দুটো সমস্যা। এক, নিজেকে নিয়ে। দুই, তার চারপাশকে নিয়ে।
     বার্টান্ড রাসেল তাঁর বিখ্যাত বই 'CONQUEST OF HAPPINESS'-এ সুন্দর একটা উপসংহার টেনেছেন এই বিষয়টার। বলছেন - জীবনটাকে বিলিয়ার্ড বোর্ড করে তুলো না। এ যেন শুধু এই গুটির সাথে ওই গুটির সংঘর্ষ। না, সেরকম না। একটা সামঞ্জস্যতা আনো। কি রকম সামঞ্জস্যতা? তোমার নিজের সাথে নিজের আবার তোমার চারপাশের সাথে তোমার।
     কি চমৎকার কথা!

    এখন উপায়?

     একটু এথেন্সের দিকে যাওয়া যাক। তিন দিকপাল। সক্রেতিস- প্লেটো – অ্যারিস্টটল। বললেন একটা অদ্ভুত পথ - মধ্যপথ। সক্রেতিস এর আভাস দিলেন। প্লেটো তাঁর কালজয়ী 'The Republic' বইতে কিছুটা উল্লেখ করলেন। অ্যারিস্টটল তাঁর আরেক বিখ্যাত বই, 'The Nicomachean Ethics'-এ বিশদ ব্যাখ্যা করলেন। বললেন দেখো, মাঝামাঝি একটা রফা করো। অতিসাহস, নির্লজ্জতা, আবেগপ্রবণতা এইগুলো যেমন ক্ষতিকর; তেমনই ভীরুতা, অতিলজ্জা, আবেগহীনতা ততটাই ক্ষতিকর। তুমি মাঝামাঝি এসো। দু'দিকের চূড়ান্ত দিকটা ত্যাগ করো। একে পাশ্চাত্য পন্ডিতেরা বলেন 'Golden Mean তত্ত্ব।
     সুন্দর প্রস্তাব। আমাদের দেশেও গীতায় সামঞ্জস্যতা পূর্ণ আচরণের কথা এসেছে। বলছেন, না তো প্রচুর খাও বা অনাহারে থাকো, না তো খুব ঘুমাও বা খুব জেগে থাকো।
    এরকম আর কি। তাছাড়া যাকে আমরা সত্ত্বগুণ বলি তাও এই দুই চূড়ান্ত ভাবেরই মধ্যবস্থা। 'তমো' মানে ম্যাদাটে ভাব আর 'রজো' মানে হুজুগে ভাব, এই দু'টোই ছাড়ো বাবা, মধ্যপথে এসো দিকিনি।
     বুদ্ধদেবও তাই উপলব্ধি করলেন। ভাগ্যে সুজাতা পায়েস রেঁধে দু'চামচ খাইয়েছিলেন। না হলে বেঘোরে প্রাণটা যেত অমন ভাল মানুষটার। না খেয়ে না খেয়ে শরীরটার অবস্থা বেগতিক। দাঁড়াতে গেলেই মাথা ঘুরছে, পা টলছে - ভারী মুশকিল। সুজাতার দেওয়া পায়েস খেয়ে উনি অনুভব করলেন মধ্যপথের কথা। বললেন তাঁর মত করে - সত্য উপলব্ধি করতে শরীরকে কষ্ট দেওয়ারও মানে হয় না আবার তাকে আদরে বাঁদর করারও মানে হয় না। তারপর তো প্রচারিত হল ওনার জগৎ বিখ্যাত 'মধ্যপথ' বা 'Middle Path' তত্ত্ব।
     আর আমাদের ঠাকুমা দিদিমারা?
    তাঁরা একটা দারুন কথা বলতেন, "অতি বাড় বেড়ো না, ঝড়ে পড়ে যাবে / অতি ছোটো হোয়ো না, ছাগলে মুড়াবে"। ভাব একবার! কত সহজে এক প্যাঁটরায় মায় সক্রেতিস থেকে বুদ্ধ অবধি বলে ফেললেন!

     আর সব শেষে আসি আমাদের পাগলা ঠাকুরে। তিনি কি বলেন নি এই মধ্যপথের কথা? বলেছেনই তো। তাঁর অনবদ্য ভাষায়,
     "থাকো রসে বশে।"