Skip to main content

মূল তত্ত্বটা কি তবে? এই যে এত ছোটাছুটি, এত ধর্ম, এত মত, এত দর্শন। কোথাও কি বাস্তবটা থেকে বিমুখ হওয়ার চেষ্টা। ব্যক্তিগত জীবনে যখন অত্যন্ত সংকটকালীন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছি বারবার, মনে হচ্ছে, তবে কি প্রস্তুত ছিলাম না? নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্য এত তোড়জোড় ছিল? সব বানানো গল্প? রূপকথা?
        প্রথম কথা কে দেখাবে আলো? ধর্মের সম্প্রদায়ের অন্ত নেই। সেখানে শয়ে শয়ে লোক যাচ্ছে, দীক্ষিত হচ্ছে। কে দীক্ষা দিচ্ছেন? তিনি কি নিজে আলোকিত? না তিনি কোনো একটা বিশেষ অভ্যাস তথা বিশ্বাসের বাহকমাত্র। তিনি সেই অভ্যাসের পথে, সেই বিশ্বাসের পথে আপনাকে নিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু আলোকিত করতে পারেন কি? না পারেন না। কারণ আলোকিত করতে গেলে নিজেকে আলোকিত হতে হয় প্রথম। তবে? আমি কি কোম্পানীর দেশলাই কাঠি কিনছি সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা আলো জ্বললে তো সব দেশলাইয়ের রঙই সমান। কিন্তু আলো জ্বলে কই? এ তো কাঠিতে কাঠিতে ঠোকাঠুকি। এ তো প্রতিদিন কাঠিগুলো বার করে রোদে শুকিয়ে ঝেড়েমুছে আবার খাপের মধ্যে ভরে ফেলার অভ্যাস।
        তবে কি ধর্ম-দর্শন বাস্তবের থেকে মুখ ফিরিয়ে চলার কথা শেখায়? গোড়ায় যাই আগে।
       যে কথাটা সংসারে খুব বড় কথা সে হল - অর্থ। খুব বড় একটা শক্তি। সংসারে একে খুব বড়ো জায়গা দেওয়া হয়েছে। না দিয়ে উপায় ছিল না, কারণ মূলত আমরা স্বার্থকেন্দ্রিক সত্তা। অর্থের খুব বড় একটা ক্ষমতা হল, তার অসামান্য প্রভাব বিস্তারের শক্তি। দারিদ্র্যতা কাম্য নয়। তুলসীদাসও স্বীকার করছেন, দারিদ্র্যের চেয়ে বড় দুঃখ সংসারে নেই। কিন্তু অর্থের কি কোনো ধর্ম হয় না? নীতি হয় না? সে কি ভয়ংকর একটা বিধ্বংসী শক্তি? তা নয়। রামকৃষ্ণে আসি, বলছেন, যে মানুষ টাকার বশ নয় সে-ই মানুষ।
        এই হল মূলসুর। যে মানুষ টাকার বশ নয়। তবে সে কিসের বশ? ধর্মের? ঈশ্বরের? গুরুর? এর উত্তর হাঁ-ও বটে আবার না-ও বটে।
        যদি ধর্ম-গুরু-ঈশ্বর ইত্যাদির অর্থ সচেতনতা হয়, জড় অভ্যাস বা গোষ্ঠীকৃত বিশ্বাস নয়, তবে উত্তর হাঁ। যদি বিপরীতটা হয়, তবে উত্তর - না। তাই বলছেন, টাকার বশ হয়ো না, তবে মানুষ থাকবে না। তবে, টাকায় কি হয়? বলছেন - খাবার, থাকার ব্যবস্থা, কোনো মানুষ অসুবিধায় পড়লে তার সেবা। অর্থাৎ শরীরকেন্দ্রিক যত কিছু। কিন্তু সে আমার সিক্যুরিটি নয়। সে আমার প্রয়োজন। খুব কি পার্থক্য হল? হল। খুব বড় পার্থক্য হল। ভূমিকম্প হলে যেমন বাড়ির দেওয়াল আর ছাদ-ই আমার আতঙ্কের কারণ হয়, অথচ যারা কিনা অন্য সময়ে আমার সিক্যুরিটির ভূমিকা পালন করে, সেই ছাদ-দেওয়ালের হাত থেকে বাঁচার জন্যেই তখন বাইরে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়াতে হয়, এও তেমন। যে জিনিস মানুষের প্রয়োজনের জন্য এসেছিল, সেই যখন মানুষের পরিচয় হয়ে দাঁড়াতে চায়, তখন বুঝতে হয়, আমরা কোথাও একটা বড় গোল পাকাচ্ছি। নিজের তৈরি ফাঁসে নিজেকে জড়াচ্ছি। আর জড়াতে জড়াতে শেষে এমন একটা পরিস্থিতি এসে দাঁড়ায় যে, আমার যে একটা খোলা আকাশ পাওয়া জন্মগত অধিকার, সেটাও ভুলতে বসি।
        তবে সিক্যুরিটি কি? আবার রামকৃষ্ণে আসি, বলছেন, সঠিক বুদ্ধি। শুধু সূত্র না, উদাহরণ দিচ্ছেন। বলছেন, দেখো, পঞ্চপান্ডবদের ওপর দিয়ে অত ঝড় গেল, বনবাস হল, অথচ তাদের বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়নি। কারণ তাদের ঈশ্বরে মতি ছিল। আর ওদিকে দেখো রাজপ্রাসাদে থেকে, অত ঐশ্বর্য্য, প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেও কৌরবদের কেমন বুদ্ধিভ্রষ্ট হল। কারণ ঈশ্বরে মতি ছিল না (রামকৃষ্ণের ঈশ্বরের পরিভাষা চেতনা। কথামৃতে বহু জায়গায় ঈশ্বর কথাটার পরিবর্তে চেতনা শব্দ ব্যবহার করেছেন)।
        কি অকাট্য উদাহরণ। প্রাচুর্য্যই যে শেষকথা বলে না, আজ নোকিয়া, অ্যাম্বাসাডার ইত্যাদি রথী-মহারথীদের অবস্থা দেখলেই অনুমেয়। তাদের কোম্পানীতে তো মেধা-পরিকল্পনার অভাব ছিল না। শুনেছি, যে ছেলেটা নাকি বচ্চনের সাথে খেলে কোটিপতি হয়েছিল, আজ সে দেউলিয়া প্রায়। অর্থাৎ টাকার পরিমাণই শেষ কথা বলে না তো! আমরা অবশ্য আদা নিয়েই ভাবি, জাহাজের কথা থাক। কথা হল, আমার সিক্যুরিটি অর্থ না, সদবুদ্ধি।
        ঈর্ষা, শোক, ক্ষোভ - সদবুদ্ধির পরিপন্থী। নিজের অবস্থানটা, যোগ্যতাটা সঠিক মাত্রায় অনুধাবন করতে দেয় না। অকারণ ফাঁদে পা দি-ই। তার একটা বড় কারণ আমাদের ওভাবেই শেখানো হয়েছে। আজ চিটফাণ্ডের যে কেচ্ছা কেলেঙ্কারির কথায় রাঘব বোয়ালদের ধরা হচ্ছে, আপামর সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, লোভ ছাড়া সে ধূর্ত কৌশল তাদের সফল হতে পারত? যে অঙ্কের টাকা তারা ফেরত দেবে বলেছিল, বা যে অঙ্কের মুনাফার কথা তারা বলে মায়াজাল সৃষ্টি করেছিল, তাতে পা দিল কে? কেন, আমাদের সাধারণ বুদ্ধি তখন কোথায় চরতে গিয়েছিল? যে টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক দিতে পারে না, তারা দেয় কি করে? ভাবিনি তো। ওই যে - "আমি আপন মনের মারেই মরি, শেষে দশজনারে দোষী করি / আমি চোখ বুজে পথ পাইনে বলে কেঁদে ভাসাই পাড়া"। বুদ্ধি তো তখন - 'লোভ-উপহৃত চেতসা'! চেতনা লোভ চুরি করেছে যে।
        তাই বলছেন, যে টাকার বশ নয়, বরং টাকা যার বশ, সেই মানুষ। রোজগার হবে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকবে, কিন্তু জেনো, সব শেষে মায়ের ইচ্ছা।
        সুকঠিন নাস্তিকও এ যুক্তি স্বীকার করবে, অনেক সময় সব চেষ্টার শেষেও নৌকা তীরে ভেড়ে না, এমন উদাহরণও সংসারে অপ্রতুল নয়। মায়ের ইচ্ছা না বুঝি, কালের গতির মুখাপেক্ষী যে হতেই হয়, সে কথাটা না মেনে যো আছে? তবে বিশ্বাস করলে আমার শান্তি, না করলে ক্ষোভে দগ্ধে দগ্ধে মরতে হয়। সফল হওয়া আর সফল সাজার ভাণ করার মধ্যে যে কি সুতীব্র যন্ত্রণা তা আজ এই দেখনদারির যুগে বোঝা খুবই কঠিন। মানুষের সব চাইতে বড় সিক্যুরিটি অবশেষে তাই মানুষই। সদবুদ্ধিযুক্ত মানুষ। অর্থের অধীন না, বিবেকের অধীন মানুষ। শেষ নিরাপত্তা।
        সবশেষে বলি, রামকৃষ্ণ ঈশ্বরের অবতার ছিলেন কিনা বলতে পারি না, তবে অমন একটা পরিখাহীন চেতনার ধারা সংসার খুব কমই দেখেছে। তাই নানান দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা দার্শনিকদের পাশে এই পক্ষপাতশূন্য চেতনার অক্ষয় জ্যোতিটা এ সংসারে, এ অন্ধকার সময়ে একটা বড় আশ্বাস।