আমার চিন্তা কতখানি আমার চিন্তা? আমার চিন্তা কতখানি আমার বাসনা, ভয়, ঈর্ষা ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত? আমার আবেগের বাতাসে উড়িয়ে নেওয়া চিন্তা আর আমার যুক্তির লাগামে বাঁধা চিন্তা কি এক?
বলা হয় আমি যা তা হলাম আমার চিন্তার সমষ্টি। আমার চিন্তার কতখানি আমি? আমার চিন্তা কতবার আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেল আমার বাসনা? আমি কোনো কিছুর বশবর্তী মানে হল আমার চিন্তাশক্তি আমার হাতে নেই। আমার আবেগের হাতে চলে গেছে রিমোট কন্ট্রোল। সে যা ভাবাচ্ছে আমি তাই ভাবছি। ভালো চিন্তা, খারাপ চিন্তা বলে কিছু হয় না, সে চিন্তা করার ক্ষমতা কতটা আমার হাতে সেটাই সব চাইতে বড় কথা।
চিন্তা সৃষ্টি করতে পারে। তাই আমার বাসনা, ঈর্ষা, রাগ, ভয় সবাই এসে চিন্তার দরজায় দাঁড়ায়। বলে দাদা আমার এদিকে আসুন, আপনি আমার হয়ে একটু কিছু সৃষ্টি করে দিন। চিন্তা আমার দিকে একবার তাকিয়ে আমার অনুমতি বা প্রশ্রয় চেয়ে নেয়। ব্যস, এইটুকু ভুলই আমার দ্বারা হয়। আমি তাকে বলি যা, কিন্তু ততক্ষণই যতক্ষণ আমার সুখ লাগে, আরাম লাগে। কিন্তু তা কি হয়? বাসনা, ঈর্ষা, ভয়, রাগ সবাই এই বলে আমার কাছ থেকে চিন্তাকে নিয়ে যায় যে আমার হাতে কিছুক্ষণের জন্য দাও, দেখবে কি দারুণ সুখে রাখব তোমায়, আমাদের শক্তিতে এমন এমন সব সৃষ্টি করব যে তুমি তাজ্জব হয়ে যাবে। ব্যস, আমি লোভে পা দিয়ে দিলাম। চিন্তা আমার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এর ওর হাতে পড়ে খাবি খেতে শুরু করল। শুরুটা আমিই যে আমার লোভের বশে শুরু করলাম তা ভুলে গেলাম। তারপর ওদের হাতে চিন্তার পাকে নিজেই জড়িয়ে জড়িয়ে নিজের মধ্যে বিধ্বস্ত হতে শুরু করলাম। সুখ? কোথায় সুখ? কোত্থাও বিন্দুমাত্র সুখ নেই। আমিই আমার চারদিকে বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি করে ফেলেছি শুধু আমার অন্ধ আবেগগুলোর হাতে চিন্তাকে তুলে দিয়ে। আমি যে চেতনার আলোতে বাঁচি, সেই চেতনার আলো ক্রমশ ঢাকা পড়তে শুরু করল আমার চিন্তার মেঘের আড়ালে। আমি অন্ধকারে এসে পড়লাম। আমার চেতনা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে শুরু করল। কিন্তু আমার কিছু করার নেই যেন, কাউকে দায়ী করার নেই, এ খেলা তো আমিই শুরু করেছিলাম।
এই সময়ে ধৈর্য চেতনার ত্রাতা হয়ে আসে। সে বলে তুমি নিজেকে ওই চিন্তার মেঘের জাল থেকে বিচ্ছিন্ন ভাব। ওগুলো চিন্তাই শুধু। তোমার নানা অন্ধ আবেগের জ্বালানীতে জ্বলে উঠছে। তুমি তোমার অন্ধ আবেগের হাত থেকে বাঁচতে পারো, শুধু নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবো। চিন্তার সব সুতোটা কখনওই ওদের হাতে যায় না। একটা খেই সব সময় চেতনার হাতে ধরা থাকে। সে সেই খেই খুঁজে পায় না এই মেঘের আড়ালে গিয়ে। ধৈর্য সেই খেই খুঁজে দেয়। চেতনা ধীরে ধীরে আবার নিজের চিন্তাকে অন্ধ আবেগের থেকে মুক্ত করতে শুরু করে। চিন্তাকে সরিয়ে আনলে অন্ধ আবেগের শক্তিক্ষয় হতে শুরু করে। কারণ চিন্তার শরীরে না ঢুকলে ওরা কর্ম ক্ষমতাহীন। চিন্তা যত চেতনার আলোতে এসে দাঁড়াতে শুরু করে আবেগের শক্তি হ্রাস হতে শুরু করে, সে আবার তার অন্ধকার গুহায় ঢুকতে শুরু করে, চিত্তে আবার শান্তি আসতে শুরু করে।
এর মধ্যে সব চাইতে কঠিন সময় হল যখন চিন্তা অন্ধ আবেগের সম্পূর্ণ বশে চলে এসেছে তখন। যেন বালিঝড় উঠেছে। যেন ধুলোঝড় উঠেছে। চারদিকে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। এই সময়টা সব চাইতে কঠিন সময়। নিজের মধ্যে এইটুকু বিশ্বাসও যেতে শুরু করে যে আমার একটা স্বাধীন সত্তা আছে। আমি আমার অন্ধ আবেগের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অসহায় একটা সত্তা নই। আমার চেতনা আছে। আমার বোধশক্তি আছে। আমারই প্রশ্রয়ে, আমারই দুর্মতিতে আমার আজ এই হাল। তখন কেউ প্রার্থনা করে, কেউ শান্ত হতে চেষ্টা করে ধৈর্য ধরতে চেষ্টা করে। তার একটাই কারণ আমাদের এইটুকু বোধ থেকেই যায় আমাদের চেতনার হাতে আমার চিন্তার একটা খেই আছেই আছে। তাকে খুঁজে পেলেই সমাধানের সূত্র বেরোয়। কিন্তু তাকে যে আমি পেতেই পারি, এ বিশ্বাস হারিয়ে গেলে সবটুকু হারিয়ে গেল। তখন আমার বাইরে থেকে সাহায্য লাগে। যে আবার আমার সেই সূত্রটুকু খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। সে আমার মধ্যে আবার সেই বিশ্বাসটা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে যে আমার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণের খেইটা আমি কখনও সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলতে পারি না। আমি শান্তিতে থাকতে পারি – এই বিশ্বাসটাই একমাত্র আমায় শান্তিতে রাখতে পারে। কোনো কৌশলে নিজেকে শান্ত করতে গেলে মনের গভীরে উদ্বিগ্নতার ঢেউয়ের উথাল-পাথাল চলতেই থাকে। সে বরং আরো খারাপ।
এ এক যেন জীবনব্যাপী অভ্যাস। নিজের চিন্তার কারখানায় অন্ধ আবেগের জীবাণু না ঢুকতে দেওয়া। দিলেই সব গোলমাল করে যাবে। সংসারে আমার বলতে যদি সত্যিই কিছু থাকে, সে আমার এই চিন্তা করার ক্ষমতাটুকু। বাকি এ শরীর থেকে শুরু করে এই গোটা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে আমার ইচ্ছার কোনো মূল্য নেই। সেখানে শুধুই সমঝোতা, মেনে নেওয়া। তো এই চিন্তার স্বাধীনতাটুকুও যদি আমার অন্ধ আবেগের হাতে চলে যায়, তবে আমার বলে আর কি থাকল? আলো আর অন্ধকার, চেতনাশক্তি ও অন্ধ-আবেগের শক্তি দুই আমাদের মধ্যে আছে। মহান দার্শনিক কান্টের মতে এই আলোর দিকে ফিরে চিন্তার সুতো বাড়িয়ে দেওয়াকেই বলে আলোকিত হওয়া, যাকে ইংরাজিতে বলে enlightenment. তাকে কোথাও বাইরে খুঁজতে যেতে হয় না, চিন্তাধারার মুখটাকে ফিরিয়ে দিতে হয় কেবল। নইলে এই এক চিন্তাকেই তুলসীদাস বলছেন চিতার সমান, আবার এই এক চিন্তাকেই গীতা বলছেন, না চিন্তা করলে সুখ কোথায়? এমন স্ববিরোধী কথা হয় কি করে? হয়, চিন্তার প্রভুত্ব কার হাতে, তার উপরে নির্ভর করেই সবটা। সেই গানটা আছে না,
আর রেখো না আঁধারে, আমায় দেখতে দাও।
তোমার মাঝে আমার আপনারে দেখতে দাও।।
কাঁদাও যদি কাঁদাও এবার, সুখের গ্লানি সয় না যে আর, হায় রে,
নয়ন আমার যাক-না ধুয়ে অশ্রুধারে-
আমায় দেখতে দাও।।
জানি না তো কোন্ কালো এই ছায়া,
আপন ব'লে ভূলায় যখন ঘনায় বিষম মায়া।
স্বপ্নভারে জমল বোঝা, চিরজীবন শূন্য খোঁজা- হায় রে,
যে মোর আলো লুকিয়ে আছে রাতের পারে
আমায় দেখতে দাও।।