সৌরভ ভট্টাচার্য
19 July 2019
বৈষ্ণব সাহিত্য মানুষকে সৌন্দর্যের বাঁধন থেকে মুক্তি দিল। জীবনে আনন্দের অভাব তখনই যখন সে আনন্দকে আমার বৈষয়িক সুখের নিমিত্তে খাঁচায় পুরে প্রতিদিন ছোলা খাওয়ানোর স্বপ্ন দেখি। আমাদের রেল কোয়াটার্সের জানলার থেকে কিছুটা দূরে দুটো খুব বড় বড় কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া গাছ ছিল। যখন সেই গাছদুটোর মাথায় ভোরের শুকতারা জ্বলজ্বল করত, কিম্বা আষাঢ়ের মেঘ রাজবেশে ঘনিয়ে আসত, মনের মধ্যে একটা প্রসন্ন আনন্দ অনুভব করতাম। সে সৌন্দর্য বা আনন্দ আমার ব্যক্তিগত কোনো কাজে আসার প্রতিশ্রুতি দিত না। কিন্তু যা অনুভব করতাম তাতে আমার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধ 'আমি'কে ছাপিয়ে যাওয়ার শক্তি পেতাম। সে আনন্দ মহার্ঘ্য আনন্দ, আমার কাছে ছিল তাই।
মানুষের নানাবিধ সুখের ফরমায়েশ। শরীরের সুখ, নিরাপত্তার সুখ বা সম্পদের, খ্যাতির সুখ। এর মধ্যে সম্পদের সুখ দুই সুখের যোগান দেয়, এক, খ্যাতি; দুই নিরাপত্তা। অপরদিকে এই সুখগুলোই মানুষকে বেঁধে ফেলে। সে গর্বের সাথে নিজের কাজের, ব্যস্ততার, যোগ্যতার, নাম-যশের মোহে নিজেকে চারদিক থেকে বেঁধে ফেলে, নিজেকে একজন বিশেষ কেউ অনুভব করে। কিন্তু এইখানেই শেষ নয়। যদি শেষ হত তবে মানুষের গৌরব বলে কিছু থাকত না। এই সুখের সাথে সাথে তার মধ্যে একটা কান্না জেগে ওঠে। মুক্তির কান্না। দুঃখের থেকে মানুষ নিষ্কৃতি পেতে চায়, কিন্তু সুখের থেকে সে পেতে চায় মুক্তি। তাই মুক্তির আকুতি এত তীব্র তার কাছে। কিন্তু এই মুক্তির শর্ত কি? কিম্বা মুক্তির সুখই বা কি?
দুইয়েরই প্রবল কথাটা হল – অধীনতা। মানুষ নিজেকে অধীন করে মুক্ত হয়। প্যারাডক্স? সে তো বটেই। কিসের অধীন হতে চায়? নিজের বিবেকের শাসনের, সার্বজনীন ভালোবাসার। আরো সহজ করে বলতে চাইলে – সে সার্বজনীন হয়ে উঠতে চায়, নির্বিশেষ হয়ে উঠতে চায়। আর ‘বিশেষ’ হয়ে থাকার সুখ সে চায় না। “কেন আমায় মান দিয়ে আর দূরে রাখ?... অসম্মানে আনো টেনে পায়ে তব। / তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধুসর হব।।"
অত্যন্ত দুষ্ট, সমাজবিরোধী যেমন দেশের আইনের কাছে নতিস্বীকার করে সমাজে মুক্ত হয়, তেমন অত্যন্ত প্রবল আত্মাভিমানী যে সে-ও বিশ্বের সার্বজনীন যে নীতি তার কাছে নতিস্বীকার করে নিজেকে মুক্ত করে। বিশ্বে মুক্ত হয়। ছুটি পায়।
অজ্ঞানতার মধ্যে একটা সন্তুষ্টি আছে। সে সন্তুষ্টি – অবোধ আত্মতুষ্টি। সেকি চিরটাকাল থাকে? থাকে না তো। একদিন হঠাৎ তার চোখ খুলে যায়, সে দেখে তার জ্ঞান, তার বুদ্ধি, তার নীতিবোধ, তার ঠিক-বেঠিকের হিসাব বড় দীন, বড় অকিঞ্চিৎকর। তার আত্মতুষ্টি দূর হয়। সেটা অত্যন্ত যন্ত্রণার অবশ্যই, কিন্তু সাথে সাথে অনির্বচনীয় জ্ঞানের সামনে দাঁড়িয়ে এই যে আত্মবোধ লাভ হয়, তার কাছে সে মাথা না নীচু করেও পারে না। সে বলে, ভাগ্যে তুমি এলে বলেই আমার এই জেগে ঘুমানোর পালা চুকল। সে নত হয়, তার মধ্যে অসীমের তৃষ্ণা জাগে, তার সুখ যায়, সে আনন্দ পায়। এই যেন চলার আনন্দ।
কিন্তু এ কি চাইলেই হয়? হয় না। ওই ত্রিবিধ সুখের অর্থাৎ শারীরিক, নিরাপত্তার আর খ্যাতি-মানের সুখের মোহ না কাটলে হয় না। সুখের জন্য সে সঙ সাজে, রঙ মাখে, মহত্বের ভান করে, মহানুভবের ভান করে, অনুকম্পার অভিনয় করে, কিন্তু অবশেষে ক্ষুণ্ণ অথবা প্রবল অবোধ আত্মতুষ্টি ব্যতীত কিছুই নিয়ে ঘরে ফেরে না। সব অভিনেতাই যা চায়, সে-ও শেষে তাই-ই চায় – একটু হাততালি, একটু তোষামোদ, একটু পুষ্পবৃষ্টি।
বৈষ্ণব সাহিত্য এক নতুন দর্শন এনে দিল। ভারতের অন্যান্য দর্শনে জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে, কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে। জ্ঞানে বলা হয়েছে নিজের মধ্যে বিশ্বসত্তার অনুভবে নিজের বোধকে প্রসারিত করার কথা। কর্তব্যের বোধে বলা হয়েছে, নিজেকে সম্পূর্ণ স্বার্থমুক্ত করে সমাজের কল্যাণে আত্মযুক্ত হওয়া। বৈষ্ণব সাহিত্য বলল, ভালোবাসার মাধুর্যকে নিজের সুখের প্রতিকূলে নিয়োজিত করার কথা। সে পরম সুখকে তার বৈষয়িক জ্ঞান আর বৈষয়িক সুখ – দুইয়ের পারে নিয়ে গেল শুধু না, সামাজিক বিধিনিষেধের বাইরে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার স্পর্ধা দেখালো। বলল, যে ভালোবাসায় কোনো স্বার্থসুখ নেই, সেই ভালোবাসার কোনো নীতিনিয়ম নেই। এই ভালোবাসার রূপ আর মাধুর্যের আস্বাদনেই তোমার মুক্তি। অবশ্য সে 'মুক্তি' শব্দটাকেও এড়িয়ে গেল। কারণ 'মুক্তি' শব্দটা অনেকটাই নিষ্কৃতি পদবাচ্য সেখানে। তাই এ যেন দুর্বলের কথা। সবলের কথাটা কি তবে? সে বলে, “তোমার অভিসারে যাব অগম-পারে / চলিতে পথে পথে বাজুক ব্যথা পায়ে।।”... সে বলে, “আমি শুচি-আসন টেনে টেনে বেড়াব না বিধান মেনে, / যে পঙ্কে ওই চরণ পড়ে তাহারই ছাপ বক্ষে মাগি।।... আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী।”... সে বলে, “আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়। / আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যে জন ভাসায়।।"
এ-ও আনন্দের পথ। নিজের সুখের কারাগারে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে সেই আনন্দের দিকে এগিয়ে চলা, যে আনন্দে আমি নিঃস্ব হয়ে পূর্ণ হব। যে সুখের কোনো শরীর নেই, উপাধি নেই, আছে মগ্নতা।
সেদিনের সেই বৈষ্ণব সাহিত্যের ধারাকেই একালের রবীন্দ্রনাথে পেয়েছি। ভানুসিংহ'র স্লেটের পাশে বসেছি, যে বালক লিখছে, “গহনকুসুমকুঞ্জ-মাঝে”, যে জ্ঞানী লিখছেন, “যে আছে মাটির কাছাকাছি, / সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি।"
এ দর্শনের একই সূত্র আরেকজন আত্মমগ্ন পাশ্চাত্যবাসী মহাত্মা তার সারা জীবনে যুক্তির সাথে যুক্তি মিলিয়ে পাকা রাস্তায় হাঁটার আলো দেখিয়ে গেলেন – তিনি ইম্যানুয়েল কান্ট। এরা ছিলেন বলেই বলে বাঁচা। বাঁচতে শিখতে চেষ্টা করা। উড়ে আকাশ শেষ করব এমন ধৃষ্টতায় নয়, উড়ে পাখায় আরাম পাব, সেই সুখে। সেই কাঠবেড়ালির মত, যে সম্পূর্ণ সেতুটা একা বেঁধে দেবে এমন স্পর্ধা নিয়ে আসেনি, মহত্ত্বের মধ্যে নিজেকে স্বার্থরহিত নিয়োজিত করবে এমন একটা শুদ্ধ-ইচ্ছায় নম্র সুখে এসেছিল। সেই শুদ্ধ ইচ্ছাটাই চাবিকাঠি।
মানুষের নানাবিধ সুখের ফরমায়েশ। শরীরের সুখ, নিরাপত্তার সুখ বা সম্পদের, খ্যাতির সুখ। এর মধ্যে সম্পদের সুখ দুই সুখের যোগান দেয়, এক, খ্যাতি; দুই নিরাপত্তা। অপরদিকে এই সুখগুলোই মানুষকে বেঁধে ফেলে। সে গর্বের সাথে নিজের কাজের, ব্যস্ততার, যোগ্যতার, নাম-যশের মোহে নিজেকে চারদিক থেকে বেঁধে ফেলে, নিজেকে একজন বিশেষ কেউ অনুভব করে। কিন্তু এইখানেই শেষ নয়। যদি শেষ হত তবে মানুষের গৌরব বলে কিছু থাকত না। এই সুখের সাথে সাথে তার মধ্যে একটা কান্না জেগে ওঠে। মুক্তির কান্না। দুঃখের থেকে মানুষ নিষ্কৃতি পেতে চায়, কিন্তু সুখের থেকে সে পেতে চায় মুক্তি। তাই মুক্তির আকুতি এত তীব্র তার কাছে। কিন্তু এই মুক্তির শর্ত কি? কিম্বা মুক্তির সুখই বা কি?
দুইয়েরই প্রবল কথাটা হল – অধীনতা। মানুষ নিজেকে অধীন করে মুক্ত হয়। প্যারাডক্স? সে তো বটেই। কিসের অধীন হতে চায়? নিজের বিবেকের শাসনের, সার্বজনীন ভালোবাসার। আরো সহজ করে বলতে চাইলে – সে সার্বজনীন হয়ে উঠতে চায়, নির্বিশেষ হয়ে উঠতে চায়। আর ‘বিশেষ’ হয়ে থাকার সুখ সে চায় না। “কেন আমায় মান দিয়ে আর দূরে রাখ?... অসম্মানে আনো টেনে পায়ে তব। / তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধুসর হব।।"
অত্যন্ত দুষ্ট, সমাজবিরোধী যেমন দেশের আইনের কাছে নতিস্বীকার করে সমাজে মুক্ত হয়, তেমন অত্যন্ত প্রবল আত্মাভিমানী যে সে-ও বিশ্বের সার্বজনীন যে নীতি তার কাছে নতিস্বীকার করে নিজেকে মুক্ত করে। বিশ্বে মুক্ত হয়। ছুটি পায়।
অজ্ঞানতার মধ্যে একটা সন্তুষ্টি আছে। সে সন্তুষ্টি – অবোধ আত্মতুষ্টি। সেকি চিরটাকাল থাকে? থাকে না তো। একদিন হঠাৎ তার চোখ খুলে যায়, সে দেখে তার জ্ঞান, তার বুদ্ধি, তার নীতিবোধ, তার ঠিক-বেঠিকের হিসাব বড় দীন, বড় অকিঞ্চিৎকর। তার আত্মতুষ্টি দূর হয়। সেটা অত্যন্ত যন্ত্রণার অবশ্যই, কিন্তু সাথে সাথে অনির্বচনীয় জ্ঞানের সামনে দাঁড়িয়ে এই যে আত্মবোধ লাভ হয়, তার কাছে সে মাথা না নীচু করেও পারে না। সে বলে, ভাগ্যে তুমি এলে বলেই আমার এই জেগে ঘুমানোর পালা চুকল। সে নত হয়, তার মধ্যে অসীমের তৃষ্ণা জাগে, তার সুখ যায়, সে আনন্দ পায়। এই যেন চলার আনন্দ।
কিন্তু এ কি চাইলেই হয়? হয় না। ওই ত্রিবিধ সুখের অর্থাৎ শারীরিক, নিরাপত্তার আর খ্যাতি-মানের সুখের মোহ না কাটলে হয় না। সুখের জন্য সে সঙ সাজে, রঙ মাখে, মহত্বের ভান করে, মহানুভবের ভান করে, অনুকম্পার অভিনয় করে, কিন্তু অবশেষে ক্ষুণ্ণ অথবা প্রবল অবোধ আত্মতুষ্টি ব্যতীত কিছুই নিয়ে ঘরে ফেরে না। সব অভিনেতাই যা চায়, সে-ও শেষে তাই-ই চায় – একটু হাততালি, একটু তোষামোদ, একটু পুষ্পবৃষ্টি।
বৈষ্ণব সাহিত্য এক নতুন দর্শন এনে দিল। ভারতের অন্যান্য দর্শনে জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে, কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে। জ্ঞানে বলা হয়েছে নিজের মধ্যে বিশ্বসত্তার অনুভবে নিজের বোধকে প্রসারিত করার কথা। কর্তব্যের বোধে বলা হয়েছে, নিজেকে সম্পূর্ণ স্বার্থমুক্ত করে সমাজের কল্যাণে আত্মযুক্ত হওয়া। বৈষ্ণব সাহিত্য বলল, ভালোবাসার মাধুর্যকে নিজের সুখের প্রতিকূলে নিয়োজিত করার কথা। সে পরম সুখকে তার বৈষয়িক জ্ঞান আর বৈষয়িক সুখ – দুইয়ের পারে নিয়ে গেল শুধু না, সামাজিক বিধিনিষেধের বাইরে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার স্পর্ধা দেখালো। বলল, যে ভালোবাসায় কোনো স্বার্থসুখ নেই, সেই ভালোবাসার কোনো নীতিনিয়ম নেই। এই ভালোবাসার রূপ আর মাধুর্যের আস্বাদনেই তোমার মুক্তি। অবশ্য সে 'মুক্তি' শব্দটাকেও এড়িয়ে গেল। কারণ 'মুক্তি' শব্দটা অনেকটাই নিষ্কৃতি পদবাচ্য সেখানে। তাই এ যেন দুর্বলের কথা। সবলের কথাটা কি তবে? সে বলে, “তোমার অভিসারে যাব অগম-পারে / চলিতে পথে পথে বাজুক ব্যথা পায়ে।।”... সে বলে, “আমি শুচি-আসন টেনে টেনে বেড়াব না বিধান মেনে, / যে পঙ্কে ওই চরণ পড়ে তাহারই ছাপ বক্ষে মাগি।।... আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী।”... সে বলে, “আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়। / আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যে জন ভাসায়।।"
এ-ও আনন্দের পথ। নিজের সুখের কারাগারে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে সেই আনন্দের দিকে এগিয়ে চলা, যে আনন্দে আমি নিঃস্ব হয়ে পূর্ণ হব। যে সুখের কোনো শরীর নেই, উপাধি নেই, আছে মগ্নতা।
সেদিনের সেই বৈষ্ণব সাহিত্যের ধারাকেই একালের রবীন্দ্রনাথে পেয়েছি। ভানুসিংহ'র স্লেটের পাশে বসেছি, যে বালক লিখছে, “গহনকুসুমকুঞ্জ-মাঝে”, যে জ্ঞানী লিখছেন, “যে আছে মাটির কাছাকাছি, / সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি।"
এ দর্শনের একই সূত্র আরেকজন আত্মমগ্ন পাশ্চাত্যবাসী মহাত্মা তার সারা জীবনে যুক্তির সাথে যুক্তি মিলিয়ে পাকা রাস্তায় হাঁটার আলো দেখিয়ে গেলেন – তিনি ইম্যানুয়েল কান্ট। এরা ছিলেন বলেই বলে বাঁচা। বাঁচতে শিখতে চেষ্টা করা। উড়ে আকাশ শেষ করব এমন ধৃষ্টতায় নয়, উড়ে পাখায় আরাম পাব, সেই সুখে। সেই কাঠবেড়ালির মত, যে সম্পূর্ণ সেতুটা একা বেঁধে দেবে এমন স্পর্ধা নিয়ে আসেনি, মহত্ত্বের মধ্যে নিজেকে স্বার্থরহিত নিয়োজিত করবে এমন একটা শুদ্ধ-ইচ্ছায় নম্র সুখে এসেছিল। সেই শুদ্ধ ইচ্ছাটাই চাবিকাঠি।