সত্য, সত্যের প্রলেপ? এই যে বলে না রাতদিন লোকে, এ মায়া, সে মায়া, এটা নাকি মোহ, সেটা নাকি মোহ… যেন সব শুদ্ধ একটা মিথ্যার কারখানা। আর আমরা রাতদিন ঠকে মরছি। কথাটা কি তাই?
আপাতভাবে তাই বলা হয়। আর যারা নাকি এসবের পারে গেছে তারা গোঁফে চাগাড় দিয়ে বলে, হে হে… এখনও মায়ায় বদ্ধ!
একজন আলপনা দিল। তুমি সেই আলপনাকে কি চালের গুঁড়ো বলবে, না সে আলপনার মাধুর্যে মুগ্ধ হবে? একদল বলবে, ওই মাধুর্যটা হল গিয়ে মিথ্যা, আর চালের গুঁড়োটাই সত্য। কথাটায় মিথ্যা কিছু নেই। আবার সত্যও সবটা নেই। চালের গুঁড়ো যা মেঝেতে বিস্তারিত হয়ে আছে, সেটুকু যখন মানুষের চোখের ভিতর দিয়ে মাথায় যায় তখন মানুষের মস্তিস্ক তাকে এক মাধুর্যে দেখে। এ তো স্বতঃপ্রমাণ।
একজন গয়না বিক্রি করতে এসে বলছে, হ্যাঁ গো গয়না নেবে? মানুষের গয়নাও আছে, আবার ভগবানের গয়নাও আছে। নেবে?
কথাটা কানে বাজল। হাসিও পেল, আবার বিস্ময়ও লাগল। মানুষের কল্পনা কতদূর তাকে নিয়ে যায়। এই কল্পনার আকরিকেই তার সুখ। আবার এই কল্পনার আকরিকেই তার ভয়। ঈশ্বরকে গয়না পরাবে। এ তার সুখ। আবার ঈশ্বরকে নির্দিষ্ট তিথিতে সময় মত আদরযত্ন না করলে তিনি চটবেন, এ তার ভয়। দুই-ই তার কল্পনায়। কিন্তু সে কল্পনা তার এমন নিজস্ব যে সে তাকে তর্কাতীত, অনির্বচনীয় সত্য বলে জানে।
এই কথাটাই সংসারে এক বড় কথা - নিজস্ব। আমার। সাধকেরা বলেন, এই "আমি আর আমার" এই হল মায়া। আমাদের সব দুঃখের মূল। কিন্তু এও গোটা কথাটা নয়। এ আমাদের সব দুঃখের মূল তো বটেই, আবার সুখেরও মূল। এককে ছেড়ে আরেক থাকে নাকি?
মানুষের সত্য তাই দুটো। এক তার নিজস্ব সত্য। আর দুই এই জাগতিক সত্য। জাগতিক সত্যে সে আধার কার্ডের একটা নাম্বার। একজন ভোটার। একজন রুগী। একজন শিক্ষক। একজন ব্যাঙ্কের কর্মী ইত্যাদি। কিন্তু নিজস্ব সত্যে সে নিজের কাছে নিজে কি? একটা গোটা জগত। তার নিজস্ব পরিবার, বাড়ি, গাড়ি, বাগান, শখ, বিশ্বাস ইত্যাদি সবই তার নিজস্ব সত্য। যা তার সিদ্ধান্তকে, জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।
সেকি জানে না তার নিজস্ব সত্য ভঙ্গুর। খুব জানে। কিন্তু সে চিরস্থায়ী কোনো কিছুর চাইতে, তার আয়ত্তের মধ্যে এই ভঙ্গুর সত্যকেই চায়। এ তার নিজের। এইতেই তার সুখ। নিজেকে আত্মীয়স্বজন, স্থাবর-অস্থাবরের মধ্যে প্রসারিত করে তাকে রক্ষা করার গুরুদায়িত্ব নিয়ে সে জীবনের একটা মানে খুঁজে পায়। এসব কেড়ে নিয়ে তাকে শুধু চালের গুঁড়ো দেখালে জীবন কাটবে তার? তার আলপনাকে ব্যঙ্গ করে, একটানে মুছে ফেলে তাকে অপদস্থ করে কি সুখ? বরং যে একদিন আলপনা মুছে যাবে জেনেও নিত্য আলপনা দেয় সে-ই তো আসল বীর। নইলে প্রকৃতিও যদি জ্ঞানীপণ্ডিতের মত শুধুই নিত্যে স্থির হবে সিদ্ধান্ত নিত, তবে গাছে ফুল ফুটত না, সমুদ্রে ঢেউ উঠত না, আকাশে রামধনু উঠত, কোনো প্রাণ মরণশীল শরীর আশ্রয় করে জন্ম নিত না।
আলপনার এই সুখকে একদল বলল, লীলা। মানে এক খেলা। তারা আরো এগিয়ে বলল, জগতের যে নিত্য সত্য, তাকেও তোমার খেলায় অংশ নেওয়াতে পারো। তার সঙ্গে একটা সম্পর্ক বানাতে পারো। এই যেমন, দুর্গা তোমার মেয়ে; এই যেমন, মা কালী তোমার মা; এই যেমন, কৃষ্ণ তোমার সখা, প্রভু; মহাদেব তোমার পিতা। আবার মরমী সুফী বলল, সে আমার প্রিয়তম। আমার প্রেম। কবীর বলল, হ্যাঁ। বুদ্ধ বলল, না না, এসব থেকে বেরিয়ে এসো। বৌদ্ধ বলল, সে হবে না, তবে তুমিই আমার প্রভু। আমার আশ্রয়। বুদ্ধং শরণম্ ইত্যাদি। খ্রীষ্ট বলল, সে প্রভু। মহম্মদ বলল, সে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। এই তার বাণী।
এই শুরু হল গোল। কার আলপনা শ্রেষ্ঠ যখন এই নিয়ে গোলমাল শুরু হল, তখন আবার আগের পক্ষ এসে বলল, দেখেছ, এই জন্যেই বলেছিলাম সব আসলে চালের গুঁড়ো, তাই বলো না কেন?
তখন আরেকদল এসে বলল, আরে ভাই তোমরা গোঁড়ামি ছাড়ো। মাধুর্য যদি নানা বৈচিত্র্যে আসে, নেবে না কেন? অন্ধের হাতি দর্শনের গল্প এলো। অনেকে বুঝল। অনেকে বুঝল না। অনেকে বুঝেও না বোঝার ভান করল। আবার অনেকেই বুঝতেই চাইল না।
যাক গিয়ে এসব কথা। কিন্তু আমার সুখ-দুঃখের যে কথাটা হচ্ছিল সেটায় আসা যাক আবার। এই যে বলছিলাম না নিজস্ব সত্যের কথা, তো নিজস্ব সত্যকে কি মানুষ ধ্বংসাত্মক বানাতে পারে? পারে তো। আর পারে বলেই মানুষ মাঝে মাঝে এত বিধ্বংসী খেলায় মেতে ওঠে। যারা প্রকৃতি বিজ্ঞান পড়েছে তারা জানে মানুষের কুকীর্তির জন্য জগতে যে বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ও হয়ে চলেছে তাকে 'সিক্সথ্ এক্সটিনশান' বলে। মানে ষষ্ঠ মহাবিলুপ্তি। বাকি পাঁচটা আমাদের জন্য হয়নি, সেগুলো প্রকৃতির নিজের খেয়াল ছিল। কিন্তু আমাদের দায় তো আমাদের নিতেই হবে বলো। আমাদের ওই আলপনা দেওয়ার হাত যখন লোভের হাতে চলে যায় তখন আর আলপনা মাধুর্য সৃষ্টি করে না। সে তখন আঁকে বিধ্বংসী সংকেত। জ্ঞানী বলেন, মোহ হল সব রোগের মূল। মিথ্যাকে সত্য বলে জানা। ক্ষুদ্রকে বড় করে জানা। কেন্দ্রকে পরিধি আর পরিধিকে কেন্দ্র করে জানা। ঢেউকে সমুদ্র বলে জানা। শিখাকে আগুনের উৎস বলে জানা। এ সবই মোহ।
মোহ আছে বলেই এত ধ্বংসলীলা চলছে জগত জুড়ে। সে রাশিয়া-ইউক্রেনই বলো আর নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগই বলো। মানুষ চাইলেই কি আর দায় এড়াতে পারে এখন? পারে না। যাদের মোহ ভেঙেছে তারা বারবার সতর্ক করে চলেছে। কিন্তু কে শুনবে কার কথা? সেদিন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে এত ক্ষয়ক্ষতিই হত না যদি কৃষ্ণের সমঝোতা শর্তে ওরা রাজী হত। হল না। কোনোদিনই কেউ রাজী হয়নি।
তবে এই নিজস্ব সত্য আর মোহের মধ্যে পার্থক্য কি? একটা নরম বোধের পার্থক্য। নিজস্ব সত্য যখনই ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে, আমাদের মধ্যে এক নরম বোধ আমাদের সতর্ক করে দেয়। যদি শুনি, তবে আমাদেরই ভালো। আর যদি শুধু "আমার" ভালো বলে সে সতর্কবাণী অতিক্রম করি তবে সে-ই হয় মোহের ধ্বংসলীলা।
এই 'নরম বোধ' কি? কেউ বলে 'বিবেক'। কেউ বলে 'মানুষের ধর্ম'। কেউ বলে 'তাঁর বাণী'। নাম যাই হোক, এই নরম বোধেরই রাজনীতিতে, সমাজনীতিতে আরেক নাম এসেছে, সফট্ পাওয়ার। এ-ও শক্তি। এ-ই চিরকালের শক্তি।
"ধাইল প্রচণ্ড ঝড়, বাধাইল রণ—
কে শেষে হইল জয়ী? মৃদু সমীরণ।"