"Physical science will not console me for the ignorance of morality in the time of affliction. But the science of ethics will always console me for the ignorance of the physical sciences." ~ Pascal
একটা কথা বারবার গুলিয়ে যাচ্ছে, মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে তো মেধার কোনো সম্পর্ক নেই। 'চরিত্র' আর 'মেধা' কি এক জিনিস? তা তো নয়। সমাজে নিশ্চয়ই মেধার প্রয়োজন আছে। এই যে আমি টাইপ করে এখন লিখছি, সেটা মুহূর্তে একটা আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে চলে আসছে, এ তৈরির জন্যে অবশ্যই মেধার প্রয়োজন। কিন্তু আমি এখানে প্রোভোকেটিভ, নিন্দাত্মক, অবমাননাকর, অপমানসূচক কিছু লিখব, না পজিটিভ কিছু লিখব সেটা তো আমার চরিত্রের উপর, আমার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নির্ভর করছে।
আজ যে সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে রাজ্য জুড়ে সেখানে বারবার মনে হচ্ছে 'মেধা' আর 'চরিত্র' দুটো আপাত যুযুধান বস্তু। যেন একে অন্যের সম্পূরক। তা তো নয়। দুটোরই দরকার আছে। আমি ভীষণ মেধাবী হতেই পারি, না-ও হতে পারি। কিন্তু ভালো মানুষ না হলে সবটাই জলে। ভালো মানুষ হওয়াটা সামাজিক হওয়ার প্রথম শর্ত। আমি যদি সামাজিক মনটাকে সুস্থ গড়ে তুলতে না পারলাম, দুর্বলকে দেখলেই যদি আমার সমস্ত সত্তা জুড়ে বিকার জেগে ওঠে, তবে আমি কি নিজের জন্যেই নিরাপদ? তা তো নয়! এরকম বিকারগ্রস্ত কিছু মানুষ যদি আমরা দল পাকিয়ে একটা স্বতন্ত্র কিছু গড়ে তুলি তবে সেটা ভয়ংকর কিছু হবেই। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অদ্ভুত সব ধর্মীয় সংগঠন গড়ে উঠেছে মাঝে মাঝে যারা নিজেদের সব আইনকানুন, রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদির ঊর্ধ্বে ভেবেছে। তারা নিজেদের আলাদা নিয়ম বানিয়েছে, গোষ্ঠী বানাতে চেয়েছে। ক্রমে কিছু মানুষের স্বেচ্ছাচারিতায়, ব্যভিচারিতায় ভরে উঠেছে তাদের গোষ্ঠী। খুন-খারাপি তো ঘটেইছে, এমনকি গণ-আত্মহত্যাও ঘটেছে সে সব ধর্মীয় সংগঠনে।
একদিন রবীন্দ্রনাথ একটা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সেও আবার পরাধীন ভারতে। আজকের কথা বলছি না। সেদিন তিনি যে কয়েকটা দিককে প্রাথমিক, মূল জেনেছিলেন তার মধ্যে অগ্রগণ্য ছিল মানুষ গঠন। সেদিন সে প্রতিষ্ঠান থেকে যত মৌলিক ভাবনা নানা পরিসরে জন্মেছিল তা ইতিহাস। মেধা আর চরিত্রের সমন্বয় না ঘটালে যে আমাদের ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই, সেটা সময়ে কেন, আজও চিন্তাশীল মানুষমাত্রেই মনে করেন। 'হু' যখন স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা তৈরি করে তখন তাই ব্যক্তিগত, সামাজিক, মানসিক স্বাস্থ্যের কথা উল্লেখ করে বলে যে শুধু নীরোগ থাকা মানেই স্বাস্থ্য নয়। তুমি সামাজিকভাবে ও ব্যক্তিগত জীবনে কতটা সমীচীনতায় প্রতিষ্ঠিত সেটাও দেখার।
নোম চোমস্কিকে যখন মানুষের মূলগত চরিত্রের প্রশ্ন করা হচ্ছে, উনি বলছেন, একটা বাচ্চা রাস্তায় বসে ক্যাণ্ডি খাচ্ছে, তুমি যতই ক্ষুধার্ত হয়ে থাকো না কেন তুমি ওটা কেড়ে নেবে না এটাই তোমার মনুষ্যত্ব।
মানুষের প্রকৃতিতে বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা আছে। কিন্তু সেটাই তার সবটুকু নয়। বারবার সেটাকে সরিয়ে সে নিজের ধর্মে ফিরতে চেয়েছে বলেই সমাজ এগিয়ে চলেছে। নানা রাজনৈতিক আদর্শ, ধর্মীয় আদর্শ আছে, সামাজিক ভাবনারও নানা বৈচিত্র্য আছে। কিন্তু কেউ-ই মানুষের একান্ত অমঙ্গলকে তার কেন্দ্রীয় ভাবনা বলে ঘোষণা করে না। সবারই লক্ষ্য মানুষের সার্বিক স্বাধীনতা আর মানুষের সামগ্রিক বিকাশের অনুকূলতা। সেটা গড়ার জন্য আমাকে বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী বানাতে হবে কেন? বারবার নিজের মেধার বিজ্ঞাপন করতে হবে কেন? মেধার ঔজ্জ্বল্যে কি অপরাধপ্রবণতা ঢাকা যায়? যা অন্যায় তা অন্যায়। তা কি মেধার মাত্রা দীর্ঘ হলে শাস্তির মাত্রা কমে যায়? একজন অশীতিপর নোবেলবিজয়ী দার্শনিক তথা অর্থনীতিবিদকেও আমরা থানা-পুলিশ, আইন-আদালতের কাগজ ধরাচ্ছি শুধু আইনের যুক্তি দেখিয়ে। তবে একটা প্রতিষ্ঠানে এতদিন ধরে এত এত অন্যায় ঘটে চলেছে নাকি, অথচ সবাই চুপ! রামকৃষ্ণদেব বিবেকহীন-দয়ামায়াহীন পাণ্ডিত্যকে শকুনের সঙ্গে তুলনা করতেন। বলতেন, শকুন অনেক উঁচুতে ওড়ে, কিন্তু দৃষ্টি থাকে ভাগাড়ে। যদি গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা থাকে, তবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মেধাও তার জ্বালা আর অপমান ঢাকতে পারে না। তোমার মেধাকে আমার সম্মান জানাতে ধিক্কার!