Skip to main content
হে মহামরণ

 

 

মানুষ যখন জন্মায় তখন সব মানুষই সাধারণ, যখন ইহলোক ত্যাগ করে যায় তখন সবাই সাধারণ না। তাই যিনি জন্মেছিলেন তিনি আর পাঁচটা সাধারণ শিশুর মতই - ঈশ্বরচন্দ্র, আর যিনি আজকের দিনে সংসার ত্যাগ করে গেলেন তিনি বিদ্যাসাগর, তথা করুণাসাগর। তিনি আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মত না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তিনি যা করলেন, বললেন, ভাবলেন - পরকালের না। রহস্যময়তার না। পলায়ন প্রবৃত্তির না।
এই কথাটা বোঝা আমাদের সমাজে খুব শক্ত। কারণ আমাদের ধর্ম-দর্শনের বাস্তব রূপটা অনেকটা অন্যলোক বা পরলোক বা Other World সংক্রান্ত চিন্তাভাবনায় বেশি মগ্ন। যদিও দর্শনের গভীরে গেলে তা বলে না। সে অন্য কথা। সেই যুক্তির কাটাকাটিতে যাচ্ছি না। সে অন্য কোনো লেখার বিষয় হতে পারে। এখন না।
আমাদের ইতিহাসের দিকে তাকালে একজন মানুষের মুখ খুব তীব্রভাবে ভেসে আসে – বিদ্যাসাগর। আমি দেখিনি, আমার বাবা দেখেননি, আমার ঠাকুর্দা দেখেননি তাঁকে। ইন্দ্র মিত্র দেখিয়েছেন। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
কথা হল, এই মানুষটা আমাদের পূজা-জপ-তপ-কীর্ত্তন কিচ্ছু শেখাননি। নিজেকে অবতার ঘোষণা করেননি। কোনোরকমের ঈশ্বরত্বের মোহ বা আবেশ তাঁকে ঘিরে সৃষ্টি হয়নি। পরকালের কিছু সুরাহা হয় এমন কোনো মতলবের পথ দেখিয়ে যাননি – অগত্যা, অতএব ওনাকে ভোলা আমাদের অনেক সহজ হয়ে গেল।
আমাদের এখানে স্মরণে মননে থাকতে গেলে কিছু গুণাবলী থাকা প্রয়োজন।

১) দেবময়তাঃ বেশি না, অন্তত জীবনে একবার সমাধি হলেই হবে। কিছু রহস্যময় কথা বলতে হবে। যেগুলো শুনতে মধুর, বুঝতে ধোঁয়াশা, আর করতে...? করতেই হয় না। আহা সমর্পণ করা হয়ে গেছে যে গুরুকে, এবার যা হবে ওনার কৃপায়।

বিদ্যাসাগর ফেল। এগুলোর কোনোটাই সারাজীবনে হয়নি। উল্টে বলা হয়েছে, বেদ উপনিষদ মাথা খারাপ লোকেদের রচনা। না হলে এত এত যন্ত্রণা মানুষের তার (ভগবানের) চোখে পড়ে না!
২) পরকালের আশ্বাসঃ কোনো অসুবিধা হবে না সেখানে। টুক করে চোখ বুজে একটু কষ্ট করে মরতে হবে, তারপর সেখানে হোটেল বুক করা থাকবে। গুরুর নাম নাও আর সেঁধিয়ে পড়ো। কেল্লা ফতে!
বিদ্যাসাগর মহাশয় এতেও ফেল।
৩) বিপদে আপদে রক্ষা করার পুরো গ্যারান্টিঃ যেখানেই হোক... ট্র্যাফিকে, আমাজনে, প্রশান্ত মহাসাগরে, নিউ ইয়র্কে, কি গোবিন্দপুরে ইত্যাদি। সব পাপ হরণ হয়ে যাবে। মালা কবচ, নাম, কিম্বা যাগযজ্ঞ ইত্যাদির যে কোনো একটাতে।
বলা বাহুল্য, এ সবেও আমাদের আলোচ্য মানুষটা ফেল।
আর অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে নায়ক, বা গায়ক তো তিনি নন-ই। সুতরাং সেই সুবাদেও মনে পড়ার কথা না। একবার সুনীল গাঙ্গুলি মশায় বলেছিলেন, রবি ঠাকুর যদি কয়খানা গান লিখে না যেতেন, তবে ওকেও মনে রাখত কিনা সন্দেহ। রাখত হয় তো, নামের সাথে একটা ‘গুরুদেব’ কথাটার যোগ আছে না!

বিদ্যাসাগর কোনো মানুষের নাম তো ঠিক না, একটা বিশেষ ধরণের চরিত্রের নাম। যে চরিত্রটা আমাদের দেশের সাথে ঠিক যায় না। কথা হল কেন যায় না? কি এমন শেখাতে এসেছিলেন যাতে অসুবিধা হল?

সর্বপ্রথম হল, অতিরিক্ত ইহকালসর্বস্ব কর্ম ও দর্শন। যেটাতে আমরা স্বচ্ছন্দ্য বোধ করি না খুব একটা। কোনো metaphysical কথা নেই। দুঃস্থ, গরীব, অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। তার উদাহরণ লিখতে বসলে আর এ প্রবন্ধের সীমা পরিসীমা থাকবে না। একটা অতি ক্ষুদ্র উদাহরণ দিই।
এক ধনী ব্যক্তির বাড়িতে বসে আছেন। উচ্চদর্শন নিয়ে আলোচনা চলছে। নীচে রাস্তা থেকে একজন ভিখারি ডেকে যাচ্ছে। উনি শুনছেন। খেয়াল করছেন, গৃহস্বামীর কোনো হেলদোল নেই। সে ডেকেই যাচ্ছে কাতর স্বরে নীচের থেকে। এবার গৃহস্বামী বিরক্ত হচ্ছেন। ভিখারি চলে গেল।বিদ্যাসাগর উঠে দাঁড়ালেন, গৃহস্বামী কিছু বোঝার আগেই তিনি রাস্তায় এসে গিয়েছেন। দৌড়ে সেই ভিখারিকে ধরলেন। তাকে বললেন, তোকে একটা টাকা দিতে পারি, যদি তুই আমার একটা কথা রাখিস। সে বলল, কি? বিদ্যাসাগর সাশ্রুনয়নে বললেন, তুই এই পাষণ্ডের বাড়ি কোনোদিন ভিক্ষা চাইতে আসবি না, আমিও এই বাড়ি আর আসব না কোনোদিন। বলেই হাঁটা লাগালেন।
এরকম অজস্র ঘটনা আছে। তা কবিকল্পনা না। আমার হাত নিশপিশ করছে আরো কিছু লিখতে। না, আর না। প্রসঙ্গে ফিরি।
তারপর যুক্তিনির্ভরতার শিক্ষা। এটা আমাদের সাথে যাওয়া খুব কঠিন ব্যপার। অদৃষ্ট মানি, কৃপা মানি – যুক্তি আবার কি? তাতে কি এই ভবরহস্য ভেদ করা যায়?
না যায় না। উনি চানও নি তা। তবে এখানে আশ্চর্য লাগে ওনার মায়ের কথা ভেবে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত ‘বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধে তাই শুরুতে ওনার মায়ের কথা বলেছেন, অত্যন্ত সকরুণ মর্মস্পর্শী সে বর্ণনা। সে গল্পও আমরা অল্পবিস্তর জানি। সেই গ্রামের সবার কম্বল হলে ওনার নিজের কম্বল নেওয়া, গ্রামে একটা শিক্ষাসত্র খুলে দিলে দূর্গাপূজা না করলেও চলে – বলার মত সাহসী মহিলা ক'জন ছিলেন এ পোড়ার দেশে?
যেটা নিয়ে খুব বলা হয় বিধবা বিবাহ প্রচলন, সেটা অবশ্যই খুব গুরুত্বপুর্ণ ঘটনা তবে তা আমার কাছে শূধুমাত্রই ওর মহৎ চরিত্রের বহিরঙ্গের ঘটনা। আসল কথাটা হল, মেয়েদের অবস্থাটা বুঝতে পারা। অনুভব করতে পারা। মর্মে গিয়ে সে যন্ত্রণায় বিদ্ধ হওয়া।
প্রবল বর্ষা। সন্ধ্যে পার হয়ে গেছে। রাস্তা শুনশান। এক সমাজে পতিতা রমণী খদ্দেরের আশায় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ভিজছেন। একটা মানুষ আসছে দেখে সে পিছু নিল। মানুষটা তাকে প্রত্যাখ্যান করল। সে তবু পিছু নিল। বলল সে না সাড়া দিলে তার অসুস্থ বাচ্চাটার চিকিৎসার, খাবারের টাকা পাবে কোথায়?
লোকটা ঘুরে দাঁড়াল। সে রমণী বুঝল কি না জানি না, সেই মানুষটার চোখ থেকে দরদর করে যে জল পড়ছে, সেটা বৃষ্টির জল না। সে তাকে ক'টা টাকা দিয়ে বলল, আপনি ফিরে যান মা, আর দাঁড়াবেন না। তারপর যে যন্ত্রণা নিয়ে সে মানুষটা ফিরে গিয়েছিল, সে যন্ত্রণার জন্যই সে শুধু বিদ্যাসাগর না, করুণাসাগরও বটে। তার বাকি কাজগুলো তো সে যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। মহৎ কাজ তো কত হয় চারদিকে দেখি, চাঁদা তুলে, মাইক নিয়ে, সেইরকম চোখের জল কই? বুকফাটা হাহাকার কই? তাই প্রকল্প হয়, উন্নতি হয় না। সেবা হয়, অগ্রসর হয় না।
পরবর্তী প্রজন্মের কত বড়মাপের লেখক, কত সাহিত্যিক, ছাত্র যে জলের তোড়ে ভেসে যেত সে সময় উনি পাশে না থাকলে সে ভাবতেও গা শিউরে ওঠে।
একটু প্রসঙ্গান্তরে বলি, কৈলাশ সত্যার্থীর ফেসবুক পেজটা ঘুরে আসবেন। দেখবেন তার একটা পোস্টে কি আশ্চর্যজনক কম লাইক, কমেন্টস পড়ে। কারণ? ওই যে বললাম, আমাদের ওতে রুচি নাই। ভদ্রলোক নোবেল পাওয়ার আগে অবধি ক'টা কাগজ ওনার সম্বন্ধে আমাদের জানাবার প্রয়াস নিয়েছে? লজ্জা লেগেছিল যে নোবেল পাওয়ার আগের দিন অবধিও এই মানুষটাকে চিনতাম না। এটা লজ্জার।
বুদ্ধ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধীর যে সব কথা যুক্তির, স্ব-পরিশ্রমের উপর নির্ভর করে, আমরা সেই সব উপদেশ আচ্ছা করে ঝেঁটিয়ে দূরে রাখতে পছন্দ করি। আর বিদ্যাসাগরের তো পুরোটাই সেই কথা। রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তি, বাঙালী গড়তে গড়তে বিধাতা যে কি করে একটা বিদ্যাসাগর বানিয়ে ফেললেন আশ্চর্যের!
এই লেখার কোনো উপসংহার হয় না। বেশ কয়েক বছর আগে বিদ্যাসাগরের উপর একটা জীবনী বইমেলাতে কিনছিলাম। ইংরাজীতে। কারণ আমার ধারণা ছিল, বাংলায় লেখাগুলো বড্ড একপেশে। হয় অতিভক্তি, নয় বড্ড নীরস। ভাসা ভাসা। পাশে দাঁড়ানো মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক আমায় রীতিমতো ধমক দিলেন – ইন্দ্র মিত্র পড়েছেন? বললাম, না। আরো জোরে ধমক, যান এখনই ‘আনন্দে’, কিনুন।
কিনলাম। পড়লাম। সেদিন থেকে সেই অচেনা ভদ্রলোককে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই। এইভাবে এক জীবনী লেখা যায়!
আমি আমার ছোট বড় সকল বন্ধুদের করজোড়ে অনুরোধ জানাই, বইটা জীবনে একবার অন্তত পড়ে নেওয়ার জন্য। না হলে সত্যিই ক্ষতি।

 

(করুণাসাগর বিদ্যাসাগরঃ বইটির পিডিএফ লিঙ্ক)
(আজ এই মহাপ্রাণের মহাপ্রয়াণের দিন)

(ছবিঃ আন্তর্জালতন্ত্র)