সৌরভ ভট্টাচার্য
27 May 2018
আমার ছোটোবেলায় যখন ক্যাসেটের দোকানে যেতাম তখন ক্যাসেটের সারিতে কয়েকটা নজরুলগীতির ক্যাসেট থাকত – পূরবী দত্ত, ফিরোজা বেগম, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রাণী সেন, ড: অঞ্জলি মুখোপাধ্যায় ইত্যাদি। কিন্তু আজ যখন সিডির দোকানে যাই সেই অর্থে নজরুলগীতির সিডি প্রায় চোখেই পড়ে না। আর আজকের দিনের কয়েকজন নজরুলগীতির গায়ক গায়িকার নাম বলতে বললেও ক'জন বলতে পারবেন তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ। অবশ্যই এদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কথাগুলো বলা। বাংলাদেশের ছবিটা অনেকটা অন্যরকম। সেখানে নজরুলের নামে প্রতিষ্ঠান আছে, স্বরলিপির শুদ্ধতা নিয়ে সিরিয়াস কাজ হয়, সঠিক অর্থে নজরুলের গান বিশেষ করে শিক্ষা-প্রচার-প্রসারের ব্যবস্থা আছে। কারণ অবশ্যই নজরুল সেখানে জাতীয় কবি তাদের। আমাদের সে বালাই বা দায় কোনোটাই নেই।
ধর্ম কি কোনো কারণ? ভারতের জলবায়ুতে ধর্মের গতায়াত অনেক গভীরে। তবে কি সেই কারণেই কিছুটা আত্মীয়করণের অভাব? তাই বা কিভাবে বলি? তবে গালিবের প্রতি ভারতের তথা বাঙালী বুদ্ধিজীবী মহলের এমন একটা টান কিভাবে আসে? অবশ্যই সে টান আসাটা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। সারা ভারতের গালিব এখনও নানা লেখায়, নানা প্রসঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছেন। গাওয়া হচ্ছেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে। কিন্তু নজরুল নয় কেন? নজরুল সে অর্থে বাঙলার গালিব হয়ে উঠলেন না কেন? আসলে বাঙালীর বুদ্ধিজীবী মহলে বা মননে নজরুলের সেই জায়গাটা কোনোদিন ছিল না, আর আজ তো নেই। তবে ওনার লেখার সঠিক অর্থে মূল্যায়ন হয়নি? নাকি নজরুলের জীবন দর্শন একটা বিশেষ সময়ের পরে তার প্রাসঙ্গিকতা হারালো? সেই অর্থে অবশ্যই সেই সময়ের আরো তিন কবির কথা আসে --- রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রনাথ। এদের মধ্যে অতুলপ্রসাদ আর রজনীকান্তের গানের চাহিদা বরাবরই একইরকম খানিক দেখে আসছি। খুব যে একটা বেড়েছে বা কমেছে আমার মনে হয় না। সেদিনও দেখেছি কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের বাইরে এদের গানের ধারক-বাহক কেউ ছিলেন না, আজও তেমন কেউ নেই। মাঝে নূপুরছন্দা ঘোষের কিছু মৌলিক চেষ্টা অবশ্য দেখেছিলাম। এ প্রসঙ্গে আরেকজনের কথা মনে পড়ল --- শ্রদ্ধেয় বিমান মুখোপাধ্যায়। একপ্রকার নজরুলের গানের এনসাইক্লোপিডিয়া। জানি না, তার প্রয়াণের পর তার শিষ্য-শিষ্যারা কতটা তার রক্ষণাবেক্ষণের চেষ্টায় আছেন। তবু মোট কথা এই তিন কবিও আজ বিস্মৃতির পর্যায়ে। কিছু কিছু রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মাঝে মাঝে অতুলবাবুর কিছু গান বার করে থাকেন এই যা। তাও অবশ্য ওদেশেই এখন বন্যা, অদিতি মহসীন ইত্যাদি। আগে কণিকা, সুচিত্রা কয়েকটা রেকর্ড করেছিলেন অতুলপ্রসাদের। কণিকার একটা নজরুলগীতিও শুনেছিলাম – 'চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়', আর 'কেউ ভোলে না কেউ ভোলে'। সে অন্যপ্রসঙ্গ।
আমাদের ছোটোবেলায় রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা পাড়ায় পাড়ায় হতে দেখতাম। আরেকটাও মজার কথা ছিল। আমি দেখেছি তখন দুটো দলও ছিল, একপক্ষের নজরুল, আরেকপক্ষের রবীন্দ্রনাথ। একটা বেশ রেষারেষির ভাবও ছিল। এমনকি তখনকার দিনের মোটামুটি এক খ্যাতনামা নজরুলগীতি শিল্পীকে এমনও বলতে শুনেছি, “রবীন্দ্রনাথ চাইলে নজরুলের নোবেল পাওয়াও হয়ে যেত। ওনার অনেক কানেকশান ছিল বিদেশে, আসলে জমিদার ছিলেন তো, তায় ব্যবসায়ী পরিবার, ওইতেই তো নোবেলটা উনি বাগিয়েছিলেন। আমাদের নজরুলের তো সে ভাগ্য ছিল না।“ এখন সে সব আর দেখি না। আধুনিক প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের দেখেছি তাও কয়েকটা রবীন্দ্রনাথের গান বলতে পারে, কিন্তু নজরুলের গান একটাও না। এক যদি না গান শেখে কিম্বা বাড়িতে চর্চা থাকে কারোর।
আমি সেই কারণটাই খুঁজতে চাইছি। কেন এরকম হল? চর্চাটা এত কমে গেল কেন? আমি সাধারণের কথা বলছি না। কারণ নজরুলের কয়েকটা নির্দিষ্ট কবিতা আর গান ছাড়া তার কি অবদান আছে বাঙলা সাহিত্যে তা অধিকাংশ বাঙালীর কাছেই ধোঁয়াশা।
বাঙ্গালী টেম্পারামেন্টের সাথে কি তবে নজরুলের মিলল না? বহুকাল পরে নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ওরহান পামুকের কথায় আন্তর্জাতিক মহলে নজরুলের নামটা শুনেছিলাম। তিনি নাকি ওনার লেখায় বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিভাবে হয়েছিলেন সে নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানার সৌভাগ্য অবশ্য আমার হয়নি। ওনার লেখা পড়েও কিছু আঁচ করে উঠতে পারিনি। তবে উনি বলেছিলেন এ কথা সত্য।
আমার কথাটা অন্য জায়গায়। বিদ্রোহী কবি কথাটা শুনলেই আমার কেমন যেন একটা লাগে। কবি মানেই তো কোথাও একটা বিদ্রোহী সে। সে বিদ্রোহ যার প্রতিই হোক না কেন। তবে কি বলতে চাইছি নজরুলের বিদ্রোহটা খুব চড়া দাগের ছিল অন্যান্য সমসাময়িক কবির থেকে? আর তাতেই ওনার কাব্যপ্রতিভার চূড়ান্ত মূল্যায়ন আমরা করে ফেললাম? আমাদের দেশে তাই কি গালিব থেকে রবীন্দ্রনাথ জাতীয় স্তরের কবি হলেও নজরুলের স্থানটা হারিয়ে ফেললাম আমরা? কাউকে খুঁজে নিতে হয় আমাদের আর কেউ আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান --- এই হয়ে আসে। প্রথমটায় লাগে সাধারণের তৃষ্ণা আর দ্বিতীয়টায় লাগে সেই ব্যক্তির প্রতিভার ক্ষমতা। নজরুলের দুর্ভাগ্য আমরা দু'দিকেই হারাচ্ছি তাঁকে। না তো তৃষ্ণা আছে তাঁকে নিয়ে আরো গভীরে চর্চার, আর না তো তার লেখা আমাদের নিত্যজীবনের তথা মননের সামগ্রী হতে পেরেছে বৌদ্ধিক স্তরে। এ আমাদের ক্ষতি তো বটেই। সাথে এমন অনেক সম্পদ হারাচ্ছি তা আমাদের ভাষার এককালের গৌরব ছিল।
প্রাসঙ্গিকতার বাইরে আরেকটা কথা আছে – ঐতিহ্য। সে সম্পদের সঠিক মূল্যে রক্ষণাবেক্ষণের দায় আমাদের। হারিয়ে যেতে দিলেই হারিয়ে যায়। তাতে আর এমন বড় কথা কি। কিন্তু কথা হচ্ছে আমাদের ভাঁড়ার ঘরের পরিসর কি এতোই ছোটো যে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে কোনো কিছুই আমরা রাখতে পারি না। শুনেছি জাহাজ টলোমলো হলে কিম্বা উড়োজাহাজ বিপজ্জনক সীমানায় এলে তার ভার লাঘবের জন্য শুধুমাত্র অতি প্রয়োজনীয় বস্তু বাদ দিয়ে বাকি সব ফেলে দেওয়াটাই প্রথা। আমরা কি তবে সেই চূড়ান্ত সংকটকালীন পরিস্থিতি দিয়ে যাচ্ছি যেখানে “ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোটো এ তরী” রব উঠেছে সেই কোন কাল থেকে? আজও ভারতের গ্রামে, শহরে তুলসীদাস পড়া হচ্ছে; দক্ষিণে ত্যাগরাজের গানে আজও জনসমাগম হচ্ছে শুধু না, আধুনিক প্রজন্মের শিল্পীরাও কি আনন্দে তার গান গাইছেন। আমাদের কাশীরাম দাস, কৃত্তিবাস, রায়গুণাকর, চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি হারাতে বসেছে। গতকাল এক গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে আমবাগানে বসে থাকা এক বয়স্ক মানুষের সাথে পরিচয় হল। খুব স্বচ্ছল তার অর্থনৈতিক অবস্থা নয়। কিন্তু তাতে তার চিত্তের আর স্মৃতির গতি কিছুতেই হার মানেনি। কয়েকটা পল্লীগীতি শোনালেন যার মূল অর্থ হল কিভাবে চাষবাস করবে, পরিবার প্রতিপালন করবে, সুপথে চলবে ইত্যাদি। তাতে ইউরিয়া, ফসফেট চাষে দেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে আবার মেয়েদের স্বাধীনতার কথাও গাওয়া হচ্ছে। বিজয় সরকারের গান শোনাবার প্রতিশ্রুতি দিলেন পরেরদিন। আমি শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, রবীন্দ্রনাথ ‘কালান্তর’-এ একেই লোকশিক্ষা বলেছিলেন গলিপথে। এগুলো কি তবে হারিয়ে যাবে? তাও সিনেমার কল্যাণে লালনের গান আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে, কালিকাপ্রসাদের দৌলতে কিছুটা কীর্তন, পল্লিগীতির মরা নদীতে বাণ ডেকেছে। নয়ত লালন আর কীর্তন তো এসোটেরিক হয়ে পড়ছিল ক্রমে। কিন্তু কবীর হননি ভারতের মানসলোকে।
আমাদের এ বোধ কি কোনো কালে হবে যে প্রয়োজন আর প্রাসঙ্গকিতার বাইরেও একটা দুনিয়া আছে, আর সেখানেই মানুষ সার্থক। আমাদের পরিচয় আমাদের ঐতিহ্য আর উদারতা দুইয়ের সামঞ্জস্যতায়। এক-কে সরিয়ে অন্যকে বড় করলেই এমন অনেক অঘটন ঘটে যাবে। আমার মাটিতে, আমার ইতিহাসে, আমার মননে যা মূল্যবান তা আমার নিরিখেই মূল্যবান। তার অন্যান্য দেশের নানা প্রতিভার সাথে মিলুক চাই না মিলুক। আমার বাউল, আমার কীর্তন, আমার কথাগান, আমার পটের গান, আমার ভাদু গান, আমার বৈতালিক --- সব জীবাশ্মের পথে আজ। কারণ অপ্রাসঙ্গিক ওরা আজকের দ্রুততার পাশ্চাত্য পোশাকি সভ্যতায়। আজকাল আবার আমাদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির কথা বললে ভাবা হয় আমি সতীদাহ প্রথা থেকে পর্দাপ্রথা, বাল্যবিবাহ সব সমর্থন করছি, না হয় পদ্মফুলের কৃপাকাঙ্ক্ষী হয়েছি। আমরা আধুনিকতার ভাণ করছি কোনো উচ্চ-উদার দর্শনের জন্য না। আমরা আধুনিকতার ভাণ করছি স্রেফ আমাদের ওতেই সুবিধা বলে। আমাদের প্রয়োজন চরিতার্থ হচ্ছে সেই সব অনুকরণের ফলে। তার কতটা বিবেকের জাগরণ আর কতটা অনুকরণের, কম্ফোর্ট জোন খোঁজার তাগিদ তা একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যায়।
আমাদের মিউজিয়াম বানাতে হবে না। আমাদের প্রসারিত হতে হবে। শুধু সামনে না, অতীতেই ভাঁড়ারেও অমূল্য সব সম্পদ আছে তার দিকেও হাত বাড়াতে হবে। বিশ্বনাথ রায়ের লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ: প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের নতুন পাঠ’ বইতে পড়েছিলাম কি জ্বলন্ত তাগিদে তিনি সেই পুরাকালের সাহিত্য নিমগ্ন হয়েছিলেন শুধু না, সে রসের ভাঁড়ার সকলের জন্য উন্মুক্তও করেছিলেন গ্রন্থাগারে তাদের আবার নিয়ে এসেও। এ আমাদের শিখতেই হবে। কারণ আত্মপরিচয় সঠিক অর্থে না ঘটলে আত্মবিশ্বাস জন্মায় না। আর আত্মপরিচয় শুধু প্রাসঙ্গকিতা আর পরিচয় নির্ভর হলে গিরগিটিও হার মানে।