"এতটুকু কৃতজ্ঞতা বোধ নেই!" - বাবা-মা, শিক্ষক, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব, প্রায় সকলের মুখেই এই কথাটা, আকারে ইঙ্গিতে প্রকাশ্যে গোপনে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে।
আমার মনে হয়, কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা বা আনুগত্য - এ'দুটো বোধকে, আলাদা করা যতটা সহজ ভাবি, ততটা না। যে আমার কাছে প্রয়োজনের তাগিদে এসেছে, তাকে আমি স্নেহের সাথে জড়িয়ে দেখি যদি তাতে আপত্তি কিছু নেই। কিন্তু সেই স্নেহের একটা প্রতিদাবী মনের অলক্ষ্যে তৈরী হয়। সাথে ভালোবাসার দাবী, ভালোবাসার কৃতজ্ঞতার দাবী। মুশকিল হয় সেখানেই।
আমি যখন একটা সিঁড়ি ছেড়ে পরের সিঁড়িতে উঠি, আগের সিঁড়ির কথা মনে থাকে? না, থাকে না। সেরকম সব সম্পর্কই যে ভালোবাসার ভিতে তৈরী হবে, সে আশা করাটা অবাস্তব না? এটা স্বীকার করে নেওয়াই ভাল, সম্পর্কের একটা মূল ভিত - প্রয়োজনের। একটা শিশু যখন ভূমিষ্ঠ হল, সে নিতান্ত অসহায়। আপনার উপর তার পূর্ণ নির্ভরশীলতা। আপনিও আপনার স্নেহের দাবীর কাছে অসহায়। আপনার ক্ষুধার্ত স্নেহের প্রয়োজন তাকে, আর তার বাঁচার একান্ত নির্ভরতায় প্রয়োজন আপনাকে। সেই থেকে একটা নিবিড় নৈকট্য। তা কি ভালবাসা? কিছুটা সেরকম অবশ্যই, তবে নিখাদ না। প্রয়োজনের তাগিদ এক রকমের ভালবাসার জন্ম দেয়, এ সেই প্রকার ভালবাসা।
কৃতজ্ঞতাবোধ (কিছু নিতান্ত দুর্ভাগ্যজনক ব্যতিক্রম ছাড়া, যা কৃতঘ্নতা অবধি পৌঁছাতেও দ্বিধা করে না) নিশ্চই আছে, সাথে যদি ভালোবাসা, আনুগত্য ইত্যাদি দাবী করে বসি? সেটা হয় না। মানুষের সাহায্যে মানুষকে চিরকাল এগোতেই হয়েছে, হবেও। আমি যেমন সাহায্য পেয়েছি, আমি তেমন সাহায্য করবও, এটা নীতি। যাকে ইংরাজীতে গোল্ডেন রুল বলে, 'অন্যের সাথে তেমনই ব্যবহার করো, যেমন ব্যবহার তুমি অন্যের কাছ থেকে আশা করো'। এ কথাটা আবার একটা অন্য প্রশ্ন খুঁচিয়ে দিয়ে যায় - আচ্ছা আমি নিজেই কি সেরকমভাবে, মানে যেমনটা আমি চাই, সেরকমভাবে কৃতজ্ঞতা মিশ্রিত আনুগত্য, ভালোবাসা দিতে পেরেছি আমার পূর্বজদের? পারিনি। পরের প্রশ্ন, আচ্ছা সবই কি আমার ইচ্ছানির্ভর ছিল? পরিস্থিতি, পরিবেশ, সময়ও কি আমাকে বিবশ করেনি কখনো? এর উত্তরও আমার জানা।
নিজের কাজটুকু করে বিরাম চাওয়ার মধ্যেই তাই অন্তিম শান্তি। কর্তব্যের ইতি কর্তব্যের সমাপনেই। তাকে অকারণ স্মৃতিপথে দীর্ঘ করে, কৃতজ্ঞতাকাঙ্খী ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরে বেড়ালে হয়তো দু-একটা আধুলি মিললেও মিলতে পারে, তবে তাতে সুষ্ঠুভাবে কৃত কর্তব্যটার যে আত্মসুখ তা অনেক ম্লান হয়ে পড়ে। কি দরকার?
আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করুন চাই না করুন। তবু বলি কোনো একটা মন্দিরে সারাদিন কাটান। দেখুন সকাল থেকে রাত্রি কত মানুষের ভিড়। কত প্রার্থনা, আবেগ, হাসি, কান্না, কথা, গল্প, আলাপ, প্রলাপ। রাত বাড়ল। মন্দিরের দরজা বন্ধ হল। দেবতার মুর্তি অন্ধকার মন্দিরের মাঝে একা। হয়তো একটা প্রদীপ কেউ জ্বালিয়ে গেল। সেই ক্ষুদ্র প্রদীপশিখা দেবমূর্তির বিরাটা ছায়া এঁকেছে মন্দিরের দেওয়ালে।
আমি, আপনি, আমরা সবাই সেরকমই এ দেহ দেউলে দেবতার মত একা। স্মৃতির প্রদীপে যে ছায়া অতীত সময়ের দেওয়ালে পড়ে, সে ছায়ার দাবী যত ন্যায্যই হোক আপনার, আমার কাছে, সব শেষে সে ছায়াই।
অবশেষে একটা কথা বলি, আমি বুঝতে চাই না কেন - অকারণে, অপ্রয়োজনে শুধু ভালোবাসার জন্যে ভালোবাসার সংখ্যা এ সংসারে কতটুকু? সে দুর্মূল্য বস্তু অমনি মুড়িমুড়কির মত ছড়িয়ে থাকবে বুঝি? সে দুর্লভ বস্তুটি প্রয়োজনের সীমা ছাড়িয়ে অপ্রয়োজনে উত্তীর্ণ হয়ে কালজয়ী হয়, এও সম্ভব। তবে তা কদাচিৎ। যে পায়, সে পায়। তবু যা পেয়েছি তাই বা কম কি? কারোর তো সংসারে কখনো আমায় প্রয়োজন পড়েছিল। আমি যদি তাকে সত্য অর্থে সাহায্য করে থাকতে পেরে থাকি, তবেই আমি সার্থক। আমার জীবন সার্থক। কি হবে কৃতজ্ঞতার ভারী মালা গলায় বয়ে বেড়িয়ে? বরং সেও ভুলুক, আমিও ভুলি। তাতেই শান্তি।
সৌরভ ভট্টাচার্য
30 August 2015