Skip to main content

01

১) সূচনা

=======

যদি বলি, এমন একটা গান বলো, যাতে রবীন্দ্রনাথের বহির্মুখ জীবনের আদর্শকে ধরতে পারি, তবে সে কি গান হয়?

আমার মনে হয়, সে গান হতে পারে, "আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া।"

যদি বলি, রবীন্দ্রনাথের অন্তর্মুখ জীবনের এমন একটা গান, যা সে জীবনের আদর্শকে তুলে আনে?

আমার মনে হয় সে গান হতে পারে, "আমার মন চেয়ে রয় মনে মনে, হেরে মাধুরী"।

এ গান আমি যতবার শুনি ততবারই মনে হয় মনের উপর থেকে একটা পরত খুলে গেল। আরেকটু কি যেন বুঝলাম। তা স্পষ্ট নয়, কিন্তু তা তুচ্ছও নয়।

বালখিল্যতা হল? অতিসরলীকরণ হল? হতে পারে। কেউ বলবেন, এক সমুদ্র জল কি এক চামচে ধরে? আমি উত্তরে বলব, একটা রাগের যেমন পকড় হয়, বাদী-সমবাদী হয়, তেমন এই দুটো গানের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের দুই জীবনের মূল সুরের ছায়া যেন পড়ে আছে।

কিন্তু আজকে অন্য একটা বিষয়ে গল্প বলার ইচ্ছা। রবীন্দ্রনাথের ওই "আপন হতে বাহির হয়ে" সুরের অববাহিকায় ভেসে একটা নদীর গল্প বলার ইচ্ছা। যে নদীর জন্ম চীনে। কিন্তু তার শাখাপ্রশাখা আজ ছড়িয়ে গিয়েছে নানা দিকে। যার একটা শাখা কেরালাতেও আছে। শিল্পের আরেক হাত ধরে।

রবীন্দ্রনাথ স্তাবক পরিবৃত হয়ে দিন কাটিয়ে যাননি। গেলে ওঁর বাহ্যিক জীবন হয় তো অনেক মসৃণ হত। বসার ঘরে বসে শৌখিন সাহিত্য, সঙ্গীত, ভাস্কর্যচর্চায় অনায়াসে দিন কাটানো গেলে এত টানাপোড়েন বাহ্যিক জীবনে কি হত?

রবীন্দ্রনাথ কর্মী খুঁজেছিলেন। স্তাবক খুঁজে বেড়াননি। আজকের দিনে এ বুদ্ধিগতভাবে বোঝা যায়, কিন্তু মজ্জাগতভাবে অনুভব করা কঠিন।

রবীন্দ্রনাথের অন্বেষণ ছিল, ব্রত ছিল। অন্বেষণ তাঁকে অন্তর্মুখে নানা ভাঙাগড়ার ভিতর দিয়ে নিয়ে গেছে। আর ব্রত তাঁকে বাইরে নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে নিয়ে গেছে। দুইয়ের মধ্যে একে অন্যকে প্রভাবিতও করেছে।

তবে শুধুই কি রবীন্দ্রনাথ? তাঁর আশেপাশে যে মানুষদের তিনি আবিষ্কার করেছেন, সে মানুষেরাও কি তাঁদের অন্তঃস্থলে এক অন্বেষণ নিয়ে বেঁচেছিলেন না? আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে তাঁদের সেই অন্বেষা উজ্জীবিত হয়েছে। রূপ পেয়েছে রবীন্দ্র ধারায় মিশে। রবীন্দ্রনাথ যেন এক মহানদী, যার মধ্যে এসে মিশেছে এক একটা ছোটো ছোটো নদী। তারা নিজেদের সর্বস্ব দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের সাধনাকে সফল করতে। তবেই শান্তিনিকেতন হয়ে উঠেছে "বিশ্ববিধাতার যজ্ঞশালা আত্মহোমের বহ্নিজ্বালা"। সেই যজ্ঞে আহুতি দিয়েছেন বহুজন। তাঁদেরই মধ্যে একজনের গল্প প্রফেসার তানের। তান য়ুন সান।

 

২) তান য়ুন সান - প্রাক্ অধ্যায়

======================

জন্ম ১৮৯৮ সালে। ১০ই অক্টোবর। তান অনেক অল্প বয়েসেই বাবা-মা'কে হারান। বারো বছর বয়সের মধ্যে অনাথ হয়ে পড়েন তান। হয়তো এত অল্পবয়সে বাবা-মা'কে হারানোর ফলেই জীবন নিয়ে গভীর জিজ্ঞাসা জন্মায় তানের। যা ওঁর শেষ জীবনে জীবনের মূল সুর হয়ে ওঠে। তান গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন চীনা সাহিত্য, বিশেষ করে প্রাচীন চৈনিক সাহিত্য। কনফুসিয়াসের দর্শন। লাও ৎসু'র দর্শন। এবং সর্বোপরি বৌদ্ধদর্শন। ক্রমে সুপণ্ডিত হয়ে ওঠেন। এরই সঙ্গে পাঠ নেন পাশ্চাত্য শিক্ষার ও দর্শনের বিষয়গুলোরও।

১৯২৪ সাল নাগাদ তানের লেখা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করে। লেখার মধ্যে তানের দর্শন, সমাজ নিয়ে সুচিন্তিত গভীর ভাবনা ফুটে ওঠে। কিন্তু তানের মধ্যে ছিল নতুনকে জানার এক অদম্য তৃষ্ণা। সে হোক তাঁর বর্তমানের বিশ্বাসের প্রতিকূল, তবু সেটাকে জানার প্রতি সৎ গভীর অন্বেষণস্পৃহা তানের আজীবন ছিল। মাও ৎসে-তুং'এর বামপন্থী দর্শন ও আন্দোলনে নিজেকে জড়ান তান। 'নিউ পিপল লার্নিং সোসাইটি', 'নিউ কালচার সোসাইটি'-তে যোগ দেন। লেখালেখি করেন, সম্পাদনার কাজ করেন।

কিন্তু বেশিদিন এ সবের মধ্যে থাকলেন না তান। চীনে এই সময় চলছিল দুই ধারার আন্দোলন। একটি ধারা রাজনৈতিক। আরেকটি ধারা সামাজিক। তানের মন সায় দিল দ্বিতীয় ধারার আন্দোলনে। সে আন্দোলনে চৈনিক সমাজে পাশ্চাত্যের শিক্ষা-দর্শন-ভাবনার প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল। বিশেষ করে ফ্রান্সের ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছিল একদল তরুণ। সেই মুক্তভাবনা তানের জীবনকে আলোড়িত করেছিল। যদিও তানের জীবনের মূল অন্বেষণ ছিল এক অদ্ভুত টানাপোড়েনে। এই সময়ে বিখ্যাত বৌদ্ধপণ্ডিত, তাই জুয়ের কাছে বৌদ্ধদর্শনের পাঠও চলছিল পাশাপাশি।

তখন মালয় উপদ্বীপ চারটে অংশ নিয়ে গঠিত ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীনে। বর্তমানের মালয়েশিয়া আর সিঙ্গাপুর সেদিন একসঙ্গেই ছিল। তান অধ্যাপনার কাজ নিয়ে সেখানে যান। এবং বলা যায় চৈনিক সাহিত্যের গোড়াপত্তন উনিই করেন সেখানে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে। সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত কয়েকটি চৈনিক সংবাদপত্রে তানের লেখা তার আধুনিক চিন্তাভাবনার কারণে বেশ সাড়া ফেলে। তান জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন প্রবাসী চৈনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে।

এই সময়ে তানের সঙ্গে পরিচয় হয় শিক্ষিকা চেন নাই ওয়াইয়ের। চেনের জন্ম চীনের ইয়ুন্নানে। পরিচয় গভীর হয়। এবং তান অনুভব করেন চেন তাঁর জীবনের সঙ্গী হতে পারেন, তাঁর ব্রত উদযাপনের সহায় হতে পারেন। তানের অনেক ইচ্ছা, ভারতে যান, গভীরে বৌদ্ধদর্শন নিয়ে পড়াশোনা করেন; ইউরোপে যান, সেখানকার চিন্তাভাবনা, সেখানকার সমাজকে নিজের মত করে অনুভব করেন, জানেন; তারপর এসে নিজের দেশে ফিরে শিক্ষাব্রতে অংশ নেন।

কিন্তু কি ছিল বিধাতার মনে। ১৯২৭ সালের জুলাই মাসে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সিঙ্গাপুরে। তানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়। কথা হয়। রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রণ জানান তানকে শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতার জন্য। তান সাড়া দেন। তান চেনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

 

৩) তান য়ুন সান - শান্তিনিকেতন

=======================

তান শান্তিনিকেতন আসেন ১৯২৮ সালে। এসে পড়েন সাগরে। এ কি শুধুই রবীন্দ্রনাথ? এক-একজন বিদগ্ধ পণ্ডিতের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনায় তান ক্রমে বুঝতে পারেন শিকড় প্রবেশ করছে অনেক গভীরে। ভারতকে আরো গভীরে বুঝতে গেলে ভারতের প্রাচীন ভাষাকে বুঝতে হবে। জানতে হবে। তান পণ্ডিতপ্রবর ক্ষিতিমোহন সেনের তত্ত্বাবধানে সংস্কৃত পাঠ শুরু করেন। সঙ্গে নানা বিষয়ে কবিতা, প্রবন্ধও লিখতে শুরু করেন তান যা চীনের নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে।

কিন্তু তানের স্বপ্ন আরো বড়। তিনি শান্তিনিকেতনে এক নতুন অধ্যায় শুরু করতে চান। চীনের শিক্ষাকে এখানে আনতে চান। ভারতের শিক্ষাকে চীনে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু অর্থ কোথায়? বিশ্বভারতীর ভাঁড়ারের হাল তো দেখছেনই, যে কারণে দীর্ঘদিন তিনি এক পয়সা পারিশ্রমিকও নেননি শিক্ষাদানের জন্য।

কি আশ্চর্য লাগে, না? তিনি যদি সিঙ্গাপুরে বা মালয়েশিয়ায় থেকে যেতেন? অন্তত অর্থের দিক থেকে তো কোনো বেগ পেতে হত না? বাইরের জীবন কি নিশ্চিন্তভাবে কাটাতে পারতেন, অল্প একটু নিজের আত্মার ডাকের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিলেই চলত। কিন্তু তিনি তা করেননি। অমন নিশ্চিত জীবন ছেড়ে চলে এসেছিলেন এমন অনিশ্চিত জীবনের টানে। যে প্রতিষ্ঠানের থেকে তিনি পারিশ্রমিক অবধি নিলেন না কতগুলো বছর। কি ছিল রবীন্দ্রনাথের ডাকে! সে এক তানের অন্তরাত্মাই জানবেন।

স্বপ্নকে সফল করতে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে ১৯৩১ সালের শুরুতেই বিদায় নিলেন তান। টাকা জোগাড় করতে হবে তো।

সিঙ্গাপুরে দু'মাস থেকে চলে এলেন রেঙ্গুনে। রেঙ্গুনে এক চৈনিক পত্রিকার সম্পাদনার কাজে যোগ দেন। সেখানেই তিনি শান্তিনিকেতনে 'চীনা ভবন' গড়ে তোলার বিষয়ে প্রথম লেখেন।

এরপর সেই কাজে ইস্তাফা দিয়ে, চীনের দূত শী গুয়োলিয়ং-এর সঙ্গে তিব্বতের উদ্দেশ্য রওনা দেন। উদ্দেশ্য ছিল ত্রয়োদশ দলাই লামা, থাপতেন গ্যায়াতসো-র সঙ্গে দেখা করা।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে যাত্রাপথেই শী মারা যান। তান একাই তিব্বতে পৌছন। দলাই লামা'র সঙ্গে দেখা করেন। দলাই লামা মহাত্মা গান্ধী'র উদ্দেশ্য একটা বার্তা দেন, যা নিয়ে তান কালিংপঙ ফিরে আসেন। শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন মার্চ মাসে। ফিরেই ভারতের বৌদ্ধতীর্থ স্থানগুলো দর্শনের জন্য বেরিয়ে পড়েন। মন তোলপাড়। রাস্তা পাচ্ছেন না, কিভাবে গড়ে উঠবে শান্তিনিকেতনে 'চীনা ভবন'। টাকা আসবে কিভাবে? এ স্বপ্ন তো তার একার না এখন, রবীন্দ্রনাথেরও তো স্বপ্ন এটা। গুরুদেবের স্বপ্ন।

সবরমতীতে মহাত্মা'র সঙ্গে দেখা করেন। দলাই লামা'র বার্তা দেন। মহাত্মা কি সে বার্তা বুঝতে পেরেছিলেন? জানি না। একটু সন্দেহই হয়। কারণ তিনি ওই বছরেই মে মাসে একটা চিঠি লেখেন, যেখানে লেখেন,

 

Dear friend,

I thank you for your gift. I am sorry I cannot understand your language. My desire and hope is that Tibetans should understand and follow the secret of the message of Ahimsa given by Buddhadeva.

Your friend, M. K. Gandhi

 

৪) তান য়ুন সান - চীনা ভবন নির্মাণ

=========================

মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে ভারত-চীন সম্পর্ক নিয়ে নানা আলোচনার পর তান শান্তিনিকেতন ফেরেন। একটা মজার ঘটনা হল মহাত্মা তানকে বারবার নিরামিষাশী হতে বলেন। যার ফল আমরা তানের জীবনের শেষের দিকে দেখব।

১৯৩১ সালে তান চীনে ফেরেন। সাংহাইয়ের লীডা অ্যাকাডেমিতে পড়াতে শুরু করেন। সেখানেই চীন-ভারত অ্যাকাডেমি সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়ে আলোচনা শুরু করেন। যদি তা বাস্তবায়িত হয় তবে তা দুই দেশের সুপ্রাচীন সংস্কৃতির মধ্যে আদান-প্রদানের পথও দেখাবে। যা রবীন্দ্রনাথেরও স্বপ্ন।

তানের অধ্যবসায় বিফলে যায় না। ১৯৩৩-এ নাঞ্জিং-এ চীন-ভারত সাংস্কৃতিক সোসাইটি গড়ে ওঠে, সাই-য়ুয়ান-পেই যার প্রথম প্রেসিডেন্ট হন, আর তান হন প্রথম সেক্রেটারি। তান ১৮-ই ফেব্রুয়ারী চিঠি লেখেন রবীন্দ্রনাথকে। অবশ্যই গুরুদেব হর্ষিত হন।

১৯৩৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তান ভারতে ফেরেন। ভারতে চীন-ভারত সাংস্কৃতিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় সেপ্টেম্বরে। রবীন্দ্রনাথ যার প্রথম প্রেসিডেন্ট হন, আর রথীন্দ্রনাথ হন প্রথম জেনারেল সেক্রেটারি।

কিন্তু কাজ তো সবে শুরু। দুই দেশের সংস্কৃতির মেলবন্ধনে লাগবে অনেক অর্থ, আর অনেক তথ্য। তথ্য দেবে বই। কিন্তু বই কোথায়?

অক্টোবরেই তান আবার চীনে যান। এবারে যাত্রা ভীষণভাবে সফল হয়। ১৯৩৬ সালে তান ৫০,০০০ টাকা, এবং ১,০০,০০০ বই সংগ্রহ করে ফেরেন। রবীন্দ্রনাথ বিস্মিত হন। চীনা ভবনের জন্য জমি নির্ধারিত হয়। সুরেন করের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে 'চীনা ভবন'। বীরেন সেন ছিলেন কন্ট্রাক্টর। তান, নন্দলাল বসু ও বিনোদবিহারী মুখার্জী'র সঙ্গে মিলিত হয়ে চীনা ভবনকে সাজান। ১৯৩৭ সালের ১৪ই এপ্রিল দ্বারোদঘাটন হয়। কথা ছিল মহাত্মা গান্ধী'র দ্বারা দ্বারোদঘাটন সমাধা হবে। কিন্তু তিনি তখন বেলগামে থাকাতে ও জওহরলাল নেহেরু অসুস্থ থাকাতে ইন্দিরা গান্ধী দ্বারা দ্বারোদঘাটন পর্ব সমাধা হয়। মহাত্মা শুভেচ্ছা বার্তায় লেখেন, "May the Chinese Hall be a symbol of living contact between China and India"।

তান প্রথম ডিরেক্টর হিসাবে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু তিনি বিশ্বভারতীর আর্থিক অবস্থার কথা ভেবে কোনো অর্থ নিতে অস্বীকৃত হন। চীন সরকার সম্মানী হিসাবে কিছু অর্থ পাঠাবেন, এমনই ব্যবস্থা হয়।

এর মধ্যে নানা রাজনৈতিক পরিবর্তন আসে চীনে। জাপানি আগ্রাসানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জওহরলাল ও সুভাষ তানকে বলেন ভারতের বার্তা চীনে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, যে ভারত চীনের পাশে আছে। রবীন্দ্রনাথও সেই মর্মে চীয়াং-কাই'কে চিঠি লেখেন। চীয়াং রবীন্দ্রনাথকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি লেখেন এই নৈতিক সমর্থনের জন্য। এরপরে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমর্থনের জন্য নেহেরু যখন চীনে যান ১৯৩৯ সালে, তখন ভারত-চীন সাংস্কৃতিক সোসাইটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। তান এবং নেহেরুর বন্ধুত্ব গভীর হয় এবং তা আজীবন ছিল।

ডক্টর তাই, সুপ্রসিদ্ধ বৌদ্ধপণ্ডিত তানের সুবাদেই শান্তিনিকেতন আসেন। তিনি ছিলেন মহাত্মা ও রবীন্দ্রনাথের একান্ত অনুরাগী। তিনি ১০,০০০ টাকা অনুদান দেন। যার ৬০০০ টাকা তানের বাড়ি নির্মাণের জন্য, ৩০০০ টাকা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য আর ১০০০ টাকা বিশ্বভারতীর ত্রাণ তহবিলের জন্য ধার্য হয়। তান যদিও ওনার জন্য বরাদ্দ টাকা নিজে না নিয়ে স্টাফ কোয়াটার্স বানানোর জন্য দিয়ে দেন।

এরপর থেকে চীনা ভবনের জন্য না তো অনুদানের অভাব হয়েছে, না তো জ্ঞানীগুণীজনের পদধূলির দৈন্য দেখা গেছে।

 

৫) তান য়ুন সান - অন্তিম পর্ব

=====================

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুশয্যার পাশে তান বসে প্রার্থনা করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ চলে গেলেন। তান বিধ্বস্ত হয়ে ফিরলেন চীনা ভবনে।

এরপর অনেক অনেক ঘটনা ঘটেছে। তানের মধ্যস্থতায় ভারত-চীনের মধ্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সেই সময়ে তার জন্য ১৯৪৫ সালে তান-কে চীন সরকার ভিক্টরি মেডেলে ভূষিত করে। 'চীনা ভবন' বেড়ে ওঠে। নতুন নতুন মানুষ যোগদান করেন। এরই মধ্যে ভারত স্বাধীন হয়। ১৯৪৯ সালে তান সপরিবারে পাকাপাকি শান্তিনিকেতনে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মাও-কে চিঠি লেখেন, যেখানে তিনটি দিকের প্রতি মাও-র দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

১) সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকতে। ২) ভারত-চীন সম্পর্ককে মজবুত করতে। ৩) তাইওয়ানের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় আসতে।

এদিকে তানের জন্য বিধাতা অন্য কিছু লিখছিলেন। ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় সরকারের হয়ে যায় অফিসিয়ালি। তান খেয়াল করেন চীনা ভবনে এমন অনেক পরিবর্তন হচ্ছে যা রবীন্দ্রনাথের ভাবনার সঙ্গে অনুকূল নয়। ওদিকে ১৯৪৯ সাল থেকে চীনের থেকে যে টাকাটা পেতেন তান সেটা চীন বন্ধ করে দেয়। অনিল চন্দের অনুরোধে তিনি বিশ্বভারতী থেকে পারিশ্রমিক নিতে স্বীকৃত হন। কিন্তু বিশ্বভারতী বদলে যাচ্ছে অনুভব করেন। কষ্ট পান।

তানের চিত্তে সেই আত্মদর্শনের খোঁজ, যা জীবনের প্রারম্ভে দেখা দিয়েছিল আবার জ্বলে ওঠে। তান ভারতের অধ্যাত্মিকতার সম্পদের অন্বেষক হলেন। মহাত্মার কথা মনে এলো। খাদ্যাভ্যাস বদলালেন। শ্রীঅরবিন্দ থেকে শুরু করে স্বামী শিবানন্দ অবধি নানা অধ্যাত্মপথের পথিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। পথ কোথায়?

১৯৭১ সালে বিশ্বভারতী থেকে অবসর নিলেন। যেন কোথাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এইভাবে অর্ধেক হৃদয় দিয়ে কাজ কতদিন করা যায়? প্রাণ যেন বিশ্বভারতী থেকে উঠে গেছে।

বুদ্ধগয়ায় চলে এলেন। সেখানে গড়ে তুলবেন বিশ্ব বৌদ্ধ অ্যাকাডেমী। ওই বয়সে আবার গেলেন হংকং, সিঙ্গাপুর টাকা তুলবার জন্য। অনুদান এলো। ইতিমধ্যে ১৯৭৯ সালে বিশ্বভারতী দিল 'দেশিকোত্তম'। গড়ে উঠল বিশ্ব বৌদ্ধপীঠ। ১৯৮০ সালে জীবনসঙ্গীকে হারালেন। ভীষণ আঘাত পেলেন। ১৯৮৩ সালে বুদ্ধগয়াতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

তান য়ুন সানের পরিবার অনেক বড়।

১) তান চেং - বড় ছেলে। মালয় দেশে জন্মান। পরবর্তীকালে দিল্লী ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক।

২) তান চেন - দ্বিতীয় ছেলে। আমেরিকায় থাকেন।

৩) তান লি - তৃতীয় ছেলে। চীনেই থাকেন।

৪) তান ওয়েন - বড় মেয়ে। চীন থেকে প্রথম তিনিই বাংলায় পি.এইচ.ডি করেন।

৫) তান য়ুন - ছোটো মেয়ে। শান্তিনিকেতনেই জন্মান। রবীন্দ্রনাথ নাম রাখেন, চামেলি।

৬ ও ৭) তান অজিত এবং তান অর্জুন - শান্তিনিকেতনেই জন্মান।

পরবর্তী গল্প, চামেলিকে নিয়েই।

 

৬) চামেলি

========

একটা বাচ্চা কেরলের মন্দিরে বসে। পুজো চলছে। প্রদীপের আলোয় দেবতার ছায়া পড়ছে দেওয়ালে। সে মুগ্ধ হয়ে দেখছে দেবতার অবয়ব।

সে পরবর্তীকালে ঠিক করল ছবি আঁকবে। মূর্তি বানাবে। আদিম মূর্তি। তার পড়ার বিষয় 'সাহিত্য'। কিন্তু সৃষ্টি করতে চায় ছবিতে নিজেকে। কিন্তু কিভাবে? রাস্তা কি?

কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক তাকে দেখালো এক সাঁওতাল পরিবারের স্থাপত্যের ছবি।

সে তখন যুবক। চমকে উঠল দেখে। বলল, এ কোথায় আছে?

অধ্যাপক বললেন, যাও শান্তিনিকেতনে। সেখানে পাবে এ অত্যাশ্চর্য সৃষ্টিকে চাক্ষুষ করতে প্রত্যক্ষ। সেই হবে তোমার সাধনপীঠ।

এ রামচন্দ্রন। ভাবীকালের বিখ্যাত শিল্পী। সেদিন এলেন শান্তিনিকেতনে। কলাভবনের ছাত্র হলেন। রামকিঙ্কর বেজ, বিনোদবিহারী মুখার্জি'র ছাত্র হলেন।

কিভাবে শেখানো হত শান্তিনিকেতনে? কেউ একজন জিজ্ঞাসা করল পদ্মভূষণপ্রাপ্ত রামচন্দ্রনকে।

তিনি বললেন, বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে শান্তিনিকেতনের ওই তো পার্থক্য ছিল। সেখানে শেখানো হত না। সেখানে স্বাধীনতা দেওয়া হত। বিশ্বের মহান সৃষ্টির সামনে দরজা খুলে দেওয়া হত। এবার তোমার কাজ বেছে নেওয়ার। তুমি বেছে নাও।

রামচন্দ্রনকে প্রভাবিত করল আরেক মণীষা। দস্তয়েভস্কি। রামচন্দ্রন বললেন, আমি আমার সৃষ্টিতে দস্তয়েভস্কিকে অনুবাদ করব। ওই সব পীড়িত, নীচুতলার মানুষদের কথা বলব ছবিতে।

তখন তিনি জামিয়া ইসলামিয়াতে কাজে যোগ দিয়েছেন। সালটা ১৯৬৫। সেখানকার উপাচার্য মহম্মদ মুজিব বললেন, তুমি এই প্রতিষ্ঠানকে শান্তিনিকেতন গড়ে তোলো। তোমাকে দিলাম পূর্ণ স্বাধীনতা।

চিত্তের পূর্ণ স্বাধীনতাই তো চাই। চিত্তের সুর ততদিনে বেঁধেছে চামেলির সঙ্গে রামচন্দ্রনের। সেই চামেলি, যিনি তানের কন্যা, শান্তিনিকেতনে যার জন্ম, রবীন্দ্রনাথ যার নামকরণ করেন।

রামচন্দ্রনের জেদ পাশ্চাত্য না, ভারতীয় আদিম সংস্কৃতিকে আনবেন কাজে। অনেকে নিন্দা করল। কেউ কেউ বলল, তবে তুমি কুলীন জগতে ঠাঁই পাবে না। অনেক টানাপোড়েন চলল এই নিয়ে। ভারতের গ্রামে গ্রামে গিয়ে আদিবাসীদের চিত্রশিল্পকে বুঝতে চেষ্টা করলেন। মনে দাগ কেটে আছে কলকাতার নকশাল আন্দোলনের ভয়াবহ ছবি। দেশভাগের ছবি, শিয়ালদহ স্টেশান জুড়ে অসহায় মানুষের বাস, সব মিলিয়ে অস্থির করে তোলে রামচন্দ্রনকে। একে একে ছবি জন্ম নেয়। পরবর্তীকালে কেরলের মন্দিরের মুরালের উপর কাজ নিয়েও একটা বই বার করেন। সঙ্গে আসে বাচ্চাদের জন্য ছবির বই। যা বাচ্চাদের ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটাবে। সেই কাজে সঙ্গ দিয়েছেন চামেলি। তিনি ছবি আঁকেন। সেই সব ছবিতে গাছে ওঠার গল্প থাকবে, পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ার গল্প থাকবে, কাকা-জেঠা-ঠাকুর্দা-ঠাকুমার গল্প থাকবে। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে বড় হয়ে ওঠা বাচ্চাদেরকে ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটাতেই এই কাজ।

সেদিন চীনে যে আলো জ্বলে উঠেছিল, আজ তারই শিখা ভারতের মাটির সঙ্গে মিশে ভারতের আগামী প্রজন্মের কাছে ভারতীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরার কাজে ব্রতী হয়েছেন। স্বামীর সঙ্গে মিলে ভারতের নাড়ির কাছাকাছি যে ভাষা তাই খুঁজে চলেছেন। রামকিঙ্কর, বিনোদবিহারী'র দেখানো পথে। এইভাবেই জাল তৈরি হয়। নিবেদিতা লিখেছিলেন 'ওয়েব অব ইন্ডিয়ান লাইফ'। এইভাবেই ওয়েব অব কালচার তৈরি হয়। মূলকে রেখেই ডালপালা বাড়ে। এ বিশ্বাস ভূগোলের কাছে ততটা নেই, যতটা হৃদয়ের কাছে আছে।

ওই সেই গানে আবার ফিরে যেতে হয়, "আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া"।

বিশ্বলোকের সাড়াতেই জন্মায় মাধুরী। যা অন্তরের অন্তঃস্থলকে জাগিয়ে সৃষ্টিতে নিজেকে প্রকাশ করে।

 

01

0203

05