আপনি যদি এখন ঘন ঘন হাত ধুতে যান, হাত স্যানিটাইজ করে দাঁত দিয়ে নখ কাটেন, হাত সাবানে রগড়ে রগড়ে চোখের পিচুটি পরিষ্কার করে, নাক পরিষ্কার করেন, কান খোঁচান - আপনাকে কেউ অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসর্ডার (OCD) আক্রান্ত বলবে না। বলবে আপনি সচেতন নাগরিক। এইভাবেই সময় মানুষের ধর্ম দর্শনের সংজ্ঞা বারবার বদলে দিয়ে এসেছে। পরিস্থিতিই ঠিক করেছে কি ন্যায় আর কি অন্যায়।
কিন্তু আরেকখান OCD আছে, Obsessive Compulsive Devotion. এদের নিয়েই আজ যত গোল। কিন্তু এই নিয়ে আমার কিছু বলার আছে। মানে বিচার আছে।
যদ্দূর শুনিচি মানুষটা অযোধ্যায় সুখী ছিল না গো। ছোটোবেলায় মেলা পড়াশোনার চাপ, অস্ত্রশিক্ষার ঝক্কি। তারপর বনে জঙ্গলে ঘুরে রাক্ষস মেরে মুনিঋষিদের যজ্ঞের সুরাহা করা। যাও বা তার মধ্যে বিয়ে থা করে দেশে ফিরল তো পারিবারিক ক্যাঁচাল। যাও আবার বনে।
দাঁড়ান জঙ্গল শুনেই আহাউহু করবেন না তো! ওই বনেই কয়েকটা দিন মানুষটা সুখী ছিল গো। চিত্রকূটে। আহা, ছোটো কুটির। চারদিকে পাহাড়, জঙ্গলে ঘেরা। কুলকুল করে নদী বয়ে যাচ্ছে। জঙ্গলের আদিবাসীরা এসে গল্পগাছা করে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। জানকীর সাথে তো দারুণ ভালোবাসা হয়ে গেল সেই সরল সহজ আদিবাসী স্ত্রীলোকেদের। দরশরথনন্দন দুজনেও পরম শান্তিতে নানা তত্ত্বকথা আলোচনা করছেন। জানকীও টেক পার্ট করছেন। রান্নাকরা, স্টারজলসা দেখার হ্যাপা নেই। প্রথমটার কারণ জঙ্গলে অরন্ধন, ফলমূল খেয়ে থাকারই বিধান। আর দ্বিতীয়টার কারণ অত জঙ্গলে ইলেকট্রিসিটিও নেই, আর মোবাইলের টাওয়ারও নেই। তাই ন্যাচেরালি অখণ্ড শান্তি, বিরামহীন অবসর। অনেকটা সময় দুজনে কাছাকাছি, যা মিথিলা, অযোধ্যা কোত্থাও হয়নি।
তারপর তো সেই শূর্পনখার অধ্যায়। কিডন্যাপ কেস। হনুমান, বিভীষণ ইত্যাদি নিয়ে একটা কম্যিউনিটি স্থাপন। যুদ্ধ। জিতে যাওয়া। স্ত্রী উদ্ধার। বাড়ি ফেরা। ফিরতে না ফিরতেই সোশ্যাল অ্যাজিটেশান। আনরেস্ট। ফলে স্ত্রীর সাথে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং আশ্রমে পাঠিয়ে, এদিকে তিনি গর্ভবতী। বাবা হলেন জানতেও পারলেন না। ছেলেদের সাথেই যুদ্ধ। বউ ছেলে ফিরিয়ে আনলে আবার মাস মুভমেন্ট। ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল.... তোমার বিবাহ আপনার সুখের জন্য নহে, জন্ম হইতেই বলিপ্রদত্ত সমাজের কাছে.... সেই ডায়লগ.... সে যুগেও ছিল... আকাশে বাতাসে.... অর্থাৎ আবার নো কনফিডেন্স মোশন.... পাতাল প্রবেশ... মানে 'আই কুইট', ফার্স্ট ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট।
এবারে বলেন, ওই চিত্রকূট ছাড়া মানুষটা সুখে আর কোথায় ছিল? তা ওইখানেই একটা কুটির বানিয়ে দিলে হত না? বাইরে লেখা থাকত, নো এন্ট্রি, প্রবেশ নিষেধ।
সত্যিই তো মানুষটাকে তো কর্তব্যের যাঁতাকলে ন্যায্য অন্যায্য কত কাজ করিয়ে নিলি বাপ তোরা। পিতৃবাক্য, মাতৃসাধ, ভক্তবাঞ্ছা, ভ্রাতৃদায়, গণদাবী, ঋষিদাবী... বলি সত্যরক্ষা করতে করতে ব্যক্তিগত জীবন বলে তো কিছু রাখতেই দিলি না তোরা। এখন একটা ঢ্যাপকা মন্দির বানিয়ে দিলেই বুঝি খুশী হবে মানুষটা?
তাই বলছিলুম কি ওই চিত্রকূটেই না হয় শান্তিতে থাকার একটা ব্যবস্থা থাকত। কেউ যেত না। কেন তোরাই তো হইহই করে, গোল করে মানুষটাকে অমন ডিপ্রেশানের দিকে ঠেলে দিলি। তুলসীদাস সাচ্চা ভক্ত, সেই এইসব কথা লিখেছে। তাই দেখিসনি অযোধ্যায় ফেরার পর আর কিছু ওইসব আগডুম বাগডুম ঘটনা লেখেনিকো। সোজা তত্ত্বকথায় চলে গেছে; ভক্ত কাকে বলে, মানসিক ব্যাধি কি, সাধু কাকে বলে.... এইসব আর কি। কি করে ওই দুঃখের কথাগুলো লিখবে বল বাপ আমার, যে মানুষটা 'ঠুমক চলত রামচন্দ্র' লিখছে, অর্থাৎ কিনা তার প্রভুর শৈশবের নুপুরের ধ্বনি পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছে, আহা কি বর্ণনা... কিলক কিলক উঠত ঘাই... গিরত ভূমি লটপটাই... ধায় মাতু কোল লেতু দশরথ কি রাণীয়া.... ডি ভি পালুস্করের গলা আসছে না কানে... আহা কি মধুর গলা গো ছিল মানুষটার... উস্তাদ আমির খাঁ বলত প্রসাদি কণ্ঠস্বর.... মধু মধু মধু....
কথা ঘেঁটে গেল। যা বলছিলাম। তা তুলসীদাস কি লিখছেন তার রামচরিতমানসে? যার মুখারবিন্দ রাজসিংহাসনে প্রফুল্লিত হয়নি, কিম্বা জঙ্গলেও মুষড়ে যায়নি, সেই মুখারবিন্দই আমার প্রভুর। আহা, একে ইংরাজিতে বলে equanimity, মানে সাম্য অবস্থা চিত্তের। গীতায় বলা হল না, চিত্তের সমতাই হল গিয়া আসল যোগ... ওসব লোকদেখানি ধম্মকম্ম ছাড়ো বাপু, ওতে চিঁড়ে গলবেনি, চিত্তখানা ফ্লেক্সিবল করে মার্কেটে ছাড়ো তো বাপু... দেখবে কেমন হাওয়ায় দোলা খাচ্ছে... পড়ে যাচ্ছে না.... সেই গল্প মনে পড়ল। মাধবানন্দজী, রোজ জানলা দিয়ে তাকিয়ে কি দেখেন। ও মহারাজ, কি দেখেন? কোলের উপর কথামৃত খোলা, আপনি কি দেখেন রোজ? মাধবানন্দজী হেসে বললেন, আমি নারকেল গাছের দোল খাওয়া দেখি.... হাওয়ায় কেমন দুলে দুলে হাওয়ার সাথে একটা বোঝাপড়া করে নিচ্ছে দেখ.... তবেই তো টিকে আছে.....
বুঝেছি... ভালোমন্দ যাহাই ঘটুক.. সত্যেরে লও সহজে....
তো এই তুলসীদাসজী থোড়ি ওইসব লব-কুশ, পাতাল প্রবেশ লিখতে গেছেন... না, মোটেও না। বাল্মিকীকে বলেছেন, দেখো দাদা ওইসব আমার মোটেও ভালো লাগেনি, আমি ওইসব লিখতে পারব না। আমি সার কথাটা নিয়ে নেব, মাধুর্য। মাধুর্য দারিদ্রতেও থাকে, দৈন্যে থাকে না। এই কথা ক্রাইম অ্যাণ্ড পানিশমেন্ট উপন্যাসে দস্তয়েভস্কিও বলেছে। আমি বাপু চিত্রকূটের ওই স্বল্প আয়োজনের মধ্যেই সবটুকু মাধুর্য বার করে আনব, বাকিটা তো ঘটনা আর তত্ত্বকথা। বুঝেছ? তা না বুঝবেই বা কেন? যিনি বলছেন তার প্রভুর জঙ্গলের কাঠিন্যে বা রাজার সম্মানে কোনো মনের ভাবের হেলদোল হয়নি, সেই মানুষকি সত্যিই লিখতে পারত স্ত্রীর অমন করুণ পরিণতির পর ওনার মুখারবিন্দ শুকিয়ে যাওয়ার কথা? তা শুকিয়ে গিয়েছিল তো, আলবাত শুকিয়েছিল। বিলাপ করেন রাম লক্ষণের আগে... পড়িসনি বুঝি তোরা.... তাই যেখানে মানুষটা সুখী ছিলই না, সেইখানে ওইসব মহলে কি সুখী হবে বাপ আমার। তার চাইতে চ না বাপু চিত্রকূটে যাই, obsessive compulsive devotee না হয়ে intelligent sensible devotee হলে হয় না?