Skip to main content
রামকৃষ্ণ - বিশ্ব পাঠশালা


বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ স্তোত্র লিখতে গিয়ে লিখছেন - সংশয়রাক্ষসনাশনাশমহাস্ত্রম - সংশয়রূপী রাক্ষসকে মারবার মরণাস্ত্রস্বরূপ। 
কথা হচ্ছে, কোন সংশয়? আর তা নাশই বা হবে কি করে? 
সংশয় - আত্মসংশয়। নিজেকে নিয়ে সংশয়। নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয়। এতদিন যত পড়াশোনা, চিন্তাভাবনা সব কিছুই বৌদ্ধিক স্তর অবধি। তার গভীরে যেতে গেলে আটকে যাচ্ছে কোথায় একটা। সব কিছু করা যাচ্ছে, পাশ্চাত্য-প্রাচ্য জ্ঞানীগুণীর কত তত্ত্ব, কত ইতিহাস, কতরকম ন্যায়-নীতি ইত্যাদি পড়া হয়ে যাচ্ছে - তবু কোথায় একটা ভীষণ শূন্যতা। কিসের একটা হাহাকার... কিছুকে একটা আঁকড়ে ধরতে চাইছি... সব কিছু সরে সরে যেতে পারে না... কিন্তু কি ধরব? কাকে ধরব? কোনদিকে হাত বাড়াব? একটা সিদ্ধান্ত সকালবেলায় হলে বিকালবেলায় তাকে সরিয়ে আরেকটা সিদ্ধান্ত, যাই কোথায়? ধর্মীয় বিশ্বাস? তাও তো পুঁথি-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত... ওদিকে বিদেশী-দেশি সব দেখা হল... হচ্ছে না যে কিছু! সব যেন রূপকথার মত মিলিয়ে যাচ্ছে... মরুভূমিতে স্লেজগাড়ি চড়ে ঘোরার স্বপ্ন দেখাতে চাইছে যেন সব। তবু... তবু... তবু... কিছু তো একটা চাই! সংসারের এত শক্তি নেই যে সে আমায় পরিপূর্ণ করে আটকে রাখতে পারে, এত ভালোবাসা বেসেও অনেকটা জায়গা শূন্যই পড়ে থাকে... নিজেকে নিয়ে এতো মহাজ্বালা হল... উপায়? 
এসেছে এক নতুন মানুষ দেখবি যদি আয় চলে...
এমন একজন মানুষকে আমাদের প্রয়োজন হয়েছিল যে ইতিহাসের আগের যুগ থেকে উঠে আসবে। যে পড়া কথা বলবে না, শোনা কথা বলবে না, শেখানো কথা বলবে না... যে দেখা কথা বলবে... অনুভূত কথা বলবে... বিনা উদ্দেশ্যে কথা বলবে... কোনো পক্ষ নিয়ে কথা বলবে না, সত্যের পক্ষ নেবে শুধু। 
আর তার জীবন কেমন হবে? স্ফটিকের মত স্বচ্ছ, অথচ স্তরের পরে স্তর। আড়াল থাকবে না, রহস্য থাকবে। যে রহস্য সমাধান করতে করতে আমরা আমাদের জীবনের জটিল থেকে জটিল সমস্যাগুলোর সমাধান অজান্তেই পেয়ে যাব। তাই মাষ্টারমশায় বলবেন - "আপনাকে যে যত বুঝবে সে তত উন্নত হবে"। 
তার ভালোবাসা কেমন হবে? অসহ্য! শান্তিদায়ক না। না গিয়েও থাকা যাবে না, আবার গেলেও জ্বলেপুড়ে দক্ষিণা দিয়ে আসতে হবে। আত্মদানের দক্ষিণা। পথ অন্যদিকে ঘোরাতে চাইলেও, পথ ঘুরে সে অক্ষরজ্ঞানমাত্রজ্ঞাত, অর্ধনগ্ন, ভাবোন্মাদের দরজায় এনে দাঁড় করাবে। সে হেসে হেসে বলবে... 'কি ফিরে এলে যে আবার? বড় যে পালাবার তাল করেছিলে', .....আমি অসহায়... নিজের মনের কাছে... তার প্রেমের কাছে। 
আর তার মরণ কেমন হবে? হবে যেন মশালের মত। নিজেকে পুড়িয়ে ছাই করতে করতে, নিজেকে নিঃশেষ করার আগে আরেকটা মশালে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে। 
তার শিক্ষা কেমন হবে? তার কথা ছাড়ো। তার দেশ-বিদেশখ্যাত-পূজ্য শিষ্য এমন কথা ঘোষণা করতেও দ্বিধান্বিত হবে না - "তাঁর নাম বরং ডুবে যাক - তাঁর উপদেশ ফলবতী হোক। তিনি কি নামের দাস?' ... যে শিষ্য তার সারাটা জীবন মুখ থেকে রক্ত ওঠা শ্রমের বিনিময়ে তৈরি মঠ প্রাঙ্গণ তথা বাড়ি এক নিমেষে বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন শুধুমাত্র দুর্ভিক্ষের সেবার টাকা না ওঠার জন্য। যে শিষ্য বলতে পারেন, “নিজে নরকে যাও, পরের মুক্তি হোক - আমার মুক্তির বাপ নির্বংশ"... যে শিষ্য বলতে পারেন, “সব ত্যাগ করেছো, এখন শান্তির ইচ্ছা, মুক্তি ইচ্ছাটাকেও ত্যাগ করে দাও।”
তাই দরকার ছিল তো, খুব দরকার ছিল এমন একজন মানুষের আসার, তার নাম যে না হয় রামকৃষ্ণই হল। কথাটা নামে নেই, কথাটা একটা পথের, একটা আশ্বাসের, কথাটা একটা বিশ্ব-পাঠশালার ভিত গড়ার। বিশ্ব-বিদ্যালয় অবধি পৌঁছাতে সবাই পারে না, আমার মত মূর্খ মানুষ হলে তো কথাই নেই; দরকার ছিল একটা বিশ্ব-পাঠশালার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার। যেখানে সবাই চাটাই নিয়ে বসবে, মাটিতে বসবে। যেখানে গুরু সব ধর্মের গুরুর বেশে আসবেন, সব ধর্মের মূল কথাটা শিখিয়ে বলবেন - এই হল মূল, এখান থেকে এক একটা স্রোত বেয়ে এক একদিকে গেছে। তোমার যে পথটায় সোজা লাগে সে পথ ধরে হাঁটতে শুরু করো। শুধু এটুকু জেনো, উৎসটা যেমন এক ছিল, মোহনাটাও একই থাকবে। সেখানে আবার দেখা হবে, যেভাবে দেখতে চাও সেভাবেই দেখতে পাবে।
আমরা যত উন্নত হচ্ছি, তত কম মানুষ হচ্ছি, তত একা হচ্ছি। যত একা হচ্ছি ততই প্রমাণ করছি যে আমি মানুষ হতে পারছি না, কারণ মানুষ একা থাকতে পারে না। মানুষ একা থাকতে পারে না বলেই সমাজ গড়েছিল। আজ সমাজের ভিত কাটতে শুরু করেছে আবার একা করে নিজেকে, বিচ্ছিন্ন করে নিজেকে। মানুষ একা হয় এটা-ওটা কারণের জন্য - এ খুব ভুল কথা। মানুষ একা হয় নিজের মধ্যে অন্যকে আপন করার শক্তিটা কমে যায় যখন সেই রোগে। যেমন অজীর্ণ রুগী ঘর ভরতি খাবার থাকলেও অপুষ্টিতে মরে তেমন। সে আপন করার পথ দেখাবে কে? দার্শনিক? সন্ন্যাসী? না... না... না। সে পথ দেখাবেন 'মা'। তাই আরেকটা স্তম্ভ আরেকদিকে তৈরি হল। "জগতকে আপন করে নিতে শেখো, কেউ তোমার পর নয়"... মৃত্যুর আগে ঘোষণা করছেন মা সারদা। সারাটা জীবনে মা যা করে দেখালেন তা না করলে আর কোনো মহাপুরুষের মহাপুরুষোচিত ঘটনাগুলোকে নিছক গল্প বলেই হয় তো মনে করতাম। তবে মায়ের কথা থাক। সে কথা বাপের কথার থেকে জোরে ছোটে। আগল দেওয়া মুশকিল। 
তো যেটা বলছিলাম, আজ এই 'একা' হওয়া আর 'একা' করার যুগে গেরুয়াই যে একমাত্র পথ হতে পারে না সেটা সে রামকৃষ্ণ নামধারী মানুষটা বুঝেছিলেন, তাই অমন শক্তিস্বরূপাকে আমাদের সামনে বসিয়ে রেখে গেলেন শুধু না, নিজের থেকে তাকে যে আরো বেশি কাজ করতে হবে এমন ঘোষণাটুকুও করে গেলেন। তাই অবশেষে রামকৃষ্ণের শিক্ষার চূড়ান্ত কথাটা মায়ের মুখ থেকে উচ্চারিত হল, যাতে আধুনিক যুগের ধর্ম তথা ঈশ্বর ও জীবনের অনাদি সূত্রের নতুন ব্যাখ্যা যোগ হল - "ঈশ্বর দর্শন হলে কি হয় বাবা, মাথায় দুটো শিং গজায়? না হৃদয়টা মাঠ হয়ে যায়!” 
তবেই বোঝো, মাঠেই মেলা হয়... বোঝে প্রাণ বোঝে যার! শিং নিয়ে ঘুরে লাভ নেই মন। ওতে গোঁতানোই যায় শুধু, মাঠ বানাও বানাও, মাঠ হও মন মাঠ হও.... একা যদি না পারিস মন... সে রামকৃষ্ণ-মা-স্বামীজিকে সঙ্গে নে না।


(আজ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের পূণ্য জন্মতিথি)