আরেকবার ‘রাশিয়ার চিঠি’ পড়ার দরকার মনে হচ্ছিল। কেন মনে হচ্ছিল সেটা একটা কথায় বলা শক্ত। তবে মনে হয় ‘'রাশিয়ার চিঠি”টা একবার পড়ে নেওয়া যেতে পারে। বর্তমান সময়েও খুব দূরের লেখা বলে মনে হবে না। অবশ্যই এটা আমার ব্যক্তিগত মত। এ নিয়ে তর্ক করার ইচ্ছা নেই।
রাশিয়ার চিঠি প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালের বৈশাখ মাসে। মানে বাংলায় ১৩৩৮ সালের বৈশাখে। প্রায় একশো বছর হতে গেল। ‘রাশিয়ার চিঠি’’ পড়তে পড়তে বেশ কিছু জায়গায় আমার নোম চমস্কির কথা মনে পড়ল। বিশেষ করে দুটো জায়গায়, যেটাতে পরে আসছি।
ডিক্টেটরশিপ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন উপসংহারে। আমি কয়েকটা উদ্ধৃতিও উপসংহার থেকেই দিচ্ছি।
অনেকে বলেন, এই তো দারুণ আছি। আসুক ডিক্টেটরশিপ। আমার সুখের আরামের তো খামতি হচ্ছে না। তাদেরকে রবীন্দ্রনাথ কী বলছেন?
“সবলে চালিত হওয়ার অভ্যাস চিত্তের ও চরিত্রের বলহানি করে--এর সফলতা যখন বাইরের দিকে দুই-চার ফসলে হঠাৎ আঁজলা ভরে তোলে, ভিতরের শিকড়কে দেয় মেরে।
জনগণের ভাগ্য যদি তাদের সম্মিলিত ইচ্ছার দ্বারাই সৃষ্ট ও পালিত না হয় তবে সেটা হয় খাঁচা, দানাপানি সেখানে ভালো মিলতেও পারে, কিন্তু তাকে নীড় বলা চলে না, সেখানে থাকতে থাকতে পাখা যায় আড়ষ্ট হয়ে। এই নায়কতা শাস্ত্রের মধ্যেই থাক্, গুরুর মধ্যেই থাক্, আর রাষ্ট্রনেতার মধ্যেই থাক্, মনুষ্যত্বহানির পক্ষে এমন উপদ্রব কিছুই নেই।”
এখন কেউ যদি বলে, “আমার মনুষ্যত্ব যায় যাক। ও নিয়ে আমি ভাবি না। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বাইরে আমি কিছুকেই সত্য বলে জানি না।” তবে তার সঙ্গে তর্ক চলে না। সে বাঁচার মানেই জানে না। সিলেবাসে অদলবদল হলেও তাদের কোনো তাপ উত্তাপ নেই। তারা বলে ওতে আমার কিছু আসে যায় না।
কিন্তু যে জানে সে জানে যে একনায়কতন্ত্রর ভিত্তি পাকা করতে গেলে সিলেবাসকে নিজের হাতে রাঙিয়ে নিতে হয়। হীরকরাজাও যেমন নিয়েছিল। কারণ, এরা যত বেশি জানে, তত কম মানে। আর রবীন্দ্রনাথ কী লিখছেন,
“নিজের একনায়কত্বের প্রতি যারা লুব্ধ, নিজের চিত্ত ছাড়া অন্য সকল চিত্তকে অশিক্ষা-দ্বারা আড়ষ্ট করে রাখাই তাদের অভিপ্রায়সিদ্ধির একমাত্র উপায়।”
যে কোনো সফটওয়্যার একটা হার্ডওয়্যারের উপর চলে। তেমনই মানুষের যে কোনো নীতিই মানবপ্রকৃতিরূপ হার্ডওয়্যারের উপর চলে। এই জায়গাটাতেই রবীন্দ্রনাথ আর নোম চমস্কির ভাবনার বুনিয়াদি ছাঁচে কী ভীষণ মিল। রাসেল ও চমস্কি দুজনেই সাম্যবাদের অর্থনীতির অন্ধভক্ত কোনোদিন ছিলেন না। আমাদের দেশে যেমন মুক্তচিন্তার মানুষ বললেই, একটা বাম আদর্শ ঘেঁষা মানুষের ভাবমূর্তি কল্পনা করে নেওয়া হয়, পাশ্চাত্যে তেমন নয়। সেখানে দর্শন আরো বেশি বৈচিত্র্যময়। যার ফসল রাসেল ও চমস্কি। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,
“সোভিয়েট রাশিয়ায় মার্ক্সীয় অর্থনীতি সম্বন্ধে সর্বসাধারণের বিচারবুদ্ধিকে এক ছাঁচে ঢালবার একটা প্রবল প্রয়াস সুপ্রত্যক্ষ; সেই জেদের মুখে এ সম্বন্ধে স্বাধীন আলোচনার পথ জোর করে অবরুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এই অপবাদকে আমি সত্য বলে বিশ্বাস করি…….
…… যেখানে মানুষ তৈরি নেই, মত তৈরি হয়েছে, সেখানকার উচ্চণ্ড দণ্ডনায়কদের আমি বিশ্বাস করি নে। প্রথম কারণ, নিজের মত সম্বন্ধে আগেভাগে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা সুবুদ্ধি নয়, সেটাকে কাজে খাটাতে খাটাতে তবে তার পরিচয় হয়। ও দিকে ধর্মতন্ত্রের বেলায় যে জননায়কেরা শাস্ত্রবাক্য মানে না তারাই দেখি অর্থতন্ত্রের দিকে শাস্ত্র মেনে অচল হয়ে বসে আছে। সেই শাস্ত্রের সঙ্গে যেমন করে হোক মানুষকে টুঁটি চেপে ঝুঁটি ধ'রে মেলাতে চায়-- এ কথাও বোঝে না, জোর করে ঠেসে-ঠুসে যদি কোনো-এক রকমে মেলানো হয় তাতে সত্যের প্রমাণ হয় না; বস্তুত যে পরিমাণেই জোর সেই পরিমাণেই সত্যের অপ্রমাণ।”
তবে উপায় কী? রবীন্দ্রনাথ যা ১৯৩১ সালে লিখছেন। চমস্কি তাই ১৯৭৩ সালে একটা বক্তৃতায় বলছেন। দুজনের বক্তব্যে মিলটা কোথায়? মানবপ্রকৃতির উপর আস্থা। তাকেই আসল কষ্টিপাথর হিসাবে দেখা। “মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ” যখন ‘'সভ্যতার সংকট’ এ লিখছেন তখনও এই মানবপ্রকৃতির কথাই লিখছেন। স্মরণযোগ্য যে মহাত্মাও একই কথা বলছেন - মানুষের বিকার ও বীভৎসতায় যেন মানবপ্রকৃতি থেকে মুখ না ফেরাই, আস্থা না হারাই। মানবপ্রকৃতি একটা মহাসাগরের মত, তার কিঞ্চিৎ অংশ দূষিত হতে পারে। কিন্তু গোটা মানবপ্রকৃতি নয়।
আসল কষ্টিপাথর হল মানবপ্রকৃতি। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,
“প্রয়োগের দ্বারাই মতের বিচার হতে পারে, এখনো পরীক্ষা শেষ হয় নি। যে-কোনো মতবাদ মানুষ-সম্বন্ধীয় তার প্রধান অঙ্গ হচ্ছে মানবপ্রকৃতি। এই মানবপ্রকৃতির সঙ্গে তার সামঞ্জস্য কী পরিমাণে ঘটবে তার সিদ্ধান্ত হতে সময় লাগে। তত্ত্বটাকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করবার পূর্বে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তবু সে সম্বন্ধে আলোচনা করা চলে, কেবলমাত্র লজিক নিয়ে বা অঙ্ক কষে নয়-- মানবপ্রকৃতিকে সামনে রেখে।”
আমাদের দেশের, তথা বিশ্বের পলিসিমেকাররা যদি এই কথাটা মনে রাখতেন। মানবপ্রকৃতিকে জানতে গেলে ভাবনা আর করা দুটোর মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। যে কথাটা রুশো আর হিউম বারবার মনে করান। তাই হিউম বলেন যে শুধু যুক্তির নির্ভুলতাতে কিচ্ছু আসে যায় না, যতক্ষণ না সেটা মানবপ্রকৃতিতে সচল হচ্ছে। ওঁর ভাষায় যেটা ‘'কাস্টম’।
নোম চমস্কির কথাটা দিয়েই শেষ করি এ লেখার,
“A vision of a future social order is in turn based on a concept of human nature. If in fact humans are indefinitely malleable, completely plastic beings, with no innate structures of mind and no intrinsic needs of a cultural or social character, then they are fit subjects for the “shaping of behavior” by the state authority, the corporate manager, the technocrat, or the central committee. Those with some confidence in the human species will hope this is not so and will try to determine the intrinsic human characteristics that provide the framework for intellectual development, the growth of moral consciousness, cultural achievement, and participation in a free community.”