Skip to main content

মানুষের চিন্তার বিরাম আছে। অনুভবের বিরাম নেই। “শুধু আমার হিয়া বিরাম পায় না গো”। আমি যে কিছু অনুভব করছি না, এও এক অনুভব। শুষ্কতার অনুভব। “জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো”। শুষ্কতার অনুভবের চাইতে বড় বালাই মানুষের হৃদয়ের কমই আছে। শ্রী অরবিন্দ বলছেন, একবার নিজেকে এমন করে ফেললাম, যেন কোনো দুঃখ আমায় স্পর্শ করতে না পারে। আমি দেখলাম সব সুখের অনুভবও আমায় ছেড়ে চলে গেল। আমি আবার আমার বুক পেতে দিলাম, বললাম আমার বুকের উপর দিয়ে তোমার ভালোবাসার হাল চষে যাও। আমি সহ্য করে নেব।

 

আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি,

সেথায় চরণ পড়ে,

তোমার সেথায় চরণ পড়ে।

তাই তো আমার সকল পরান

কাঁপছে ব্যথার ভরে গো

কাঁপছে থরথরে।

ব্যথা-পথের পথিক তুমি,

চরণ চলে ব্যথা চুমি,

কাঁদন দিয়ে সাধন আমার

চিরদিনের তরে গো

চিরজীবন ধ'রে।

নয়নজলের বন্যা দেখে

ভয় করি নে আর,

আমি ভয় করি নে আর।

মরণ-টানে টেনে আমায়

করিয়ে দেবে পার,

আমি তরব পারাবার!

ঝড়ের হাওয়া আকুল গানে

বইছে আজি তোমার পানে,

ডুবিয়ে তরী ঝাঁপিয়ে পড়ি

ঠেকব চরণ-'পরে,

আমি বাঁচব চরণ ধ'রে।

 

এই তো কথা। ওই যে বললাম, শুষ্ক হৃদয়ের চাইতে ভার আর কিছুর যেন নেই। তখন যে করে হোক আমার কোনো অনুভব চাই। এমনকি আমি তখন নানা পাপ আচরণের আগলও খুলে দিতে পারি। আমি তীব্র অনুভব চাই। আমি যে আর এ শুষ্কতা সহ্য করতে পারছি না। আমি যেন বেঁচে নেই। আমি যেন নেই। কোথায় আমার অনুভব। কোথায় আমি?

রবীন্দ্রনাথ নাটকে লিখছেন, প্রকৃতির বরাদ্দ মদে যে অধিকার হারায় তার জন্যে তখন অবশিষ্ট থাকে শুঁড়িখানার মদ। প্রকৃতির বরাদ্দ মদ কি? “মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ”...

 

এই-যে তোমার প্রেম,ওগো হৃদয়হরণ,

এই-যে পাতায় আলো নাচে সোনার বরন॥

এই-যে মধুর আলসভরে মেঘ ভেসে যায় আকাশ-'পরে,

এই-যে বাতাস দেহে করে অমৃতক্ষরণ॥

প্রভাত-আলোর ধারায় আমার নয়ন ভেসেছে।

এই তোমারি প্রেমের বাণী প্রাণে এসেছে।

তোমারি মুখ ওই নুয়েছে, মুখে আমার চোখ থুয়েছে,

আমার হৃদয় আজ ছুঁয়েছে তোমারি চরণ॥

 

কিন্তু আমার হৃদয় যে শুষ্ক। আমার প্রার্থনা কি তবে? “শুষ্ক হৃদয় মম কঠিন পাষাণসম, প্রেম সলিলধারে সিঞ্চহ শুষ্ক নয়ান”।

খ্রীষ্টের জীবন আর বাণী এই শুষ্কতার বিরুদ্ধে। খ্রীষ্টের বাণীতে ইন্দ্রিয়দ্বার রুদ্ধ করে ধ্যানের কথা বলা হল না। বলা হল না যে সমস্ত ত্যাগ করে জঙ্গলে যাও, কি পর্বত গুহায় যাও, কি লোকালয়ের বাইরে যাও। বলা হল নিজেকে সিক্ত করো। করুণায়। ভালোবাসায়। “আমি যেমন আমার ভাইয়ের অপরাধ ক্ষমা করেছি, তেমন তুমিও আমার অপরাধ ক্ষমা করো পিতা”। এ প্রার্থনা খ্রীষ্ট শেখাচ্ছেন। আগে নিজে ক্ষমা করো, তবে ক্ষমা চেয়ো। কে কৃপাপাত্র হতে পারে? যে নিজেকে পিতার কৃপার যোগ্যও মনে করে না সে-ই। খ্রীষ্ট গল্প বলছে।

একজন খাজনা মুকুবের জন্য রাজার দরবারে আর্জি জানাতে গেল। রাজা তার তার কাতরতায় মুকুব করল খাজনা। সে ব্যক্তি মহানন্দে রাজদরবারের বাইরে এসে যেই দাঁড়িয়েছে, দেখে এক ব্যক্তি যাচ্ছে যার কাছে সে কিছু টাকা পায়। সে তড়িঘড়ি করে গিয়ে বলল, যে টাকা তুমি ধার নিয়েছিলে, সে টাকা এখনই দাও। সে বলল, আমার কাছে নেই, আমি খুব খারাপ অবস্থা দিয়ে যাচ্ছি। লোকটা শুনল না, সে তার গলা টিপে ধরতে উদ্যত হল। অমনি রাজার লোক এসে তাকে ধরে নিয়ে রাজার কাছে গেল। রাজা সব শুনে বলল, আমি এতগুলো টাকা তোমার মুকুব করে দিলাম, আর তুমি এইটুকু টাকার জন্য ওকে মারতে পর্যন্ত উদ্যত হলে!

খ্রীষ্ট বলছেন, তোমরাও কি তাই করো না?

খ্রীষ্টের দ্বিতীয় গল্প।

একজন উপাসনা গৃহের মধ্যে দাঁড়িয়ে বলছে, ওগো প্রভু, আমি কত উপবাস করি, আমি কত নাম করি তোমার, আমি কত দয়াদাক্ষিণ্য করি। আমার উপর তো তোমার কৃপা হবেই। আর ওদের দেখো, যারা তোমার নাম করে না, যারা তোমার গৃহে আসে না, তাদের কোনোকালে কিছু হবে?

ঠিক সেই সময় উপসনা গৃহের বাইরে দাঁড়িয়ে আর একজন প্রার্থনা করছে, হে প্রভু, আমি লোকের টাকা ধার নিয়ে সুদের ব্যবসা করে পেট চালাই। আমার যোগ্যতা নেই তোমার উপাসনা গৃহে প্রবেশ করে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করি। তবু যদি পারো আমায় ক্ষমা কোরো।

খ্রীষ্ট বলছেন, তোমরাই বলো, কে সত্যিকারের ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য?

শুষ্ক হৃদয় কেন? কারণ আমি স্বার্থপর বলে। আমি আত্মকেন্দ্রিক বলে। আমার চারদিকে আমারই তৈরি পাঁচিল। সে পাঁচিল ডিঙিয়ে আমি বাইরে যাই না। কেউ আসতেও পারে না। মাঝে মাঝে যদিও মনে হয় দিই এ পাঁচিল ভেঙে। কিন্তু ভয় করে। আমার এ পাঁচিলের উপর কেমন যেন আসক্তি। যেন এ পাঁচিলটাই আমি। তবে উপায়? ক্ষমা করার সাহস।

 

আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,

বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া ॥

এই-যে বিপুল ঢেউ লেগেছে তোর মাঝেতে উঠুক নেচে,

সকল পরান দিক-না নাড়া ॥

বোস্‌-না ভ্রমর, এই নীলিমায় আসন লয়ে

অরুণ-আলোর স্বর্ণরেণু মাখা হয়ে।

যেখানেতে অগাধ ছুটি মেল সেথা তোর ডানাদুটি,

সবার মাঝে পাবি ছাড়া ॥

আমি কেন ক্ষমা করব? নিজেকে বাঁচাবো বলে। নিজের হৃদয়ের শুষ্কতাকে বাঁচাব বলে। আমার মধ্যে যে জন্মলব্ধ চিরন্তন এক ভালোলাগার অনুভূতি ধীরে বয়ে যায়, তাকে রক্ষা করব বলে। সেই তো আদতে আমার জীবন। সে যদি না থাকে কোনো কাজে আমার উৎসাহ নেই। কোনো বিষয়ে আমার কোনো আশা নেই। কোনোদিকে আমার যেন ডাক নেই। আমি যেন এতবড় বিশ্বে সম্পূর্ণভাবে অবাঞ্ছিত। তা হয় কি করে? কিন্তু ক্ষমা করব কিসে? করুণায়। একই কথা। যেই ক্ষমা, সেই করুণা। তার রসদ চিন্তার ঘূর্ণীতে নেই, প্রাণের স্রোতে আছে। বড়দিনের এইটাই তো বড় কথা। আসল চ্যালেঞ্জ।

প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে।

ভয়-ভাবনার বাধা টুটেছে ॥

দুঃখকে আজ কঠিন বলে জড়িয়ে ধরতে বুকের তলে

উধাও হয়ে হৃদয় ছুটেছে ॥

হেথায় কারো ঠাঁই হবে না মনে ছিল এই ভাবনা,

দুয়ার ভেঙে সবাই জুটেছে।

যতন করে আপনাকে যে রেখেছিলেম ধুয়ে মেজে,

আনন্দে সে ধুলায় লুটেছে ॥