ঈশ্বরের বিরোধিতাও এক ধরণের আস্তিকতা। কারণ যার অস্তিত্বহীনতা নিয়ে আমার মনে কোনো সংশয় নেই, তার অনস্তিত্ব নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কি দরকার?
আমি যদি স্নান করতে না চাই, তবে স্নানাগারে ঢোকার কোনো কারণ দেখি না। আমি ভুতে বিশ্বাস করি না। তাই "ভুত নেই" বলে একটা প্রবন্ধ ফেঁদে বসারও প্রয়োজন দেখি না। কারণ আমি জানি সত্যের শক্তি আমার থেকে বহুগুণ বড়। তা আমার প্রকাশের অপেক্ষায় থাকে না। আর সত্য কার কাছে কিভাবে প্রকাশিত হবে তাও আমার নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। তাই অকারণ আমার অনুভূত সত্যকে অন্যের অনুভূত সত্যের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে কোনো সুখ আমি কোনোদিন উপভোগ করতে পারিনি।
ধর্ম নিয়ে বহু বাদানুবাদ আছে। ধর্মের ব্যাখ্যা কালে কালে বদলেছে। আরো বদলাবে। যেমন বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তগুলো। প্রাক্তন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যেমন আধুনিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে নস্যাৎ হয়ে গেছে, ঠিক তেমনই।
কথা হচ্ছে এক চামচ জলে সাগরের রূপ কল্পনা করার অভ্যেস। ধর্ম চিরটাকাল বিভেদ তৈরি করে এসেছে মানুষে মানুষে - এ যেমন অর্ধসত্য আবার ধর্ম না থাকলে মানুষ ব্যভিচারী, অনৈতিক হয়ে উঠত - এও তেমন অর্ধসত্য। অবশ্য এখানে আমি ধর্ম বলতে ইংরাজীতে 'রিলিজিয়ান' বলতে যা বোঝায় তাই বলছি। কারণ ভারতীয় দর্শনে ধর্ম হল যা 'বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়'- এরকম ব্যাখাও পাওয়া যায়। তাতে অতীন্দ্রিয় কোনো বিশাল অস্তিত্বের শরণ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে না। এমনকি গীতাতেও নিজের বুদ্ধির শরণ নেওয়ার কথা আছে, আর "বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি" অর্থাৎ বুদ্ধিনাশ হলেই নিজের ধ্বংস মানুষ নিজেই ডেকে আনে, এমন উদ্ধৃতিও আছে। এই বুদ্ধি অবশ্যই শুভবুদ্ধি। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে সেখানে যে, মানুষ যত নিজেকে জ্ঞানের দর্পণে দেখে, তত সে নিজেকে অন্যের সাথে সমান দেখে। তার বিভেদবোধ দূর হয়। সেই গীতাতেই আবার ঈশ্বরের কথাও আছে, তাঁর শরণ নেওয়ার কথাও আছে।
তাই বলছিলাম এখানে আমি ধর্ম বলতে 'রিলিজিয়ান'ই বলতে চাইছি। আসলে আস্তিকের ঈশ্বর আর নাস্তিকের ঈশ্বর - দুটোরই মোদ্দা কথা হচ্ছে বিশ্বাস। একজনের 'হাঁ'-এ বিশ্বাস, আরেকজনের 'না'-এ। অগত্যা ঠোকাঠুকি। এর সহজ সমাধান হল, কেউ কারোকেই দলে টানতে না চাওয়া।
ধর্মের আর দর্শনের একটা বড় পার্থক্য হল হৃদয়ের কাছে আবেদন। এইটাই ধর্মের সবচাইতে বড় শক্তি আবার সবচাইতে বড় ভয়ের। ব্যাপারটা একটু খোলসা করে দেখা যাক। দর্শনের আবেদনটা সিংহভাগ বৌদ্ধিক স্তরের। তার আনন্দ বিশুদ্ধ বৌদ্ধিক আনন্দ। সংসারে একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও একই সাথে অসৎ মানুষ মিউজিয়ামে গিয়ে দেখতে হবে এমন দুর্লভ নয় মোটেই।
ধর্মের শক্তির জায়গাটা হল তার হৃদয়ের কাছে আবেদন। একজন মানুষ ঈশ্বরকে ভালোবাসে বলে হত্যা করল না, চুরি করল না, মিথ্যা বলল না। কারণ সে ঈশ্বর বলে একজনের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে, যিনি আদতে শুভগুণের সমাহার ও শুভ মানুষের উপর সদয়। মূলত পৃথিবীর সব ধর্মগুলোর সার কথা- সত্য, প্রেম ও করূণা। এই তিনটেকে বিশেষ করে অনুসরণীয় বলা হচ্ছে 'সার্থক মানুষজীবন' অতিবাহিত করতে। সেই বিশ্বাস তাকে দুর্দিনে সাহস জুগিয়েছে, আশ্বাস দিয়েছে, ভরসা দিয়েছে। সবার সাথে যুক্ত থাকার একটা কারণ দেখিয়েছে। দুঃখকে, মৃত্যুকে বরণ করার একটা পথ দেখিয়েছে। তাই পৃথিবীর সব ধর্ম থেকে প্রচুর বড় বড় মনীষীদের নাম পাওয়া যাবে। অগুনতি সাধারণ মানুষের জীবন এই ধারায় বয়ে চলে যাচ্ছে, যারা নির্বিবাদে একটা শান্তিপূর্ণ জীবন কাটিয়ে যাচ্ছেন যুগ যুগ ধরে।
কিন্তু এই হৃদয়ের কাছে আবেদনই আবার বিপদের কারণ। সে সাম্প্রদায়িকতা শেখায়। নীচু হওয়ার জায়গায় ঔদ্ধত্য শেখায়। আসলে মানুষের মূলগত কিছু ত্রুটি আছে। হিংসা, ভেদাভেদ, স্বার্থপরতা ইত্যাদি কাউকে শেখাতে হয় না। এটা তার জন্মগত স্বভাব। তাই এই দোষগুলো ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি, শিক্ষাক্ষেত্র, চিকিৎসাক্ষেত্র ইত্যাদি সর্বত্র নিজের গতিপথ তৈরি করে নিয়েছে। অসৎ ধার্মিক, অসৎ চিকিৎসক, অসৎ শিক্ষক, অসৎ ব্যবসায়ী ইত্যাদি সর্বত্র ভুরিভুরি উদাহরণে ভর্তি। কারণ অসৎ, স্বার্থপর ইত্যাদি হওয়াটা মানুষের জন্মগত প্রবৃত্তি, বিপরীতটাই শিক্ষণীয়। সেই শিশুবয়সের পাঠ - "সদা সত্য কথা বলিবে"।
তো কথা হচ্ছে, এই নিম্নবর্গীয় পিপাসাগুলো যখন ধর্মের শরীর আশ্রয় করে বসে তখন তা আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠে। কারণ আর সব পথ মস্তিষ্ক অবধি গিয়ে ক্ষান্ত হয়, ধর্মের পথ হৃদয় অবধি পৌঁছায়। সে বিকারগুলোকেই সত্য বলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। কারণ প্রধানত প্রভুত্বের লোভ। সে ধর্মই হোক আর রাজনীতি হোক, কি শিক্ষানীতি - সবার উপরে তো উঠতেই হবে না!
যখনই মানুষ শুভবুদ্ধি আর অনুকম্পার পথ ছেড়ে অন্যপথে হেঁটেছে (যার উদাহরণই ইতিহাসে অধিক) তা সে সরাসরি হোক আর ছদ্মবেশেই হোক সে অন্ধকার তৈরি করেছে। এমনকি আলো জ্বালার নাম করে চারপাশটা অন্ধকারে রেখে নিজের উঠানটা আলোকিত করে রাখার ইচ্ছাটাও বর্বরতা। সে যতই উচ্চতত্ত্বের মোড়কে ঢাকো না কেন! বিভিন্ন তত্ত্বের, বিশ্বাসের মুখোশগুলো খুলে গেলে আমরা আসলে আদতে সেই বর্বর মানুষই। কয়েকজনকে বাদ দিলে। তারা ব্যতিক্রম। আমরা নই। আমরা যত উন্নত হচ্ছি তত বর্বরতাগুলোকে নিত্যনতুন কৌশলে
ব্যাখ্যা করতে আর ঢাকতে শিখছি - এইমাত্র পরিবর্তন।
"পাশের বাড়ির মানুষগুলো না খেয়ে মরে যাচ্ছে, আর নিজের মেয়ের বিয়েতে হাজার টাকা খরচ, এরা আবার জীবে দয়ার কথা বলে, শালা!" রামকৃষ্ণের নগ্ন হুঙ্কার।
তাই জেরুজেলামের যীশুর, দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে এলেম লাগে; আর ভ্যাটিকানের যীশু, বেলুড় মঠের রামকৃষ্ণের শিষ্য সাজাটা এত সোজা হয়ে যায়। প্রথমটা যে শুদ্ধতা দাবী করে, পরেরটা করে না।
সৌরভ ভট্টাচার্য
12 June 2016