আমার কিশোর বন্ধুরা, এ লেখা বিশেষ করে তোমাদের জন্য। আমি পর পর কয়েকটা আত্মহত্যার খবর পেয়ে একটু বিচলিত, তাই কিছু কথা একটু আলোচনা করতে চাই। দেখো, নেশা শব্দটা তোমরা শুনেছ। আমি এই নেশা নিয়েই কয়েকটা কম আলোচিত দিক নিয়ে কথা বলতে চাই।
দেখো, তোমরা শুনেছ যে মানুষ সিগারেট, মদ, গাঁজা এরকম নানা নেশা করে। তোমরা জানো এগুলো বাইরে থেকে মানুষ কিনে বা জোগাড় করে নিজের নেশার ইচ্ছাকে তৃপ্ত করে। এখন একটু ভেবে দেখো তো, নেশা আর অভ্যাসের মধ্যে ঠিক পার্থক্যটা কি? নেশার জিনিসটা আমার উপরে তার কন্ট্রোলিং পাওয়ার পেয়ে বসে। এটাই হল সব চাইতে খারাপ দিক নেশার। বাকি শরীরের উপর কি প্রতিক্রিয়া সেই নিয়ে আমার এখানে আলোচনা করার দরকার নেই। আমার কথা হল যে সেটা তোমার উপর তার কন্ট্রোলিং পাওয়ারটা পেয়ে বসে। তুমি সম্পূর্ণ তার কন্ট্রোলে চলে যাও।
এখন দেখো, কারুর কন্ট্রোলে যাওয়াই কি ভালো? দেখো তোমরা ইতিহাসে পড়েছ যে অনেক আগে মানুষ ভাবত যে নানা দেবতা এই ঝড়, বৃষ্টি, আলো, বাতাস ইত্যাদি এইসব চালাচ্ছে। মানে মানুষ ভাবত যে তার সব কাজ নানা দেবতাদের নিয়ন্ত্রণে হচ্ছে। তোমরা জানো কিনা জানি না, অনেকেই আগে মনে করতেন, দুর্ভাগ্যবশত এখনও মনে করেন যে পক্স মানে হল শীতলা মায়ের ইচ্ছা। যেমন আগে পাশ্চাত্যে ভাবত যে জলাতঙ্ক হল শয়তানের ভর। তাকে চার্চে নিয়ে গিয়ে যা তা করে মেরে ফেলা হত। তো এরকম অনেক অনেক উদাহরণ তোমরা ভাবলেই পেয়ে যাবে যে আগে আমরা আমাদের জীবনটাকে কত কিছুর নিয়ন্ত্রণে ভাবতাম। কিন্তু বিজ্ঞান যত এগোলো তত আমরা বুঝলাম যে কোনো নির্দিষ্ট কিছুর একটা নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কিচ্ছু নেই। সবই একটা তন্ত্র বা সিস্টেম। যেমন ধরো তোমার শরীরটা। তোমার প্রেসার, সুগার যাবতীয় কাজ চালাতে কি দারুণ একটা সিস্টেম বানানো হয়েছে। সেরকম আমাদের রাজনীতিও দেখো। আগে একজন রাজা থাকত। তার কথা অনুযায়ী সব হত। এখন দেখো গণতন্ত্রের যুগ এলো। আবার সেই তন্ত্র কথাটা এলো। একার নিয়ন্ত্রণে হবে না, জনগণের নিয়ন্ত্রণ সব চলবে। মানে সব কিছুই একটা সিস্টেম। তোমার শরীরের এই সিস্টেমের সাম্যাবস্থাকে বলে হোমিওস্ট্যাটিক অবস্থা।
তো যেটা আমি বলতে চাইছি, দেখো তোমার জীবনটাকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করবে এটা ঠিক নয় তাই। নেশা ঠিক সেই কাজটাই করে। তবে কি সব নিয়ন্ত্রণ খারাপ? তা ঠিক নয়। যদি মনে হয় যে তুমি কারোর পরিচালনায় থাকতে চাও, সে আলাদা। যেমন স্কুলে প্রধান শিক্ষক, দেশে মন্ত্রী, বাড়িতে অভিভাবক - এরকম। দেখো আমি শব্দটাকে চেঞ্জ করলাম। আমি কিন্তু নিয়ন্ত্রণ বললাম না। আমি বললাম 'পরিচালনা'। সেখানে একটা সম্মতির ব্যাপার আছে, সেখানে আলোচনার জায়গা আছে। কিন্তু নেশা সে সুযোগটা আমায় দেয় না। এই যেমন ধরো করোনা ভাইরাস। সে শরীরে ঢুকে পড়ে আমাদের সিস্টেমটার কন্ট্রোলিং পাওয়ারটা নিতে চাইছে বলেই যে না এত সমস্যা, আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি!
নেশার আরেকটা দিক দেখো, একটা বিবেচনাহীন সুখ। এর আকর্ষণ মারাত্মক। যে সিগারেটটা খাচ্ছে, সে সুখটা পাচ্ছে বলেই তো খাচ্ছে। সে সুখটা কোথায় জন্মাচ্ছে? তার শরীরে, সিগারেটের গায়ে না কিন্তু। সব নেশার সুখ জন্মায় আমাদের শরীরেই তো। সেই সুখ বিবেচনাহীন। কেন? না, তাতে আমার খারাপ হচ্ছে জেনেও আমি সেই সুখটাকে ছাড়তে পারছি না। মানে আমি আমার শরীরে জন্মানো সুখের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছি। এটা খুব খারাপ।
তবে জানো, সিগারেট, মদ এসবের থেকেও আরো কিছু খুব ক্ষতিকারক নেশা আছে। যেমন একটা সিগারেট দেওয়া যায় হাতে হাতে, তেমন একটা চিন্তা দেওয়া যায় কাউকে নানা পদ্ধতিতে। জিনিসটা একটু বুঝিয়ে বলি। এই যে বিভিন্ন রকমের গেমের নেশা দেখছ। এখানে কি শারীরিক সুখ হয়? না, এটা চিন্তার সুখ। এই চিন্তাটা একটা গেমের মাধ্যমে তোমার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তুমি ওদের মত করে ভাবছ, ওদের মত করে খেলছ, ওদের মত হয়ে যাচ্ছ। ক্রমশ তুমি তোমার ওই বিশেষ ধরণের চিন্তার সুখে পড়ে গেলে। আমাদের যেমন চামড়ার শরীর হয়, তেমন আমাদের একটা মনের শরীর হয়। চামড়ার শরীরে যেমন মদ, সিগারেট ইত্যাদি সুখ দেয়, নেশা ধরায়, তেমনই মনের শরীরে বাইরের চিন্তারা এসে সুখ দেয়। নেশা ধরায়। তবে কি গেম খেলবে না? আলবাত খেলবে। শুধু দেখবে যে সেটা যেন তোমায় নিয়ন্ত্রণ না করে। তবেই বিপদ। নিজেকে ঠকাবে না। যখনই দেখবে তোমার ইচ্ছাটাকে তুমি চাইলেও আটকাতে পারছ না, তোমার রাগ হচ্ছে, ভীষণ রাগ হচ্ছে, তখনই বুঝবে তুমি নেশার অধীনে চলে গেছ। তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ছ। নেশা তোমায় দিয়ে যা খুশী করিয়ে নিতে পারে এখন। এমনকি তুমি নিজের জীবন নিয়ে নিতে পারো শুধু না, তুমি অন্যের জীবনও নিয়ে নিতে পারো। পেপার পড়লেই জানতে পারবে এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
আরেক নেশা আছে, টক্সিক সম্পর্কের নেশা। দেখো তোমার কাউকে না কাউকে ভালো লাগবেই। তাকে ভাবলে, সে কাছে এলে মনের মধ্যে আর শরীরে মধ্যে নানারকম সুখের অনুভব হবেই। এটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ভেবে দেখবে যে সে সম্পর্কটায় তুমি ক্রমশ সেই মানুষটার কন্ট্রোলে চলে যাচ্ছ কিনা। কাউকে ভালোবাসা মানে কিন্তু নিজের জীবনের রিমোট কন্ট্রোল তার হাতে তুলে দেওয়া নয়। নিজের জন্য স্পেস রেখে যে ভালোবাসা, সেই আসল ভালোবাসা মনে রেখো। ভালোবাসা মানে অন্যের মত হওয়া না। ভালোবাসা মানে একে অন্যকে বোঝা, তার ভালোতে সাহায্য করা, তার খেয়াল রাখা। ভালোবাসা মানে একটা দায়িত্ব। সেটা সুখের একটা কারণ শুধু না কিন্তু। যদি তাই হয়, তবে তুমি নেশায় পড়ে গেলে। জীবনে এমন অনেক টক্সিক সম্পর্ক তৈরি হবে। দেখবে তুমি অন্যমনস্ক থাকছ দিনের বেশিরভাগ সময়ে, তুমি বাড়ির লোকের উপর অকারণে রেগে যাচ্ছো, ভালো বন্ধুদের উপর রেগে যাচ্ছ তারা কিছু বোঝাতে গেলেই, তোমার কিছুতে মন বসছে না, এমনকি তোমার নিজেকেও ভালো লাগছে না। তোমার রাতদিন মনে হবে কি করলে ওকে খুশী করা যায়, তোমার দিকে আরো অ্যাটেনশান আনা যায়। আর তোমার সেই ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়েও তোমার মধ্যে নানা দোলাচাল শুরু হবে। তোমার কখনও মনে হবে সে ভালো, কখনও মনে হবে সে খুব অস্বচ্ছ। তাকে খারাপ তুমি ভাবতেই পারবে না। কারণ তুমি তার নেশায় অন্ধ। এটাকে কিন্তু ভালোবাসা ভেবে ভুল করে বোসো না। আখেরে ক্ষতি তোমার হবে।
তো মোদ্দা কথাটা হল দেখো, নিজের জীবনটার কন্ট্রোল কাউকে দেবে না। নিজেকে সব সময় নিজের চিন্তা-ভাবনা-বিবেচনাশক্তির মধ্যে রাখবে। সে-ই আমাদের জীবনের লক্ষণরেখা মনে রেখো। আর প্লিজ নিজের জীবনটাকে নষ্ট হতে দিও না। জীবন মানে অনেক অনেক অভিজ্ঞতা। অনেক অনেক সম্ভবনা। খামোখা কাউকে নিজের জীবনের গডফাদার বানিয়ে লাভ কি? তবে কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করবে না? করতেও পারো, নাও পারো। তবে ঈশ্বর সম্বন্ধে একটাই কথা আজীবন বিশ্বাস করতে পারো, তোমার মধ্যে যা কিছু ধৈর্যবান, সেই ঈশ্বর, সেই ভালো। ঈশ্বর কাউকে নিয়ন্ত্রণ করেন না। তিনি শুধু আলো। শ্রীঅরবিন্দ বলতেন, ঈশ্বর তোমায় পরিচালিত করতে পারেন তাঁর আলোকিত পথে, কিন্তু তোমায় তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া তাঁর কাজ না।
আর যদি তুমি ঈশ্বরকে না মানো, তবে সবসময় ভালো ভাবনাকে সঙ্গে রাখবে। সে যেখান থেকেই আসুক। ভালো যা কিছু তাকে কখনও ছাড়বে না। সেই তোমার সারা জীবনের সম্বল জেনো। ভালো থেকো সবাই। আত্মদীপ ভব। নিজেই নিজের আলো হও। আমার অনেক ভালোবাসা জেনো।