"The purpose of education is not just the acquisition of knowledge or information. The purpose of education is to teach students to think independently, critically and to not accept given knowledge unquestioningly. Today, Japan is the world leader in making several kinds of appliances. Computers finish the tasks they are given quickly and accurately; but the questions of the next century are going to be, what tasks do we assign computers? How do we satiate their endless hunger? These questions will require independent thinking. Our education system has neglected to nurture this quality, and we will feel its absence painfully in the next century."
~ Narendra Dabholkar
আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা বাজাতে, সাজতে যতটা পছন্দ করি, নিঃশব্দে আত্মমগ্ন হতে ততটা পছন্দ করি না। আমি এই ক'দিন অনেকের মুখে দাভোলকার ও গৌরি লঙ্কেশের হত্যার কথা শুনেছি। কিন্তু যখন তাদের প্রশ্ন করেছি, আপনারা কি দাভোলকারের লেখা দুই খণ্ড ‘দ্য কেস ফর রিজ্ন’ বা শেষ লেখা ‘প্লিজ থিংক’ পড়েছেনে? আমি এখনও অবধি কাউকে পেলাম না যিনি বললেন, হ্যাঁ পড়েছি। এতদিন কথা মেসেঞ্জারে হয়েছে, এইবার হয় তো এই লেখার পর কাউকে পাব যিনি বলবেন, হ্যাঁ পড়েছি। আশা করব তিনি সত্যি কথাই বলবেন।
দাভোলকারের কথাতেই আসি, তাঁকে নিয়ে লিখব বলেই এই লেখা। দাভোলকারের দুর্ভাগ্য হল তাঁর মৃত্যু নিয়ে ভারত যত আলোড়িত, তার কর্ম নিয়ে নয়। একই দুর্ভাগ্য কৈলাশ সত্যার্থীর মত নোবেলজয়ীরও, যিনি ফেসবুক পেজে উপস্থিত থাকলেও তাঁকে অনুসরণ করার মত মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। আমার বন্ধু তালিকার কয়জন সেখানে আছেন দেখতে গিয়েও হতাশ হয়েছি। এখন তিনি খবর হবেন কেন? তাঁর না আছে গ্ল্যামার, না আছে তাঁকে নিয়ে আপাতত কোনো মশালাদার খবর। তবে? আমাদের মনোরঞ্জন নিশ্চয় শুকনো পাণ্ডিত্যের কচকচানিতে হবে না। আমাদের সুখ তো অন্যখানে।
দাভোলকারের দুর্ভাগ্য তাঁর মৃত্যু নয়। যে মানুষই অকপট নির্মল সত্য বলতে গেছেন তাদের বেশিরভাগ মানুষের কপালেই জুটেছে একই শাস্তি। তিনি খ্রীষ্ট হোন, কি খ্রীষ্টকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আরেক কুসংস্কারময় চার্চের বিরুদ্ধে বলা স্পিনোজা হন। স্পিনোজাকে হত্যা করা হয়নি, তবে তার থেকে অনেক বেশি করা হয়েছে। অমন আদ্যন্ত ঈশ্বরমগ্ন মানুষ, যিনি প্রথাগত ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলেই সেই বিপদে পড়েছিলেন। স্পিনোজা রাসেলের সব চাইতে প্রিয় দার্শনিক ছিলেন। এবং আইনস্টাইনের প্রাণপুরুষ ছিলেন। আইনস্টাইন এতটাই মগ্ন ছিলেন স্পিনোজার ভাবনায় যে ওনার বাড়ি গিয়ে ওনাকে নিয়ে একটা কবিতাও লিখে এসেছিলেন।
যে কথাটা বলছিলাম, দাভোলকারের মৃত্যু ততটা দুর্ভাগ্য নয়, যতটা দুর্ভাগ্য তার লেখাগুলোকে এইভাবে ভুলে যাওয়া। আমি এখনও দেখিনি কোনো বাঙালিকে যে তার লেখাগুলোর অনুবাদের বিষয়ে কিছু লিখছেন। আমার বিশ্বাস কেউ না কেউ তো অবশ্যই ভেবেছেন। হয় তো প্রকাশ্যে আসেননি এখনও। দাভোলকারকে ভুলতে আমাদের বেশিদিন লাগবে না। কিন্তু দাভোলকারের মৃত্যুর প্রসঙ্গ আমাদের তর্কের বিষয় থেকে যাবে। আমাদের ওতেই সুখ যে। যেমন নেতাজীকে নিয়েও। নেতাজী রচনাবলী নিয়ে বাঙালির ততটা মাথাব্যথা নেই, যতটা মাথাব্যথা তাঁর মৃত্যু নিয়ে। নেতাজীকে তো ছাড়ুন, বাঙালির একটাই বই নোবেল পেয়েছিল। বইটার আকার ও মূল্যও তেমন কিছু নয়। কিন্তু ক'টা বাঙালির বাড়িতে সেই বইটা থাকে? তবে রবীন্দ্রনাথের ভাগ্য এনাদের থেকে অনেক ভালো। অবশ্যই সুনীলবাবুকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে হয়, সে ওনার গানের জন্য।
সত্যিই তো তাই, নইলে যদি জিজ্ঞাসা করি ‘মানুষের ধর্ম’ বা ‘রিলিজিয়ন অব ম্যান’ কতজন পড়েছেন? অমনি হাতের সংখ্যা কমে যাবে। রবীন্দ্রনাথ তো আমাদের চিত্তের ভারহরক এখন, জ্ঞানের আলোকবহক কোন দুঃখে হতে যাবেন? তাই না?
যদি দাভোলকারের রচনাবলী পড়া যায়, মানে যে ক'টা ইংরাজিতে অনুবাদ হয়েছে আর কি, সুপাঠক বাঙালিরা নতুন কথা কিছু পাবেন না। কেন বলুন তো? আমাদের মাটিতে আর একজন মানুষ জন্মেছিলেন, আমার বলতে লজ্জা লাগছে, কষ্ট হচ্ছে তার কথা, যার রচনাবলীই এখন তত ‘জনপ্রিয়’ নয়, তিনি হলেন - আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। বলুন তো তার কোন লেখাটা আমাদের পাঠ্য ছিল স্কুলে? তার কোন লেখা পড়ে আমাদের মনে হয়েছে, না এই মানুষটাকে আমাদের আলোকস্তম্ভ করা যেতে পারে? মনে হয়নি। কারণ আমাদের সামনে তাঁকে সেভাবে আনাই হয়নি।
প্রফুল্লচন্দ্র পড়লে আপনি যে স্পিরিটটা অনুভব করবেন, সেই একই স্পিরিট আপনি অনুভব করবেন দাভোলকারকে পড়লে। শুধু তার ভাষা আলাদা, তার উদাহরণগুলোতে নতুন করে যোগ হয়েছে অধুনা গডম্যানদের কথা।
সমস্যা হচ্ছে, শব্দ নিয়ে। আমরা হঠাৎ করে দাভোলকারকে র্যাশেনালিস্ট বলে দিচ্ছি। এখন কথা হচ্ছে, 'র্যাশেনালিস্ট' শব্দটার মাধ্যমে আমি যদি নাস্তিকতা বোঝাচ্ছি, তবে ভুল বলছি। কারণ, দেকার্ত, স্পিনোজা, কান্টকে র্যাশেনালিস্ট বলা হয়, যারা নাস্তিক ছিলেন না। আবার যদি শুধু 'যুক্তিবাদী' বলি, তবে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, বিবেকানন্দ, রমণ মহর্ষি, অরবিন্দ, রাধাকৃষ্ণাণ, জে কৃষ্ণমূর্তি প্রমুখ প্রত্যেকেই একই গোত্রের হবে, যারা কেউ নাস্তিক ছিলেন না। 'র্যাশেনালিস্ট' মানে কিন্তু 'মেটেরিয়ালিস্ট' নয়। মানে একজন মানুষ যুক্তিবাদী হবেন বলেই যদি বস্তুবাদী হবেন ধরে নিই, তবে সে আমার বোঝার ভুল। আর যিনি শনিমন্দিরে পুজো দেন ছেলের ভালো রেজাল্ট হবে বলে - তার ঈশ্বরে বিশ্বাস, আর রমণ মহর্ষি বা রামকৃষ্ণ বা জে কৃষ্ণমূর্তির ঈশ্বরের উপলব্ধিকে যদি এক গোত্রে ফেলতে চাই, তবে যুক্তিমননকেই প্রশ্ন করতে হয়।
দাভোলকার কুসংস্কার, অকাল্ট প্র্যাক্টিসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। তিনি প্রফুল্ল রায়ের মত একই সুরে আক্ষেপ করে গেছেন, যে এত এত বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও মানুষ কেন কুসংস্কারমুক্ত হচ্ছে না? কেন মানুষের ভাবনা যুক্তিগামী হচ্ছে না? দাভোলকারের বিস্ময় আক্ষেপ প্রফুল্ল রায়ের থেকে আরো বেশি কারণ বিজ্ঞানের ছাত্র আমাদের এখন আরো অনেক অনেক। তবে কেন এত কুসংস্কার? দাভোলকার বিবেকানন্দ থেকে কোট করছেন তাঁর বইতে,
"Should religion use the same kind of logic that every branch of science uses to establish itself? Should religion use the same tools and methods that science uses to make sense of the world around us? My answer to both these questions is yes, the sooner the better. If doing so causes the religion to collapse, then that religion was never a religion—it was a meaningless, useless superstition. I have not the smallest doubt that it is glorious for such superstition to crumble and fall. All weeds must be uprooted and the real core of religion ought to be revealed, refined and shining, in this process. Religion ought to have the same scientific approach that physics or chemistry has. This will let it become more adept. (বিবেকানন্দ)"
তার কারণ অবশ্যই লোভ আর ভয়। মানুষের সত্তার সঙ্গে এ দুটো ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এন রাম, দ্য হিন্দুর এডিটর, দাভোলকার আর গৌরি লঙ্কেশকে নিয়ে লিখতে গিয়ে লিখছেন, বিবেকানন্দ যখন শিকাগো স্পিচে বলছেন যে, ‘বেদান্ত দর্শন শুধু অন্যধর্মের প্রতি সহিষ্ণু নয়, সে সব ধর্মকে সত্য বলে জানে’... এই উদার চেতনার ভারতবর্ষ কি হারিয়ে যেতে পারে 'হিন্দুত্বা'র চেতনায়? আসলে এই চেতনা আর লোভ আর ভয়ের প্রবৃত্তি তো এক নয়। চেতনা এক জিনিস আর প্রবৃত্তি আরেক জিনিস। লোভ আর ভয়কে দিয়ে যা করিয়ে নেওয়া যায়, চেতনা দিয়ে তা কি সম্ভব?
যখন স্কুলের সিলেবাস বানানো হচ্ছিল, তখন কেন সব ধর্মের মূল শিক্ষাগুলোকে নিয়ে একটা ক্লাস হল না, যে কথা গান্ধী বহুবার বলেছিলেন? ব্যক্তি ঈশ্বরে বা প্রতিষ্ঠিত ধর্মে বিশ্বাসী হই চাই না হই, সমাজে ধর্মের অস্তিত্বকে না মানার তো কারণ নেই। যা আছে তাকে আরো স্পষ্ট করে জানাতে অসুবিধাটা কোথায় ছিল? তবে তো রামকৃষ্ণের সেই শিক্ষা - একই জল, কেউ বলে পানি, কেউ বলে ওয়াটার, কেউ বলে অ্যাকুয়া - এ সবার সামনে আসত! কবীর, নানক, লালন, তুকারাম - এদেরই বা বাদ দেওয়া কেন হল?
ঈশ্বরবোধে ব্যক্তি ঈশ্বর ও নৈর্ব্যক্তিক ঈশ্বর দুইয়ের কথা আছে। রমণ মহর্ষি থেকে রামকৃষ্ণ, খ্রীষ্ট থেকে বুদ্ধ, প্রত্যেকে জগতে সেই নৈর্বক্তিক ঈশ্বরের অস্তিত্ব বলতে মানুষের চেতনায় জাগা শুভবোধকে বলেছেন। যা ধর্মের সত্যকারের রূপ। যাকে স্পিনোজা, কান্ট নিজের চেতনায় উপলব্ধি করেছেন। আজকের মনোবিদেরাও মানুষের চিত্তে এক সার্বজনীন বিবেকবোধের অস্তিত্বকে মেনে নেন, যার উপর দাঁড়িয়ে হিউম্যান রাইটস্, নোয়াম চোমস্কির মতে।
আজ দেবদত্ত পট্টানায়েক লড়ে যাচ্ছেন হিন্দুত্বার আইডিয়ার বিরুদ্ধে। না, কোনো বাঙালিকে দেবদত্ত পট্টানায়েকের মত ক্ষুরধার যুক্তিতে লড়ে যেতে দেখছি না। তিনি গালাগাল খাচ্ছেন, সত্যিকারের হিন্দু ধর্মের আসল রূপটা সামনে আনতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অক্লান্তভাবেই করে যাচ্ছেন। আমরা শুধু লাফাঝাঁপি করছি, ধুলো ওড়াচ্ছি, না নিজে স্পষ্ট দেখছি, না অন্যকে স্পষ্ট দেখতে দিচ্ছি। তিলকে তাল করছি। তালকে সার্বজনীন ফল বলছি, কিন্তু আলোর মশালটা হাতে নিতে চাইছি না। গভীরে গিয়ে খুঁজে দেখতে চাইছি না, আপাত বলে যা চোখে ঠেকছে, সেই কি আসল? এ প্রশ্নও করছি না।
না, সে সবে আমাদের মতি নেই বলে দাভোলকারের লেখা নিয়ে আমাদের আগ্রহ নেই। আমাদের আগ্রহ কোন্দলে। আমাদের আগ্রহ মুড়িমিছরি এক করায়। তিলকে তাল করায়।
এইটুকু বলে শেষ করি, দাভোলকারের উক্ত বই তিনটে আমাজনে পাওয়া যায়। কিণ্ডলেও পাওয়া যায়। একটু দেখবেন।
আর একটা কথা, আশারাম, রামরহিম এত কিছুর পরেও জেলে যায়। সুপ্রিম কোর্ট ঝাঁঝিয়ে বলে, এ দেশ শাস্ত্র দিয়ে শাসিত নয়, আইন দ্বারা শাসিত। এগুলো আশার কথা। এ দেশ বেদান্ত দর্শনের - এক সত্য, যার বহুভাষ্য। এ দেশ রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, তুকারাম, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, বিদ্যাসাগরের। এ দেশেই শিরডির সাঁই, যিনি মসজিদে সারাটা জীবন কাটিয়েও লক্ষকোটির হিন্দু ভারতীয়ের ইষ্টদেবতা, যার বিরুদ্ধে স্বয়ং বর্তমানের শঙ্করাচার্য বলেও কিচ্ছুটি করতে পারেননি। যুক্তির উপরে জাগে প্রজ্ঞা। যাকে ইংরাজিতে 'ইনটুইশান' বলে। শোপেনহাওয়ারের মতে বেদান্ত শ্রেষ্ঠ দর্শন। কারণ প্রজ্ঞার আলোকে আলোকিত। যার মূল ভালোবাসা ও অনুকম্পা। হিন্দুত্বা'র ঢেউ ভারতে আগেও উঠেছে, এখন উঠছে, আবারও আসবে। কিন্তু বিজ্ঞান যেমন ম্যাজিক না। ধর্ম তেমন ম্যাজিক না। বিজ্ঞান মানুষের যুক্তিবোধের সার্বজনীনতা। ধর্ম মানুষের নৈতিকবোধের সার্বজনীনতা। কোনোটাই সহজলভ্য নয়। আবার দুর্লভও নয়। ভারত হাঁটুক যুক্তিতে, জাগুক প্রজ্ঞায়।
"While doing this work, it will not do to get angry at people, or make fun of them for being stupid. We need to constantly and empathetically engage with people. The road is long but it is the right path. Ultimately, our struggle is to change people in society. And that requires compassion rather than anger; belonging rather than belittling."
~ Narendra Dabholkar