অপু দিদির সাথে কাশের বনে ছুটেছিল। শরতের সেই দৃশ্যই হয়ত বা বাঙালীর মনে শেষ ডক্যুমেন্টেড শরতের দৃশ্য তার আগে পরে আরো ছিল আর হবেও বা। কিন্তু সেই দৃশ্যটাই আমাদের শরতের সিগনেচার টিউন।
তারপর বাঙালী শরৎ ছেড়ে হল শারদীয়ার। শারদীয়া শব্দের উৎস যদিও শরৎ, তবু শারদীয়া আর শরতের রইল না। বাঙালীর শরৎ মানে সেপ্টেম্বর আর অক্টোবর। শরৎ কাশ নীলাকাশের মাধুরী ছেড়ে এলো প্যাণ্ডেলের আর আলোকসজ্জার প্রতিযোগিতায়। শারদীয়ার উৎসব ক্রমে ঐতিহ্য থেকে হল ব্যবসায়ীদের তুরূপের তাস। মিডিয়ার হটকেক তুল্য স্টোরি। অনলাইন কেনাকাটার 'বাম্পার অফার'। উৎসব হল উচ্ছ্বাস। হৃদয়বৃত্তি ম্লান হল আবরণ আর আভরণের ঐশ্বর্যবৃত্তির চাকচিক্যে।
রবীন্দ্রনাথের উৎসবের সংজ্ঞায় - মানুষ মিলিত হয় যে নিমিত্তে। কিন্তু উচ্ছ্বাসের জোয়ারে মানুষ শুধু একত্রিতই হয়, মিলিত আর হয় কই? লাইনে দাঁড়ানো হাজার হাজার মানুষ, এ ওর আগে যেতে চাইছে, এ ওকে ঠেকে গুঁতিয়ে ফেলে মাড়িয়ে পারলে সবার প্রথম প্রতিমার সামনে দাঁড়াতে চাইছে। তারপর? প্যান্ডেলের আভ্যন্তরীণ কারুকার্য, দেবদেবীর অঙ্গসজ্জা, আভরণ, গঠনের কায়দা ইত্যাদিতে চোখ ধাঁধানো বিস্ময় - “হ্যাঁরে কত খরচ করে থাকবে সব মিলিয়ে? কয়েক কোটি তো হবেই, না?” ক্ষুদ্র, সামর্থহীন, লোভ-সমাকুল বাঙালী চিত্তে গর্ব-ঈর্ষা-ক্ষোভের মিলিত আন্দোলন। কিন্তু দাঁড়াবার সময় নেই, আরো প্যাণ্ডেল 'হপিং'-এ যেতে হবে, ফেসবুকের টাইমলাইন ক্ষুধার্ত চোখে তাকিয়ে, বন্ধু-বান্ধব-পরিচিত-অপরিচিতের সাথে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের ব্ল্যু হোয়েলে নাম লেখানো - 'আমার দূর্গাপূজা'...'ফিলিং ফেস্টিভ'...ইয়া...হুউউউউ!
ভোগ পরকে তাড়ায় নিজেকে বাড়ায় - এটা গুরুবাণী। উৎসবের যে মাধুর্য, যে আত্মত্যাগ, যে বন্ধুত্বপূর্ণ উষ্ণ অভ্যর্থনা - বাঙালী তা ভুলেছে। বাঙালী খুব সহজে ভোলে। শুধু কোথায় কতটুকু গর্ব করতে হবে সেটুকু বাদ দিয়ে সে চর্চা থেকে গসিপে অনায়াসে ঢল নামাতে পারে। তার রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-বিবেকানন্দ-সত্যজিৎ ইত্যাদি ইত্যাদি শুধুই ভারতীয় অবাঙালীদের থেকে উঁচু সিটে বসার জন্য, নিজের চর্চার জন্য না। আর বিদেশীদের সামনে তো তারাও খড়কুটো, ওদের দেশের প্রতিভার কাছে আমাদের প্রতিভা! ছোঃ!
লোভ তাই মূলমন্ত্র এ তথাকথিত উৎসবের। আর লোভের স্বভাবই হল - অসামঞ্জস্য। তারই প্রতিফলন চতুর্দিকে এই ঐতিহ্যমণ্ডিত উৎসবের বুকের রক্তপান করে। সে গান, সে সাহিত্য, সে পাড়ার কাকিমা-জেঠিমা-কাকু-জেঠু-দাদু-দিদারা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে? এত হৃদয়হীন আত্মপ্রচারের ভিড়ে কোথায় নিজের ঠাঁই খুঁজে পাওয়া যায়? দূর থেকে জনসমাবেশ চোখে পড়ল, কাছে গিয়ে দেখি এরা একে অন্যের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে খুব কাছাকাছি, যেন বন্ধুত্বের থেকেও কাছাকাছি। তাই ঈর্ষায়, পরশ্রীকাতরতায়, শত্রুতায় যত সহজে আজ বাঙালী মনের বিশ্বাস, ততটা সহজে বন্ধুত্বে, মানবিক স্বভাবজাত সহমর্মিতায় নয়। উদাহরণ - মহম্মদ আলি পার্কের ঘটনা। এত নিষ্ঠুর, আত্মকেন্দ্রিক, স্ব-অবমাননার আড়ম্বর বিশ্বের আর কোথায় কোথায় হয় জানা নেই আমার।
সব শেষ হলে আসে ট্রেনে ঝোলা, বাসে ঝোলা, নাকে-মুখে দুটো গ্রাস পুরে জীবনযুদ্ধে ঝাঁপানো বিষন্ন, অবসাদগ্রস্থ বাঙালীর দল। যেন খুব শীগগির একটা মধ্যরাতের প্রমোদাগার থেকে জেগে উঠেছে সব। অস্বাভাবিক, অস্বাস্থ্যকর স্নায়বিক উন্মাদনার ভারে দুর্বল বাঙ্গালী শরীর আর ক্লান্তির ভার বহন করতে পারছে না। কিন্তু বাঙালীর অফিসজুড়ে এখন লক্ষ লক্ষ বিদেশী ক্লায়েন্ট। বাঙালী ক্লান্তির হাই তুলতে তুলতে কম্পিউটার অন করতে করতে বলছে, ওয়াটস অ্যাপ করছে - হ্যাপি বিজয়া!
বিজয়ায় কার বাড়ি যাব? কেন যাব? কেন মরতে মরতে নাড়ু বানাবো, মিষ্টি বানাবো? ওদের কাজ ছিল না, বোকা ছিল বলে সারাদিনরাত পাগলের মত খেটে ওসব ছাইভস্ম বানাতো আর বারোভূতে গেলাতো। কেন রে বাবা, মিষ্টির দোকানগুলোতে আছে। স্ন্যাক্স-এর ভ্যারাইটির তো বাজারে অভাব নেই! অগত্যা কিছু সিদ্ধি, কিছু ভাং এখনও কোথাও কোথাও টিকে থাকলেও স্ব-মহিমায়, বিজয়ার আপন করার দিন গেছে। সেদিক থেকে আমরা অনেকটা অকপট হয়েছিই বলা চলে। হৃদয়ে যে সৌহার্দ্য আর নেই, অকারণ বাইরে তার প্রদর্শন করে লাভ কি? একান্তই যদি না তাতে আমার বৈষয়িক কিম্বা মর্যাদার কোনো উন্নতির সম্ভাবনা থাকে? যদি থাকে, তখন মেরুদণ্ডের নমনীয়তা প্রদর্শন আমাদের কাছে শিখে যেও, তখন আমার বারোমাস বিজয়া। তা বলে অমন হাড়-হাবাতে মাসিমা জেঠিমার বাড়ি যাব কেন? কি এমন করে ওর ছেলেরা? যত্তসব!
ক্লাব থাকুক, পার্টি থাকুক, চাঁদার জুলুম থাকুক (জুলুম না, আবদার যদিও ওটা সাংবিধানিক পরিভাষায়), ভুরিভোজ থাকুক সব থাকুক। শুধু এতকিছুর মধ্যে আমার ভিতরের 'আমি'টা কিছুতেই আর 'আমরা' হওয়ার সুযোগ পেল না, এই ক্ষোভটাও থাকুক। নইলে ভবিষ্যতে আলো জ্বালবার জন্য শেষ সলতেটাও তো হারাবো!