শব্দগুলো যে সবসময় ভাব বা চিন্তা প্রকাশের সহায়ক হয় তা তো নয়, অনেক সময় যথেষ্ট প্রতিকূল অবস্থাও সৃষ্টি করতে পারে। বাধাও হয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের শৈশবের স্মৃতিগুলো বেশিরভাগই বাঙ্ময় নয়। সেখানে ছড়ানো ছেটানো প্রথম স্পর্শের অনুভূতি, প্রথম দেখার অনুভূতি, প্রথম স্বাদের অনুভূতি। সেদিন কি করে করে হঠাৎ নিজের ছোটোবেলায় কাটানো শহরে পৌঁছে গিয়েছিলাম। দেখলাম সব স্মৃতিরা তাদের অস্তিত্ব গাছে, রাস্তায়, আকাশে, বাতাসের স্পর্শে, ফুলের ঘ্রাণে বাঁচিয়ে রেখেছে। সম্পূর্ণ ছোটোবেলাটা যেন আমার থেকে আলাদা হয়ে আবার আমার সাথে সম্পৃক্ত হয়েও আমার সামনে এসে দাঁড়াল। কথা বলল না। কিন্তু তার সেই নির্বাক বিশুদ্ধতায় নিজের পূর্ণরূপটা দেখলুম মনে হল। সেখানে সংজ্ঞা নেই, কোনো ধারণার অচল সীমারেখা নেই, সবকিছুই ভীষণ পেলব অথচ পূর্ণভাবে অকৃত্রিম। মনটা স্নিগ্ধ হল। যেন সেই সময়টার মধ্যেই ধরা থাকে জীবনের সম্পূর্ণ অর্থটার বীজ। তাই সারাটা জীবন নানান অভিজ্ঞতার শেষে মনে হয় সেই আপাত অর্থহীন, গতিময়, নিষ্পাপ সময়টাতে ফিরে যাওয়ার জন্যই যেন এতটা পথ হাঁটা।
ফুল যা ছিল পূজার তরে
যেতে পথে ডালি হতে অনেক যে তার গেছে পড়ে।
কত প্রদীপ এই থালাতে সাজিয়েছিলে আপন হাতে
কত যে তার নিবল হাওয়ায়, পৌঁছল না চরণছায়ে।।
তাই তো। সব প্রদীপ তো জ্বালা থাকল না, সব ফুলও তো নিয়ে আসা গেল না পূজার বেদী অবধি। কিছু কাড়ল অন্যমনস্কতা, কিছু কাড়ল লোভ, কিছু কাড়ল ভাগ্য। তবু সবটুকু যে নিঃশেষ হয়নি এই পরম ভাগ্য। তাতে লজ্জা পেতাম আমি তো অবশ্যই, বোধকরি সেও পেত।
এক বৃদ্ধ পূজারী আসতেন বাড়ির বিশেষ কোনো পূজো থাকলে। একদিনের স্মৃতি মনে এলো, পূজো শেষে উনি চা খাচ্ছেন, সামনে আমি বসে। আমায় বললেন, “দেখো, এই যে আমরা এত মূর্তি গড়ে পূজো করি, শেষে কি করি? ভাসিয়ে দিই। বাইরের জলে না হলেও মনে মনে তো বিসর্জনের মন্ত্র পড়তেই হয়। যেমন করে আমরা ঈশ্বরকে এই মূর্তির মধ্যে আবাহন করি, তেমন তাকে বিদায়ও তো দিই। তবেই বোঝো অবশেষে সব আকারহীন, আকৃতিহীন, অবয়বহীন... কিন্তু অস্তিত্বহীন নয়। অথচ এই সহজ কথাটা না বুঝে দেখো, আজ ধর্মের নামে, ঈশ্বরের নামে কি মারামারি।”
বলার শেষে একটু হাসির রেখা দেখা দিল ওনার ঠোঁটের কোণে। ওনার মলিন ধুতি, গায়ে নামাবলী, বয়সের লক্ষণ ফুটে ওঠা অশক্ত শরীরে যে কথাগুলো উচ্চারণ করলেন, তা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উনি শেখেননি, শিখেছেন নিজের সহজ জীবনবোধ থেকে। শৈশবের কাছে প্রকৃতি যে সুষমায় ধরা দেয়, বয়সের সাথে সাথে মোহমদের আবরণে সে ঢাকা পড়তে শুরু করে। তাই সহজ অনুভূতিগুলো জটিল হতে শুরু করে। পাপ জন্মায়। পাপ শাস্ত্রের নিয়মে জন্মালে তার হাজার একটা প্রায়শ্চিত্তের পথ আছে, যেমন অমুক নক্ষত্রে স্নান, দক্ষিণা ইত্যাদি। কিন্তু পাপ প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণে জন্মালে প্রায়শ্চিত্তের একটাই পথ - ফলভোগ আর তার থেকে উত্তরণের পথ খোঁজা। মানুষই একমাত্র জাত, যে নিজেকে মানুষ বলে অনুভব করে। সে অনুভব কেবল শরীরের সত্তায় নয়, তবে মানুষের শরীর আর মনুষ্যত্ব দুটো পৃথক শব্দ হত না যেমন আর সব প্রাণীদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। মানুষের প্রকৃত শিক্ষা তাই ওই শৈশবেই - প্রকৃতির নীরবতায়, প্রকৃতির মুখরতায়, প্রকৃতির বৈচিত্রতায়, প্রকৃতির সামঞ্জস্যে, প্রকৃতির গতিময়তায়, প্রকৃতির স্থবিরতায়, প্রকৃতির রূপে, রঙে, শান্তস্নিগ্ধরূপে, আবার প্রবল দুর্যোগে।
মুশকিল হচ্ছে শিক্ষাটা ব্যবসা হয়ে যাচ্ছে সেই চোখ ফোটা বয়েস থেকেই। অত্যন্ত স্মার্ট, কেতাদুরস্ত, চলন-বলনশীল তো হচ্ছেই, কিন্তু সামঞ্জস্য রাখার শিক্ষাটা অধরা থেকে যাচ্ছে। কারণ সামঞ্জস্য শিক্ষা, মাত্রাজ্ঞান, রুচিবোধ কোনো প্রত্যক্ষ শিক্ষার ফল তো নয়, সেটা সব সুশিক্ষার মন্থনজাত সুধা। যে সুধায় সে নিজে তৃপ্ত হয়, সমাজ তৃপ্ত হয়।
যেটা শুরুতে বলছিলাম, শব্দের বাধা। এই বিপণনসর্বস্ব যুগে খোলা হাওয়া একটা অস্তিস্ব সংকটের সংকেত। এক সময় ছিল রাজা-উজিরদের বানানো have & have not -দের বিভাজন, আজ সেই দাগটা টানছে কপট উদার অর্থনীতি। ষড়রিপুর তৃতীয় রিপুটি সম্বন্ধে ভাগবত বলছেন দুষ্পুরণীয়। অর্থাৎ বাকিগুলো কোনো না কোনো ভাবে নিজেদের তৃষ্ণা নিবারণের পর থামতে জানে, কিন্তু লোভের কোনো ইতি নেই। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে, সাধারণ কোষ আর কর্কট কোষের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, প্রথমজন থামতে জানে, তার মাত্রজ্ঞান আছে, সামঞ্জস্যবোধ আছে, কিন্তু দ্বিতীয়জনের তা নেই। সে কেবল বেড়েই চলে, বেড়েই চলে। অবশেষে একদিন দেহের পূর্ণ সামঞ্জস্যকে নষ্ট করে তাকে মৃত্যুর মুখে ছুঁড়ে ফেলে। কিন্তু এ তো শরীরের কথা।
প্রকৃতির একটা আত্মগতগুণ তার সামঞ্জস্যবোধজাত সন্তোষের অনুভব। সন্তোষ আর বাসনা পূরণহেতু সুখের মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রথমটা একটা সক্রিয় অবস্থা, আর দ্বিতীয়টা দুটো চঞ্চল অবস্থার মধ্যের নিষ্ক্রিয় অবস্থা। দ্বিতীয়টার ঘোর কাটানোর জন্য বিজ্ঞাপন জগতের রথী-মহারথীরা আছেন। সংসারে কারা সফল আর কারা বিফল অর্থাৎ প্রচলিত ভাষায় লুজার তার সংজ্ঞাও সেই বিপণন জগতের অদৃশ্য রাজার অঙ্গুলি নির্দেশে হয়। তবে আর যাই কোথায়?
শেষ করি শিক্ষা দিয়েই। শিশুর কাছ থেকে প্রকৃতিকে কেড়ে নেওয়ার মত অপরাধ কমই আছে সংসারে। প্রকৃতির একটা নিজস্ব ভাষা আছে শিশুর সাথে নিজের যোগাযোগ স্থাপন করার। তার মধ্যে এমন কিছু বোধ প্রতিষ্ঠিত করার যা তার সারা জীবনের পাথেয়। উপায়? প্রকৃতি বলতে শুধু নদী-পাহাড়-সমুদ্র তো বোঝায় না, প্রকৃতির আরেকটা অর্থ অকৃত্রিম যা। ভাষার সাথে বোধের যোগাযোগকে বলি শুদ্ধতা। ভাষা যদি আবেগ আর মতের ব্যাখ্যানের অস্ত্র হয় শুধু, তবে মানসিক ভারসাম্যহীন একজন ব্যক্তির চেয়ে অকপট ব্যক্তি সংসারে আর নেই, কারণ সে প্রতিনিয়ত তার আবেগ আর মতের প্রকাশই ঘটিয়ে চলেছে। শুধু বোধের অভাব বলেই তাকে ব্রাত্য বলছি সংসারে।
এই বোধের শিক্ষাই প্রকৃতির শিক্ষা। প্রকৃতির নৈকট্যজাত শিক্ষা। এ অন্ধকার ঘরে হয় না, ব্ল্যাকবোর্ডে হয় না, পরীক্ষাগারে হয় না, বইখাতাতে হয় না। সেগুলো রথের সাজসজ্জা... রথীর কথা কি ভাবব না? রথের মূল্য রাখতে যে রথীর অস্তিত্ব সংকট হয়ে আসছে... সে ভাবার কি সময় হয় নি?
ভাষা হোক বোধজাত। শব্দ কারাগার না হোক, বোধনিঃসৃত জ্যোতির ধারক আর বাহক হোক।