Skip to main content

"অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা"
আমি 'শয়তান' শব্দটায় আস্থা রাখি না। তবে আবর্জনা আর বিপথ বা কুপথের অভিজ্ঞতা রাখি। সাথে বিভ্রান্তিকর পথেরও। আগে ভাবতাম, 'কর্মহীনতা' আর 'অলসতা' হয়তো সমার্থক দুটো শব্দ। তা তো নয় দেখছি। মনের অলসতা আর বাইরের কাজের ধারাবাহিকতা অনায়াসে একসাথে সহাবস্থান করতেই পারে। বিশেষ করে কাজটা যখন ধারাবাহিকভাবে একই ধারার হয়ে ওঠে। কয়েকদিন আগে একটা বিদেশী সংবাদপত্রে পড়ছিলাম, অতিব্যস্ততা মানুষকে ক্রমশঃ মানসিক অনুর্বরতার দিকে নিয়ে যায়। ক্রমশঃ তা তার সৃষ্টিশীলতা তথা তার উদ্যমকে কমাতে থাকে। ফলঃস্বরূপ কোনো আকস্মিক পরিবর্তনকে নিতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়ে। 
এই কথাগুলো কিছু নতুন না অবশ্য। সক্রেটিসের বহু পুরোনো উক্তি, 'অতিব্যস্ত জীবনের অনুর্বরতা সম্বন্ধে নিজেকে সচেতন রেখো।' 
যে কথাটা বলতে চাই, অলস চিন্তায় কি সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'মহৎ কাজের জন্য অবসর প্রয়োজন, আলস্য না।' অবসর অর্থে কখনোই অতিরিক্ত সময় নয়। অবসর অর্থে 'তাড়া নেই' এমন সময়, অথবা একান্ত আমার নিজের জন্য সময়। সেই অবসরকে হয় আলস্যে কিম্বা মহতের সৃষ্টিতে ব্যয় করা যেতে পারে। এখানে মহৎ অর্থে আমি ভালো বোঝাতে চাইছি। তবে ভালো শব্দটার অর্থ অনেকটা ন্যাকা বা ডিপ্লোম্যাটিক হয়ে দাঁড়ায় বলে বিপদ। আর মহৎ শব্দে মহাপুরুষোচিত হয়ে দাঁড়ালে তো আরো বিপদ। মহৎ অর্থে যে সাহিত্যে মানুষের কথা অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ অস্বাস্থ্যকর দৃষ্টিভঙ্গীতে বলেই ইতি টানা হয়নি। ঋত্বিকবাবু বলতেন, 'একটা বদ্ধ ঘরে, অন্ধকারে মানুষ কয়েক ঘন্টা ধরে তোমার কাজ দেখবে। শেষে যেন তারা একটা নঞর্থক মানসিকতা নিয়ে ফিরে না যায়।' তাই 'মেঘে ঢাকা তারা' সিনেমার শেষ দৃশ্যে আবার আরেক নীতার চটি ছিঁড়ে যায়। এমনকি 'যুক্তি তক্কো আর গপ্পো'র শেষ দৃশ্যে মৃত্যুর প্রাক মুহুর্তে ঋত্বিক বলে ওঠেন, 'কিছু একটা করতে হবে তো!'
অলস চিন্তার এ বিশ্বাস কোথায়? সে তো সর্বত্র নঞর্থক, ইন্দ্রিয়পরতার গন্ধে লুব্ধ। সে সাহিত্যে উত্তরণের পথ নেই, আছে ক্রমশঃ নিমজ্জমান হওয়ার চোরাবালি। ওই একটা কথা আছে না, 'যদি বা রুগী ছিল বসে, বদ্যি তারে শোয়ালে এসে' - এ খানিকটা সেরকম। লেখার ক্ষেত্রে 'Tone' আর 'Mood' বলে দুটো কথা আছে। প্রথমটা লেখক যে দৃষ্টিভঙ্গী বা শৈলী বা অনুভূতি নিয়ে লিখছেন। আর Mood -এর ক্ষেত্রে যে অনুভূতিটা পাঠকের মনে জাগছে। অবশ্যই প্রথমটার উপর দ্বিতীয়টা অনেকাংশে নির্ভর করছে। 
এই Tone যদি খুব সঙ্কীর্ণ হয়, তবে দেখাটা আর দেখানোটা অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে। ছোট জায়গায় আলোড়ন তোলা অনেক সুবিধা যদিও, তবে তাতে সামগ্রিকতার সাথে সামঞ্জস্যতা রক্ষা করা মুশকিল হয়ে পড়ে। আর ক্ষুদ্রতার লজ্জাটা এখানেই সর্বাধিক যে, সে বড়কে শুধু অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হয় তাই নয়, বড়োকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে তাকে ভয়ংকর রকম অপদস্থ করতে পেরেছে এমন একটা আত্মপ্রসাদও লাভ করে। তাতে দল তৈরী হয়, দলের দলপতি তিনিই নির্বাচিত হন যিনি তার নিজের দলের কাউকে কড়া সমালোচনা কখনোই করেন না। কারণ এক, ছোটো শরীরে অত সহ্য হয় না। যার আপন মহত্ব ক্ষুদ্র পরিসরেই, সে যে কোনো সমালোচনায় অস্তিত্ব সংকটে ভোগে। হিংস্র হয়ে ওঠে, ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। সমালোচক তথা নিজেকেও রাগের বশে আঁচড়ে খিমচে একাকার শুধু করে না, অসম্ভব রকমের অভিমানে নিজের সমস্ত কিছুকেই অনর্থক বোধ করতে শুরু করে মনে মনে। যেন তার সমস্ত সৃষ্টির দায় ছিল পাঠকের মনোরঞ্জনের, তার নিজের প্রকাশিত হওয়ার কোনো সুখ বা আনন্দ ছিল না। এক নিমেষেই সব ব্যর্থ। 
তাই মহত্বের উপর, উদারতার উপর আস্থাহীনতায় কিছুদিনের জন্য কিছু দুর্বলচিত্ত মানুষের হাততালি পাওয়া গেলেও দিনের শেষে নিজের কাছে নিজেকে চূড়ান্ত দীন হয়েই ফিরতে হয়। মনে হয় ভিতরে যেন সে কোথাও একটা হেরে গেল। এটাই আমাদের মানুষ হওয়ার অদ্ভুত Irony যে সে বিশ্বের সকলের কাছে দীনবেশে থাকলেও নিজের কাছে সে কিছুতেই নিজেকে হীন দেখতে পারে না। তাই বৈষ্ণবের আত্মদীনতা কোনোদিনই হীনতার অনুভব নয়। তা হলে আর যা হোক, অমন অমর বৈষ্ণবসাহিত্য সৃষ্টি হত না। হীনতা মৃত্যুতুল্য, তা আপনাকে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে কই?
এমনকি যিনি অত্যন্ত নঞর্থক কোনো লেখাও লেখেন, তখনও তার আত্মকেন্দ্রে কোথাও একটা বিশ্বাস জন্মায় তিনি একটা মহৎ কাজ করছেন। অর্থাৎ নিজের কাছে হীনতার প্রশ্নই আসছে না। তবে তিনি স্বার্থপরের মত তার এই গর্বিত অনুভূতিটাকে ব্যক্তিগত মনে করেন। অত্যন্ত Cynic ব্যক্তিও নিজের Cynicism নিয়ে গর্ব অনুভব করেন। কিন্তু এটা ভাবার প্রয়োজন বোধ করেন না যে কেন এই আত্ম-সার্থকতার অনুভূতিটার মধ্যে স্বপ্রতিষ্ঠিত হতে না পারলে নিজেকে ব্যর্থ অনুভূত হয়।
তাই বলি, স্বার্থপর নিজের মহত্বের অনুভবকে ব্যক্তিগত অনুভব করে রাখতে চান আর উদার মানুষটা প্রত্যেক মানুষকে সেই মহত্বের অনুভূতির স্বাদ পাওয়াতে চান। তিনি বোঝেন, শুধু ক্ষুদ্র সময়ের গণ্ডী আর কালের গণ্ডীতে সত্যকে পাওয়া যায় না। সত্যের ছায়া অথবা আভাস মাত্র পাওয়া যায়। ছায়ার সীমা আছে, তা বাধা আর ক্ষেত্রর উপর নির্ভর করে। আলোর সীমা নেই। তার প্রসারিত আর প্রকাশিত হওয়াতেই আনন্দ। 
তাই মহৎ সাহিত্যকে তথা যে কোনো সৃষ্টিকে শুধু নিজের সময়কাল বা নিজের দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হয় না। চিরকালের ধারার সাথে আর মানবতন্ত্রের ধারার সাথে একটা সামঞ্জস্য পেতেই হয়। না হলে যতক্ষণ আঁচ ততক্ষণ তাপ।
এই গেল অলসতার দিক। এর বিপরীত যে দিক, অর্থাৎ অতিক্রিয়াশীলতা তা শুধু অল্প পরিসরেই সম্ভব। ছোটঘরে আওয়াজ যত বেশি হয়, মাঠে কি আর হয়? সমুদ্রের ধারে তো আরো অসম্ভব! আর আমরা এই মহামানবের সাগরতীরের বিলাসবহুল নিবাসগুলোতে দিন কাটাতে কাটাতে তো ভুলেই যাই মাঝে মাঝে যে, ওই সমুদ্রতীরটায় অবশেষে দাঁড়াতেই হবে। হেসে-কেঁদে একটা রফা করতেই হবে। অসৎ যা কিছু সৃষ্টি তা একদিন মুখব্যদান করে এই সাগরের তীরে পড়ে থাকবে। সব রঙ, নক্সা ওর গা থেকে উঠে যাবে। আমি থাকব না সেদিন, কিন্তু আমার সৃষ্টির লজ্জাটা থেকে যাবে। ফাঁকিটা ধরা পড়ে যাবে, আর চারদিকে হাসির রোল উঠবে।