Skip to main content
 
 
এই লেখাটা কোনোদিন লিখব ভাবিনি। এগুলো যেন আমার পূর্বজন্মের কথা। কিন্তু আজ চারদিকে যা ঘটে চলেছে আমার মন সেই পূর্বজন্মেই ফিরছে বারবার। মনে হচ্ছে, কেন? কেন এরকম হচ্ছে? এরকমই কিছু কি হওয়ার কথা ছিল? এমন গ্রহণ লাগার কথা ছিল?
       জ্ঞান হওয়া ইস্তক দেখেছি বাবা-মা অত্যন্ত রামকৃষ্ণ অনুরাগী। বসার ঘরে, শোয়ার ঘরে বড় বড় ছবি। বাবা মাঝেমাঝেই দক্ষিণেশ্বর যান। সাথে আমিও যাই সেই ছোটোবেলা থেকে, প্রথম প্রথম হনুমান দেখতাম (তখন প্রচুর হনুমান ছিল দক্ষিণেশ্বরে), কাঠের গাড়ি কিনতাম। পরে রামকৃষ্ণদেবের ঘর চিনলাম, সারদাদেবীর ঘর দেখলাম। বাবার ভবতারিণীর প্রতি অকৃত্রিম আবেগমথিত ভক্তি দেখলাম। আস্থা দেখলাম। মায়েরও তাই।
       উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলাম। কলেজে ভর্তি হলাম, বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। মন ক্রমে নানা সংশয়ে আকুল হচ্ছে ধীরে ধীরে। ইতিমধ্যে ক্লাস নাইনে থাকতে পৈতে হয়ে গেছে। এক বছর একাদশী ইত্যাদি করেছি। রীতিমতো নিয়মমাফিক গায়ত্রী জপ চলছে। কিন্তু মনের ভিতর সংশয়। সত্যিই কি কিছু আছে? সব কি ফাঁকি?
       এমন সময় হাতে এসে পড়ল রোমা রোঁলা রচিত রামকৃষ্ণের জীবন। পড়লাম। এতদিন পড়া হয়নি তেমন কিছু। বিবেকানন্দ পড়তে শুরু করলাম গোগ্রাসেই বলা চলে। তারপর কথামৃত। একটা কথায় মনে একটু শান্তির জল পড়ল - সত্যতে থাকলে ঈশ্বর লাভ হয়।
       মন বলল, তাই, এতো বেশ কথা! কিন্তু তবু মনের মধ্যে সংশয়। শুরু হল বেলুড়মঠ যাওয়া। এত প্রশ্নের ভিড়, জবাব দেবে কে? ওদিকে মাতুলালয়ের প্রভাবে অরবিন্দ ঘোষের থেকে বেশি করে ঋষি অরবিন্দকে পড়ার দরকার হল। দিদা অরবিন্দের ভক্ত। লাইফ ডিভাইন, সিন্থসিস অব যোগা পড়ে বেশ লাগল। দারুণ যুক্তি তো! অনেকে বললেন দীক্ষা না নিলে মনের প্রশ্নের জবাব মিটবে না। অতএব দীক্ষার প্রস্তুতি। কিন্তু কার কাছ থেকে নেব? আমার এক বন্ধুর পরিবার ছিল ভীষণ রামকৃষ্ণ মিশনের অনুরাগী। তাদের বাড়ির সবাই দীক্ষিত। তারা বললেন মঠের প্রেসিডেন্টের কাছে নিলে সব চাইতে ভালো। স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী প্রেসিডেন্ট। ও, ইতিমধ্যে ভীষণ পণ্ডিত মানুষ শ্রদ্ধেয় হোসেনুর রহমনের সাথে পরিচয় হয়েছে, ওনার বাড়িতেও গেছি পার্ক সার্কাসের কাছে। রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সাহিত্যে বিদগ্ধ মানুষ। ওনার মুখে স্বামী রঙ্গনাথানন্দের কথা শুনে আরো শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। উনি ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন স্বামী রঙ্গনাথানন্দজীকে। অবশ্যই শ্রদ্ধা করার মত মানুষ। সে কথায় পরে আসছি।
       মঠে গিয়ে জানলাম প্রেসিডেন্ট মহারাজের কাছে, মানে স্বামী রঙ্গনাথানন্দজীর কাছে দীক্ষা নিতে গেলে দেরি হবে, অনেক লম্বা দীক্ষাপ্রার্থীর তালিকা। মুষড়ে গেলাম। আমার তো দেরি করলে হবে না। আমার তো ভীষণ তাড়া। যাকেই পাই জিজ্ঞাসা করি, আচ্ছা যদি ভাইস প্রেসিডেন্ট মহারাজের কাছে দীক্ষা নিই তবে কি কোনো পার্থক্য হবে? কেউ বলে হ্যাঁ, কেউ বলে না। আমি ঠিক করলাম ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছেই নেব, যা থাকে কপালে, হবে। ঈশ্বর তো শুনেছি অন্তর্যামী। তিনি এমন পার্থক্য করবেন?
       তখন স্বামী আত্মস্থানন্দজী সদ্য ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। ওনার সেবক তাপস মহারাজের কাছে গেলাম। ওনার কাছে ইন্টারভিউ দিতে হবে, পাস করলে ফর্ম দেবেন, তবে দীক্ষা।
       আমি আর আমার এক বন্ধু গেলাম। তাপস মহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন, কেন এসেছিস?
       বললাম, দীক্ষা নেব।
       বললেন, কেন?
       বললাম, বই পড়েও ঠিক হচ্ছে না বলে।
       উনি মুচকি হেসে বললেন, তা এই বয়সে মেয়েদের পিছনে না ঘুরে ঠাকুরের পিছনেই বা ঘুরছিস কেন?
       ভাবলাম, একি প্রশ্ন রে বাবা! ওনার মুখে তখন দুষ্টুমির হাসি। আমার কোনো উত্তর নেই। বললেন, তা কি কি বই পড়েছিস?
       আমি লিস্ট আওড়িয়ে গেলাম। উনি শুনে বড় বড় চোখ করে বললেন, বাপ রে, এতো মেলা বই পড়ে ফেলেছিস...
       আমি বললাম, তবেই বুঝুন, এত পড়েও কিছুই ঠাহর কর‍তে পারছি না....
       উনি ফর্ম দিলেন। দীক্ষার দিন স্থির হল ১৩ই মে, ১৯৯৬. কাশীপুর উদ্যানবাটীতে।
       কাশীপুর উদ্যানবাটী, যেখানে রামকৃষ্ণদেবের জীবনের শেষ কয়েকমাস কেটেছিল। আমরা আনুমানিক তিরিশজন যুবক যুবতী কাশীপুরের সেই ঘরে বসে যে ঘরে রামকৃষ্ণদেবের জীবনাবসান হয়েছিল। সামনে মেঝেতে লাগোয়া খাট। জানলাগুলো খোলা। দরজা বন্ধ। আমরা মহারাজকে ঘিরে বসে। ওনার চোখ বন্ধ। সামনে রামকৃষ্ণদেব, সারদাদেবী, স্বামীজির ছবি রাখা।
       এই ঘরের কথাগুলো বাইরে বলতে নেই বলা হয়। কিন্তু আজ আমায় বলতেই হবে। যদি তাতে কোনো পাপ হয় তবে হোক। কিন্তু আজ না বললে যে অপরাধবোধে ভুগব, যে বিবেকযন্ত্রনায় ভুগব, তা আমার কাছে অসহ্য। এই কথাগুলো বলব বলেই আজ লিখতে বসা।
       উনি আমাদের দিকে তাকিয়ে কিছু কথা বললেন মন্ত্র দেওয়ার আগে। সেই কথাগুলোই আজ আপনাদের সাথে ভাগ করে নিতে চাই। সেই ঘরে কোনো মিডিয়া ছিল না, কোনো লিপিকার ছিল না। একজন প্রায় আশি ছুঁইছুঁই মানুষ শিরদাঁড়া সোজা রেখে কয়েকটা কথা বলেছিলেন, যা আজ এই দুর্দিনে বারবার মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন,
       "মনে রেখো, ঈশ্বর এক। তিনিই আল্লাহ, গড ইত্যাদি নামে পরিচিত। তোমরা ঠাকুরের নামে দীক্ষা নিচ্ছ মানে মন্দির, মসজিদ, চার্চ ইত্যাদির মধ্যে আজ থেকে কোনো ভেদ করবে না। জানবে একই ঈশ্বর সর্বত্র। মানুষ রুচিভেদে নানা নামে, নানা প্রথায় তাঁকে ডাকে। দীক্ষা নিয়ে তোমার মধ্যে যদি এই উদারতা না আসে জানবে তোমার সব সাধনা ব্যর্থ। মানুষকে ভালোবাসা, তাকে কোনো অর্থে শোষণ, পীড়ন না করা তোমাদের ব্রত হোক। আর জানবে ঠাকুর অহংকার আর মিথ্যা সহ্য করতে পারতেন না। এই দুটো থাকলে তোমার জীবন ব্যর্থ।"
       আজ মনে হয়, আচ্ছা, যদি ওই বন্ধ ঘরে উনি বলতেন, ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব ছাড়া অন্য কাউকে মানার দরকার নেই। উনিই সব চাইতে আপডেটেড অবতার। বাকি সব ধর্ম থেকে আমাদের ধর্ম শ্রেষ্ঠ...ইত্যাদি ইত্যাদি...তবে কার কি বলার ছিল? ওনার সামনে তো প্রত্যেকেই তরুণ, তাদের মাথা মোড়ানো, ব্রেণ ওয়াশ করা তো এমন কিছুই কঠিন কাজ না। তবে কেন এমন উদারতার কথা বলা? কারণ এটাই তাঁর বিশ্বাস। রামকৃষ্ণদেবের সাধনের মূল কথা।
       এরপর বছর গেছে। ওনার সাথে নানা বিষয়ে কথা হয়েছে। আলোচনা হয়েছে। একদিনও পলকের জন্যেও কোনো সঙ্কীর্ণ বিশ্বাস, কোনো সঙ্কীর্ণ মতামতের প্রশ্রয় দেখিনি। কি সাংঘাতিক উদারতা, কি অসামান্য মানবদরদী মন। এমনই স্বামী আত্মস্থানন্দজীকে আমি চিনেছিলাম।
       দুটী ঘটনা স্বামী রঙ্গনাথানন্দজীকে নিয়ে বলি। একবার একটা অল্পজনের আলোচনা সভায় উনি ইংরাজিতে বলছেন। বলতে বলতে হঠাৎ করে উনি ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে ওনার বক্তব্য বলতে শুরু করলেন। সবাই অবাক, হঠাৎ হিন্দীতে কেন? উনি দক্ষিণভারতের মানুষ, অত ভালো হিন্দী বলতে পারেন না। দেখা গেল, যে মানুষটা সবাইকে চা দিতে এসেছিল, সে চা দেওয়ার পর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তার কথা বোঝার চেষ্টা করছে। তাই সে যাতে বুঝতে পারে, তাই হিন্দী।
       আরেকটা ঘটনা। উনি ফ্লাইটে করে হায়দ্রাবাদ যাচ্ছেন। বিমানসেবিকারা যা খাবার দিচ্ছেন তাই উনি নিয়ে ওনার ঝোলায় ভরছেন। পাশে বসে থাকা আরেকজন মহারাজের অবাক লাগছে, উনি এমন ব্যবহার কেন করছেন? বুঝলেন এয়ারপোর্টে নেমে। রঙ্গনাথানন্দজী নেমেই দৌড়ে এয়ারপোর্টের বাইরে বসে থাকা একজন পঙ্গু ছেলের দিকে এগিয়ে গেলেন। তার হাতের ঝুলি থেকে বার করে সব খাবারগুলো দিয়ে দিলেন। আরেকজন মহারাজ বুঝলেন কেন নিয়েছিলেন সব কিছু বিমানসেবিকার কাছ থেকে।
       যখন আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সাথে স্বামী আত্মস্থানন্দজীর সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের কথা শুনেছিলাম, মনে একটা অন্য রকম আশার সঞ্চার হয়েছিল। যখন উনি স্বামী আত্মস্থানন্দজীর দেওয়া আশীর্বাদী ফুল পকেটে নিয়ে প্রথমবারের শপথবাক্য পড়তে উঠেছিলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী অতিথি, মনে অন্যরকম আশা জেগেছিল।
       আজ আমি খুব কনফিউজড। আজ যদি আত্মস্থানন্দজী থাকতেন, কি বলতেন উনি? জানি না। উনিই নাকি ওনাকে রাজনীতিতে আসতে বলেন সন্ন্যাসী হওয়ার বাসনাকে নিরস্ত করে। তবে কোনদিকে যাবে ভারত? রামকৃষ্ণের সর্বধর্ম সমন্বয় না মনুর পথে?
       চাকরি সূত্রে লক্ষ্ণৌতে আছি। আমার এক সহকর্মীর সাথে কথা হচ্ছে, যিনি জন্মসূত্রে মুসলমান। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন বিকালে আমি কি করছি। আমি বললাম, আমার আজ একটু রামকৃষ্ণ মিশনে যাওয়ার আছে। সে বলল, আমি যেতে পারি? আমি বললাম, অবশ্যই। সে বলল, কেউ কিছু বলবে না? আমি বললাম, গিয়েই তো দেখো।
       সে আমার সাথে আরাত্রিকে আমার পাশে বসে শুনে, মহারাজের কোয়াটার্সে মহারাজের সাথে চা পান করে গল্প করে যখন গাড়িতে উঠল, বিস্ময়ের অবধি নেই ওর। বলল, আমার কাপটাও আলাদা করে রাখা হল না তো!
       সে যখন আমাদের বাড়ি এসেছিল কাঁচরাপাড়া কোয়াটার্সে, মা তাকে যখন আমাদেরই থালায় খেতে দিল, আমরা একসাথে খেলাম, সে খাওয়ার টেবিলেই বলল, হিন্দীতে বলল, যখন মঠেই তোমরা আলাদা করো না, তখন বাড়িতেও যে করবে না এই স্বাভাবিক। আমি আপ্লুত।
       এইরকম একটা বিশ্বাসেই বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ এর ভারত দাঁড়িয়েছে। এর অন্যথা হয় না। আজ যারা রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষিত তাদের উপর আমার মনে হয় যেন বিরাট দায়। সারা ফেসবুক জুড়ে "জয় ঠাকুর, জয় মা" শুধু লিখবেন না। স্বামী ভুতেশানন্দজী বলতেন, তোমাদের ঠাকুরঘর না, তোমাদের আচরণ দেখে যেন বোঝা যায় তোমরা ঠাকুরের শিষ্য। তিনি যেন তোমাদের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত হন। রামকৃষ্ণদেব ও তার শিষ্যদের মধ্যে এই সমন্বয়ের উদাহরণের অভাব নেই। প্রতিজনের জীবনীতেই আছে ভুরি ভুরি উদাহরণ। কিন্তু সেকি শুধু বইতেই সীমাবদ্ধ থাকবে? না তো। আপনারা সোচ্চার হন। যেন ধর্মে ধর্মে বিভেদ না জন্মাতে পারে কেউ এই মাটিতে।
       আমার অনেক অভিযোগ, অনেক ক্ষোভ থাকতই পারে মিশন নিয়ে। কিন্তু সে মহান আদর্শকে নিয়ে তো নেই। আমার নাস্তিকতা, আস্তিকতা দুই নিয়েই আমি সেই মহান আদর্শের সামনে দাঁড়াতে পারি। মানুষ শেষ কথা হোক। রামকৃষ্ণদেবের কথা, "অন্যায় অসত্য দেখলে চুপ করে থাকতে নেই"। আর যা সত্য বলে অনুভব করেছি তাকে গোপনও কর‍তে নেই, "মন মুখ এক করাই প্রকৃত সাধন"। এই কথাটা খুব বড় কথা। আমার মনে হয় ওনার শ্রেষ্ঠ উপদেশ, বাণী। আজ অনেক বড় কর্তব্য যারা সেই আদর্শে বিশ্বাসী, দীক্ষিত, অনুরাগী সবার উপর। নইলে আর কেউ ক্ষমা করবেন কিনা জানি না, যদি রামকৃষ্ণদেবকে ইষ্ট বলে মানেন তবে জানবেন উনিই ক্ষমা করবেন না। আজ সত্যি অর্থে দীক্ষা নেওয়ার দিন, মন্ত্রে না, আচরণে, সমন্বয়ের প্রচারে, বিশ্বাসে। আপনার আশপাশকে সেই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ করে তুলুন। রামকৃষ্ণদেবের এই উদার শিক্ষাটুকু যেন প্রাণিত হয়ে ওঠে আবার। এই অন্ধকারে আর গতি নেই।