মানুষের গভীরের একটা শব্দ - গোঙানির শব্দ। গভীর যন্ত্রণার শব্দ। সে শব্দের কোনো শ্রোতা নেই। তার কোনো বৈচিত্র্য নেই। তার আঘাত আছে। বারবার বুকে এসে লাগা ঢেউয়ের মত, পৌনঃপুনিক অস্তিত্ব আছে।
আইসিইউ -এর বাইরে বসে সারাদিন গোঙানির শব্দ শুনেছি। তার মধ্যে একজন ছিলেন মা। এখনও সেই গোঙানির শব্দ হঠাৎ কখনও কখনও মনের কোন কোণা থেকে জেগে ওঠে। স্তব্ধ হয়ে যাই কিছুক্ষণ। গভীর দুঃখ আরেকবার নিজেকে জানিয়ে মিলিয়ে যায়। বলে যায়, আমিও আছি।
গোঙানির কোনো মানে নেই। প্রকাশ আছে। সেই প্রকাশে সুখ আছে। মানুষ শব্দের কাছে এতটাই ঋণী। সব শেষ হলেও এইটুকুকে হলেও অন্তত সে আঁকড়ে থাকতে চায়। যন্ত্রণা সেইটুকুতেই নিজেকে জানান দেয়। ওতে যন্ত্রণা কম হয় না, কিন্তু মনের মধ্যে একটা আরাম হয়। আত্মপ্রকাশের আরাম।
যে মানুষ দীর্ঘদিন কথা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে বিছানায়, তার পাশে বসে থেকেছি। গোঙানির শব্দই তার অবশিষ্ট ভাষা। সেই তার প্রকাশ। চোখ বন্ধ করে কি অদ্ভুত শব্দ জন্ম দিয়ে চলেছে। ওইটুকুই তার সম্বল।
সুস্থ মানুষ গোঙানির শব্দে বিরক্ত হয়। তার তো অনেক শব্দ। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এটা সেটা নিয়ে থাকলেই হয়। কিন্তু যে মানুষ প্রান্ত সময়ে এসে ঠেকেছে অথবা যার যন্ত্রণায় দিকভুল হয়েছে সে কি করবে? তার ওটুকু যে না থাকলেই নয়। এমন অনেক বয়স্ক মানুষ দেখেছি, সারাদিন শুয়ে শুয়ে গোঙিয়ে যান। তার বাড়িতে তার সঙ্গে ও অন্যান্যদের সঙ্গে দেখা করে রাস্তায় নেমে গেছি, জানলা দিয়ে তার গোঙানির শব্দ আসছে। আমি অটোর জন্যে অপেক্ষা করছি। আশেপাশে কাকের ডাক, রিকশা-সাইকেল-গাড়ি কত কিছুর শব্দ। মানুষের কত কথা। তার মধ্যে একজন কেউ গোঙিয়ে যাচ্ছে। অর্থহীন শব্দ। কিন্তু কি গভীর যন্ত্রণা। অসহায়তা। কারোর সময় নেই শোনার।
হাসপাতালে এ অভিজ্ঞতা হয় সব চাইতে বেশি অবশ্যই। মাথার কাছে মা বসে, বাচ্চাটা গোঙিয়ে যাচ্ছে। মা অসহায়ের মত অন্যদিকে তাকিয়ে বসে। সারা পৃথিবীর সব শব্দ অর্থহীন সেই মুহূর্তে তার কাছে। তার কানে শুধু ওই একটি গোঙানির শব্দই শব্দ। মাঝে মাঝে বাচ্চাটার মাথায় হাত রাখছেন। আবার বাইরের দিকে তাকাচ্ছেন। এক করুণাহীন সময়ের আবর্ত ঘুরেই চলেছে। যার একমাত্র বাঙময় প্রকাশ - গোঙানি।
আমি জানি সবার ভাগ্যে গোঙানিতে সাড়া দেওয়ার মানুষ থাকে কই? মানুষ যখন আর কোনো মানবিক শব্দ না পেয়ে শুধুমাত্র একটি আদিম শব্দ উচ্চারণ করে যাচ্ছে, যে শব্দের মানে খুঁজতে কোনো অভিধান লাগে না, যে শব্দের অর্থ মানুষ কিছুতেই ভোলে না, সে শব্দের যে অসহায় হাত, সেটা ধরার মানুষ কি সবাই পায়? পায় না। গোঙানি ব্যর্থ হয়ে ফিরে ফিরে তারই কাছে আসছে, এও তো দেখেছি।
মানুষ কেন? এই গোঙানিতে আমরা সবার সমান। রাস্তার পাশে পা ভেঙে কুকুরের গোঙানি শুনেছি। কাতরভাবে তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। যদি কেউ সাহায্য করে। অথবা হয় তো কোনো সাহায্যই চায় না। শুধু জানিয়ে যাচ্ছে নিজের গোঙানিতে নিজের গভীরতম যন্ত্রণার কথা। জানি না। তবে সে গোঙানির শব্দ ভুলেছি কই?
সব কান্না শেষ হলে জন্মায় গোঙানি। কান্নার তবু কিছু দাবী থাকে, অভিমান থাকে, কিন্তু গোঙানির সেটুকুও থাকে না। তার নিঃসঙ্গতাতেও কোনো ক্ষোভ নেই। তার অভিমান নেই। সে শুধু আছে।
উপনিষদের ঋষিরা শুনেছিলেন, সমস্ত সৃষ্টির আদিতে নাকি ছিল এক শব্দ। সেই নাকি আদি সত্য। বুদ্ধ বললেন, দুঃখ, সেই সত্য। তবে কি বুদ্ধ এ সমস্ত সৃষ্টির গভীরে কোনো গোঙানির শব্দ শুনেছিলেন। এক গভীর যন্ত্রণা, এক অব্যক্ত ব্যথা থেকে মুক্তির আকুতি। গোঙানি মুক্তি চায়।
দুঃখ আছে - এ সত্যকে নিয়ে সংশয় জাগে না। সে আছে, আছে, আছে। পৃথিবীর গভীরে এক গোঙানি তো আছেই। আদিম শব্দ অথবা শেষ শব্দ।