উইলিয়াম ডালরিম্পলের লেখা একটা বই কয়েক মাস আগে পড়েছিলাম - নাইন লাইভস্। নয়জন মানুষের উপর লেখা বেশ সুখপাঠ্য গভীর দরদী একটা বই। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের ন’টা জীবন। প্রত্যেকেই জীবনটা কিনারা বরাবর হাঁটছেন বা হেঁটেছেন তাদের বিশ্বাস, বিচিত্র রীতি ইত্যাদির উপর গভীর আন্তরিক আস্থা রেখে। ডালরিম্পল কারোর আস্থাকে সংশয়ের চোখে দেখছেন না, বিদ্রুপ করছেন না। তিনি তাদের সবার সামনে একটা জীবন জিজ্ঞাসা নিয়ে এসে দাঁড়াচ্ছেন। তিনি মৃত্যুমুখী দেবদাসীই হোন, কি জৈনধর্মাবলম্বী সন্ন্যাসিনীই হোন যিনি অন্নজল ত্যাগ করে ধীরে ধীরে মৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছেন, কি বাংলার অন্ধ কানাইদাস বাউলই হোন।
অসামান্য একটি বই। পড়তে পড়তে আমার বারবার কালকূটের কথা মাথায় আসছিল। বারবার মনে হচ্ছিল যেন আমি ইংরাজি ভাষায় কালকূট পড়ছি। মানুষের অন্তঃস্থলকে এমন আন্তরিকভাবে, এমন দরদের সঙ্গে ছোঁয়ার ক্ষমতা তো সবার থাকে না। সংশয়, সন্দেহ, অবিশ্বাস তো আমাদের প্রাথমিকভাবে জন্মেই যায়, তার জন্যে তো আলাদা করে কোনো প্রস্তুতি লাগে না। কিন্তু সে সবকিছুকে সরিয়ে একজন মানুষকে শুধু মানুষ হিসাবে ছুঁতে পারার কি অসামান্য জ্বলন্ত দলিল এই বইটা! বইটা শেষ হল একটা মন খারাপ নিয়ে। আন্তরিক, সহজ, সরল যা কিছু হারালেই মন খারাপ লাগে। মন উদাস হয়।
প্রতিটা ধর্ম বা সম্প্রদায়ের তিনটি প্রধান স্তম্ভ থাকে। এক যিনি প্রতিষ্ঠাতা বা প্রবর্তক; দুই, তার লেখা বা তার কথা কি জীবনী নিয়ে লেখা একটি বা কয়েকটি মূল বই; তিন, তাকে ঘিরে একটা সঙ্ঘ বা সম্প্রদায় বা সমাজ। সেও আবার দুই রকম --- এক সন্ন্যাসী বা ব্রহ্মচারীদের নিয়ে; দুই, সাধারণ মানুষদের নিয়ে যারা আবার সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয়ভাগে বিভক্ত। ইংরাজিতে যাদের বলি প্র্যাক্টিসিং হিন্দু / মুসলিম ইত্যাদি, আর নন-প্র্যাক্টিসিং।
মানুষ জন্মায় যখন অবশ্যই কোনো না কোনো সম্প্রদায়েই জন্মায়। সেই সম্প্রদায়ের শিক্ষা-রীতিরেওয়াজের মধ্যে বড় হতে হতে যখন সে পূর্ণাঙ্গ পূর্ণ বিকশিত মানুষ হয় তখন সে দেখে অনেক কিছু সে মেনে আসছে যার যুক্তিগত ভিত্তি সে পাচ্ছে না। হিন্দুধর্মে অনেক উপসম্প্রদায়ের ব্যবস্থা আছে। অনেক অনেক বিচিত্র বিশ্বাস, অনেক অনেক গুরু, তাদের ঘিরে এক একটা সঙ্ঘ তথা সমাজ, সে তখন সেই সবের মধ্যে নিজের বিশ্বাসের নতিকে পরীক্ষা করে দেখে কোনটা তার পক্ষে ঠিক। সেই মতে সে তখন দীক্ষা নেয়। আবার কেউ কেউ কোনো মতেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পেরে সব কিছু থেকে বেরিয়ে এসে সম্প্রদায়হীন একক কোনো এমন মানুষকে খোঁজেন যিনি তার চিত্তের আর যুক্তির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য ঘটাবেন। বাঙালির ক্ষেত্রে এ কাজটি অনেক সহজ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানের মাধ্যমে। ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা, ঈশ্বরপ্রেমের তৃষ্ণাকে কোনো বিশেষ একটি সমাজের অধীনে না থেকেও উপলব্ধি করার এবং শান্তি ও আনন্দ লাভ করার পথ সহজ হয়েছে। সে ঈশ্বরের ধারণা অরূপ নিরাকার হওয়াতে নিজের বোধের সঙ্গে একটা অনির্দিষ্ট প্রজ্ঞার সুষমা গড়ে তোলাও সহজ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের আগে যে পথটি দেখিয়ে এসেছেন বাউলেরা। আর ভারতের অন্যপ্রান্তে কবীর বিশেষ করে। পরবর্তীকালে বাউলের রাস্তায় অনেক সংকীর্ণতা এসেছে। যা মহৎ ছিল তা ক্ষুদ্রের সীমানায় প্রতীক হয়ে বদ্ধ হতে চেয়েছে। মানুষ তার অসীমের তৃষ্ণাকে প্রতীক আর গোষ্ঠীসুখের মাধ্যমে পূরণ করতে গিয়ে নিজেকে সংকীর্ণ করেছে, ঈর্ষা আর হিংসার দাসত্ব করে চলেছে। গোষ্ঠী তৈরি হলেই সংকীর্ণতা জন্মাবেই। এ অবশ্যম্ভাবী। কয়েকজন মানুষ হঠাৎ করে নিজেদের নিয়ে দল পাকালেই সে অন্যদের থেকে নিজেকে পৃথক ভাববে, নিজেকে বেশি পবিত্র, বেশি উচ্চমার্গের, বেশি ঠিক ভাববেই। এ হতে বাধ্য। রুচির পার্থক্যে মানুষ পৃথক হবেই। সমস্যা সেখানে হয় না। রামকৃষ্ণদেব বলছেন, বাড়িতে মাছ আনা হয়েছে, মা যার যেমন পেটে সয় সেই অনুযায়ী এক এক ছেলের জন্য এক এক পদ রান্না করেছেন। কাউকে ভাজা, কাউকে ঝোল, কাউকে কালিয়া ইত্যাদি।
এ অবধি বাস্তব। কিন্তু যেই কেউ বলে বসে যে কালিয়াটাই মাছের সর্বশ্রেষ্ঠ পদ, ভাজাটা না, অমনি সংকীর্ণতা এসে পড়ে, তার থেকে ঈর্ষা আর হিংসা। কেউ বলে না আমি আমার রুচি অনুযায়ী চলছি ভাই তুমিও তোমার রুচি অনুযায়ী চলো। এইটা কেউ বলে না। রমণ মহর্ষিকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল নানা মতে এত বিবাদ কেন? উনি উত্তর দিয়েছিলেন, যে যার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে না বলে। আরো সোজা ভাষায় যে যার নিজের চরকায় তেল দেয় না বলে। অন্যের চরকার বিচার করতে গিয়েই আমাদের যত সমস্যা। আসলে বিচার তো নয়, তুলনা। তুলনা করার ইচ্ছা প্রতিযোগিতার মনোভাব থেকে জন্মায়। আর প্রতিযোগিতার মনোভাব ক্ষমতার লোভ বা ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হতে চাওয়ার মনোভাব থেকে জন্মায়। কিন্তু সত্যকে অনুভব করবার সাধনা আর ক্ষমতার লোভ কি একসঙ্গে যায়? যায় না। তাই প্রয়োজনের চাইতে আয়োজন বড় হয়ে ওঠে। মন্দির ক্রমে আকারে আয়তনে বেড়ে ওঠে, সম্প্রদায়ে সদস্যপদ বাড়ানোর জন্য প্রকল্প হয়, নিজের প্রবর্তকের বা গুরুর আসন আর সবার আসনের থেকে উঁচুতে রাখার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। আড়ম্বরের চাপে সেই ‘তোমার পুজার ছলে তোমায় ভুলে থাকি’ দশা হয়।
কিন্তু এ সবের বাইরে যাওয়ারও রাস্তা থাকে। সে রাস্তায় একা হাঁটতে হয়। অথবা কালেভদ্রে কাউকে হয় তো মেলে। সেই রাস্তা খোঁজার ডাক জন্মায় প্রাণের গভীরে। সে তখন দল না, বই না... কিছুতেই শান্তি পায় না। সে মানুষের মধ্যে মানুষ খুঁজে বেড়ায়। সে পাগল হয়। সে ক্ষ্যাপা হয়। সে সাঁই হয়। সে বাউল হয়। ডালরিম্পলের মধ্যে কোন বাউল লুকিয়ে সে ডালরিম্পলই জানেন। কিন্তু বাউল তো আছেই একজন, নইলে এ ভাষা, এ ভাব জন্মায়?