Skip to main content

মানুষ দুঃখ থেকে ত্রাণ চায়। সে কোন দুঃখ? খিদের দুঃখ, পরাধীনতার দুঃখ, অপমানের দুঃখ।

 
    বাকি যা কিছু শোক, মানুষ মেনে নেয়। সেটা তার কপাল জেনেই মেনে নেয়। আমার এক নিকট আত্মীয় মারা গেলেন। যে বয়সে মারা গেলে মানুষ বলে, হায় রে, সেই বয়সেই মারা গেলেন। খবর পেয়ে হাস্পাতালে গেলাম। শুনলাম এখনও বেশ কিছুটা দেরি আছে "বডি পেতে"। কানে বাজল। এই বাজাও দুঃখ।

    বাইরে চায়ের দোকানে বন্ধুরা এলাম। সকাল থেকে কিছু না খাওয়া। দুপুর গড়ালো। খিদের দুঃখ। দোকানে বয়স্ক মানুষ। হাস্পাতালের বাইরের দোকান। শোক, উদ্বেগ, দুঃখ দেখে দেখে সয়ে যাওয়া মানুষ। ছোটো দোকান। টালির চাল। উনুনে দুধ ফুটছে। পাত্রটা বহু ব্যবহারে স্বীয় আকার, রং হারিয়েছে। দোকানের সামনে চিপস, কেকের প্যাকেট ঝুলছে। দোকানির মুখে ব্যবসায়ী মানুষের হাসি। জগতে সমস্ত দুঃখকে সামনের দরজা দিয়ে না আসতে বলার সাইনবোর্ড। কিছু মানুষ হয় এমন। দুঃখকে ঠেকানো যাবে না জেনে সামনের দিকের দরজাটা তার জন্য আর খোলা রাখে না। পিছনের দিকের দরজাটা খুলে দিয়ে ভিতরে ডেকে নেয়। বাইরের দিকে আসতে বারণ করে। চোখের জানলায় উঁকি দিতে বারণ করে। বলে, তুমি থাকো। সমস্ত সুখ শিকড়হীন জানি। তবু সে বাইরে থাক। মানুষ শিকড় খোঁজে না, ফুল খোঁজে। মিথ্যা ফুলের স্বপ্নে ভুলিয়ে রাখে নিজেকে। আমিও সেই কাজে সাহায্য করি না হয়। তুমি গোপনে থাকো। সত্য হয়ে থাকো।

    কেক আর চায়ের জন্য বলা হল। সামনে অটোর সারি। কিছুদূরে সস্তা কাঠে বানানো খাটের সারি। ফুলের দোকান। ওষুধের দোকান। সুখ কোথায়? দুঃখ মানে অনেক শব্দ। অভাব, যন্ত্রণা, বিষাদ, অবসাদ, অভিযোগ - অনেক শব্দ। দুঃখের সহস্রনাম। সহস্ররূপ। মানুষ সব দুঃখ সহ্য করে নেয়, শুধু অপমান আর পরাধীনতার দুঃখ সহ্য করে না। যদি সহ্য করে তবে সে আর মানুষ পদবাচ্য থাকে না। এই যে এত লড়াই, এই যে বেঁচে থাকার এমন লড়াই, একি শুধু টিকে থাকার না বেঁচে থাকার? টিকে থাকা আর বেঁচে থাকার মধ্যে পার্থক্য বোঝায় দুঃখ। অপমান আর পরাধীনতার দুঃখকে পায়ে দলে যে দাঁড়াতে যায় সেই জানে বেঁচে থাকার মানে কি? টিকে থাকাতেই তুষ্ট থাকতে চায় যে তার উপর তার ঘৃণা। কারণ সে জানে যে টিকে থাকাকে জীবন বলে ভুল করে সে নিজের মেরুদণ্ডকে যে কোনো মূল্যে একবার না, হাজারবার বিক্রি কর‍তে পারে। সে দুঃখের মূল্য বোঝে না। ভয় আর লোভের চাবুকে জর্জরিত প্রাণে সে শুধু ঝুঁকে ঝুঁকে পড়তে চায়। একটু মাথা নীচু করে থিতু হতে পারলেও ভাবে, এই তো আমি আছি!

    এমন মানুষের সংখ্যা বেশি হয় না। এই যে বৃদ্ধ মানুষটা চায়ের জল চাপিয়ে খদ্দের সামলাচ্ছে, একি সুখের জন্য? না, নিজের স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। মানুষ যত বৃদ্ধ হয় তার শরীর তত দৃঢ় হয়, শিথিলতা কমে। পায়ের ভাঁজ, হাতের ভাঁজ, পেশির সচলতা ক্রমে কঠিন হয়ে আসে। চলাফেরায় গতি কমে। কিন্তু সে তো শরীরের কথা। শরীরের দুঃখকে মানুষ দুঃখ বলে না, বলে রোগ, বলে অসুবিধা। কারণ শরীর তার আত্মসম্মানকে ছোঁয় না। তার আত্মা তার মনের গভীরে। তার বোধের গভীরের নীলশিখা। তার গায়ে কেউ হাত দিতে এলে সে চীৎকার করে ওঠে। প্রতিবাদ জানায়। দরকার হলে শরীরটাকে শেষ করে দিয়েও সেই নীলশিখাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। তাকে সে বলে "বলিদান"। সে পশুর থেকে আলাদা এই বোধেই। আকাশে উড়েছে বলে না, জগত সংসারের গভীর রহস্যের কিছু কিছু সন্ধান পেয়েছে বলে না। সে তো অনেক প্রাণী প্রকৃতির অনেক রহস্য মানুষের থেকে আগে বোঝে। মানুষের গর্ব সেখানে না, তার গর্ব তার গভীরে জেগে থাকা ওই নীলশিখার উজ্বলতায়।

    শ্মশানে অনেক লাইন। মৃত মানুষের সংখ্যা অনেক। জীবিত মানুষের ভিড় মৃত মানুষদের ঘিরে। চলছে নানা ক্রিয়া-অনুষ্ঠান। শরীর আর মৃত্যুকে তুচ্ছ বোধ করানোর অনুষ্ঠান। মৃত্যু শোকের। দুঃখের। কিন্তু এ তার নীলশিখা দ্বারা অনুমোদিত। তাই এই শোকে তার অপমান হয় না। সেই শোকে অপমানিত হয় শুধু তারা যারা টিকে থাকাকেই জীবন বলে জানে। তাই টিকে থাকাটা বিপন্ন হলে সে হেরে যায়। সে দুঃখ বা সুখ কিছুই অনুভব করে না। তার সারা জীবন জুড়ে কি ঘিনঘিনে অসাড়তা শুধু একটা!

    ইলেকট্রিক চুল্লী হাঁ হচ্ছে। শরীর দগ্ধ হবে বলে ঢুকে যাচ্ছে। ছাই হয়ে বেরিয়ে আসছে। নাভি ভেসে যাচ্ছে গঙ্গায়। তবু থেকে যাচ্ছে মানুষটা। শরীরে না, তার মানে, তার আত্মমর্যাদায়। মানুষ মৃত শরীরকেও তার গভীরে জেগে থাকা আত্মসম্মানের মূল্যে মূল্য দিয়ে যায়। অন্যথা হলে ক্ষুব্ধ হয়। বিগত কয়েকমাসে যে কয়েকটা ঘটনায় মানুষ ক্ষুব্ধ হল তাই। সে সব দুঃখ সহ্য করে নেয়, কিন্তু অপমানের দুঃখ না।

    গঙ্গার ঘাটে এসে বসলাম। দুঃখ থেকে ত্রাণ পায় মানুষ? পায় না। দুঃখকে নিয়েই বাঁচে। যদি বলে আমার দুঃখকে চাই না। তবে রাস্তাটা ঘূর্ণির মত হয়ে যায়। মন এ গলি, সে গলি খুঁজে মরে। ভাবে বড় রাস্তাটায় না হাঁটলেই হল। তবেই আর ধরা পড়ার ভয় নেই। যত গলিতে এসে ঢোকে তত নিজেকে ক্ষুদ্র করে, নিজের মানুষ হিসাবে প্রাপ্ত মানের থেকে সুখী প্রাণী হিসাবে টিকে থাকার লোভ যায় বেড়ে। ক্রমে লজ্জা পেতে আর তার লজ্জা লাগে না। ক্রমে মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকানোর আর সাহস থাকে না। তার গভীরে যে সমস্ত দুঃখকে সঙ্গে নিয়ে চলার অসীম ক্ষমতা, তাকে অস্বীকার করে। নিজেকে দেহসুখসর্বস্ব প্রাণী বেশি আর কিছু ভাবতে পারে না।

    দাহ শেষ হল। ভোর হল। রাস্তাটা এতক্ষণ ঘুমন্ত সাপের মত পড়েছিল। ক্রমে জেগে উঠল সে। মানুষের হাঁকডাকে চারদিকে আবার সব কিছু দিনের চিরকালের ছবির মত হয়ে উঠতে শুরু করল। দোকানি দোকান খুলছে। বাস, স্কুটার, অটো, টোটো রাস্তায় ভিড় করে। বাজার বসে গেছে। সেখানেও হইহই। প্রতিটা মানুষকে যদি আলাদা আলাদা করে দেখি তবে তার জীবনে দুঃখের অবধি নেই। তবু সে মাথাটা উঁচু করে বাঁচতে চাইছে।

    একজন বৃদ্ধা সামনে এসে দাঁড়ালেন। হাত পাতলেন। এ অসম্মানের। ভিক্ষা চাইছেন বলে না, ভিক্ষা চাইতে হচ্ছে বলে। মানুষের মানের বোধ দুই ধারার। এক, তার সত্তার মান, তার অস্তিত্ব্যাভিমান; দুই, তার শ্রমযোগ্যতার মান।

    দুর্ভাগ্য আমরা নারীদের এই দুই মানেই বঞ্চিত রেখেছি আদিকাল থেকে। পরিবর্তন হয়নি তা নয়, তবে সে পরিবর্তন আশানুরূপ হয়েছে কই? খ্রীষ্ট তার শিষ্যদের হাত-পা মুছিয়ে দিতে দিতে বলেছিলেন, এই আমি তোমাদের হাত-পা মুছিয়ে দিলাম এই জন্যে যাতে তোমরা জানো আমার পিতা আমায় যেভাবে ভালোবেসেছেন, আমিও তোমাদের সেই ভাবেই ভালোবাসছি। তোমরাও একে অন্যকে সেইভাবেই ভালোবাসো।

    এই ভালোবাসায় মানুষ আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। নিন্দায়, অশ্রদ্ধায় মানুষ নিজের অস্তিত্বকে সংকুচিত করে ফেলে। বাকিটুকু বিষাদ এসে তাকে শেষ করে ফেলে। পুরাকালে ধর্ম আর আধুনিককালে মানবাধিকারের নানা নিয়ম এই মর্যাদারক্ষার কাজে যুক্ত। কিছুটা তো অবশ্যই সফল। যদিও নারীদের ক্ষেত্রে ধর্ম বড় একপেশে। এই দোষে সব ধর্মই কম-বেশি দুষ্ট। সেই প্রাচীন যুগে নীতিবিধানের আর কোনো বিকল্প উপায় ছিল কই?

    এরপরের কথাটা হল তার শ্রমকে মর্যাদা দেওয়া। যে আমার অধীনে কাজ করছে মনে রাখতে পারি না যে সে মানুষটা আমার অধীনে না, তার শ্রমটাই শুধু আমার অধীনে। সে মানুষটা না। আমার ক্রয়ক্ষমতা যত বেশি হোক না কেন, তা দিয়ে শ্রম কেনা যায়, হয় তো বা অনেক মানুষের শ্রম কেনা যায়, কিন্তু একজন মানুষকেও কেনা যায় না। দাসপ্রথা আসলে উঠে যায়নি, ভিন্নভাবে আছে। কারণ দাস করে রাখার প্রবৃত্তিটা আছে।

    যখন শ্রমনিযুক্তকর্তা বলে, তোমার শ্রম আমি নিচ্ছি তাই তোমার ও তোমার পরিবারের সুখ-সুবিধার সমস্তটা দেখার দায়িত্বও আমি নিচ্ছি। তখন আসলে সে সোনার শিকলে আমায় কিনে নিচ্ছে। আমি জানি আমি তার হয়ে বাঁচব। সে শুধু আমার শ্রমের মূল্য দেবে না, আমায় অধিগ্রহণের মূল্যও দেবে। এও পরাধীনতা। আধুনিক সুবিধামূলক পরাধীনতা। অমুক কোম্পানীতে আমার শ্রমের মূল্য একই হলেও পাশাপাশি আনুষাঙ্গিক আরো সুবিধা অনেক বেশি, অগত্যা আমি এটি ছেড়ে ওটিতে যাব। আমিও সেই প্রাচীনযুগের ক্রীতদাসের মত ব্যবহার করছি। যে আরো সুবিধাদাতা মালিকের খোঁজ করে। আমিই 'বণ্ড'-এ সই করছি। আমিও নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছি আমার শ্রমের সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও। আমিও বণ্ডেড, নানা সুবিধাভোগী দাস। এ দুঃখের। কিন্তু এই দুঃখকে অনুভব করার শিক্ষা থেকে আমরা বঞ্চিত। আমরা ব্যক্তিগত শারীরিক জীবনে সুবিধা আর বৌদ্ধিক জীবনে স্ট্যাস্টেস্টিক্স-এর দাস এখন। কোনো মানুষকে, ঘটনাকে, পরিস্থিতিকে কেবল তথ্যের আতসকাঁচে দেখা অভ্যাস, তাকে মৌলিকভাবে বিশ্লেষণ করার অভ্যাস নেই আর। যদি থাকে, তবে তুমি ব্যতিক্রম। সত্য যে সবসময় রাশিতত্ত্বের পরিসংখ্যানে নেই, সে যে আলাদাও দাঁড়ায় সে ভুলতে বসেছি যেন।

    এই দুঃখকে আমরা অনুভব করতে পারছি না আর। এই স্বেচ্ছা আত্ম-অবমাননা মেনে নেওয়ার এক অদ্ভুত আধুনিকোত্তর যুগে প্রবেশ করেছি আমরা। আমাদের নেশা আছে, নানা বিকার আছে, নিত্যনতুন মনোরোগ বাড়ছে। আমাদের অসম্মান করার, হেয় করার, তুচ্ছ দেখার নানা উপায় বাড়ছে। এ আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে জানি না। তবে এটা যে ঠিক হচ্ছে না কোথাও এটা আমরা সবাই কম-বেশি বুঝি। বৈষম্য তো থাকবেই। বৈষম্য অপমান করে না। অপমান করে বৈষম্যের সুযোগ নিয়ে শোষণ করার তাড়না।