Skip to main content

       সত্য তবে কি আনন্দ? না, সত্য বিষাদ? এর কোনো স্থির উত্তর নেই। রবীন্দ্রনাথের চেতনায় অধিক স্থান জুড়ে আছে আনন্দ। সত্য সেখানে আনন্দের মধ্যে প্রতিভাত। সে আনন্দের মধ্যেই তিনি দেখছেন মঙ্গল। রবীন্দ্র দর্শনে এ খুব বড় একটা কথা। রবীন্দ্রনাথ সত্যকে দেখেছেন আনন্দে। যে আনন্দে দুঃখের স্থান আছে, যন্ত্রণার স্থান আছে। যার মিলিত রূপ রুদ্র। তিনি ভীষণকে স্বীকার করেছেন, কিন্তু বিষাদকে নয়। বিষাদের কাছে আত্মসমর্পণের কথা কোনো মুহূর্তেই যেন নেই। এলেও তা ক্ষণিকের জন্য। কিন্তু শেষ কথা – সত্য যে কঠিন, সে কখনও করেনা বঞ্চনা। অর্থাৎ সে কঠিন, কিন্তু বিষাদের অন্ধকার নয়।
       কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শনে ক্রমে সত্যকে দেখা গেল বিষাদে। যত ঈশ্বর অস্তিত্বহীন হল তত মানুষের খণ্ড চেতনায় সত্য ধরা দিল বিষাদে। দস্তয়েভস্কি, কাফকা, কাম্যু, নীৎজে ইত্যাদি সকলের চেতনায় সত্য বেজেছে বিষাদের সুরে। অবশেষে যেন সব কিছু ভীষণ অর্থহীন। কিন্তু সেই অর্থহীনতার চেতনা কখনই আত্মহত্যার পথে প্ররোচিত করার জন্যে নয়, মিথ্যা স্বপ্নের কুয়াশা ভেদ করে নির্মম বাস্তবের অকরুণ ত্যাগের মধ্যে বাস করার আহ্বান যেন। যে চেতনাকে বলা হচ্ছে 'আনন্দ' রবীন্দ্রনাথের দর্শনে, বা ঔপনিষদিক দর্শনে। দস্তয়েভস্কির কথায় তা 'ব্যাধি', 'নোটস ফ্রম দ্য আণ্ডারগ্রাউণ্ড'-এ লিখছেন। কাম্যু সব শেষে সব কিছুকেই 'অ্যাবসার্ড' বলছেন। কিন্তু কেউ 'আনন্দ' বলছেন না।
       সত্যকে সত্যের মধ্যে দেখা যায় না। কারণ সত্যের নিজের কোনো অবয়ব হয় না। যেমন হয় না সময়ের। সত্যকে কোনো যুক্তি, কোনো উপলব্ধি বা কোনো বিশ্বাসের অবয়বে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেন, একটা ফুল হৃদয়ের দৃষ্টিতে সৌন্দর্যবোধে সত্য হলেও, বুদ্ধির দিক থেকে যুক্তির রাজ্যে সে একটা জীবের জননাঙ্গ বই কিছু নয়। রবীন্দ্রনাথ এই দুইকেই সত্য বলেন। একটা অনুভবের সত্য, অপরটা যুক্তির।
       তবে সত্য কি?
       কে জানতে চাইছে? আমি। এবার সেই প্রাচীনতম প্রশ্ন উঠে এলো – যা ডেলফির মন্দিরে সক্রেটিস পেয়েছিলেন, উপনিষদের ঋষি ধ্যানে পেয়েছিলেন – 'আত্মানাং বিদ্ধি' – নিজেকে জানো। যে 'আমি' সত্যকে জানতে চাইছে, যে 'আমি' সুখের সমুদ্রে নাইতে চাইছে, যে 'আমি' লড়াই করে নিজের অস্তিত্ব এই মরণশীল জগতে টিকিয়ে রাখতে চাইছে – এ সবই কি এক? সবই তো দেখি একটি আধারেই জড়াজড়ি করে। তবে এর উত্তর পাই কি করে? এক পথ, মিথ্যাকে জানা। উপনিষদ বললেন, 'নেতি নেতি' করে যাওয়া। অর্থাৎ এটি মিথ্যা, এটি মিথ্যা - এই সূত্র ধরে এগোনো।
       কি মিথ্যা? সবটাই মিথ্যা। এই নিয়ে প্রাচ্য–পাশ্চাত্য'র দার্শনিকদের কোনো গোল নেই দেখলাম। আখেরে সবটাই যে মিথ্যা, একটা মুখোশের আড়ালে – এই উৎপেতে ভয়ংকর সত্যটাকে নিষ্ঠুরভাবে উন্মোচন যেভাবে পাশ্চাত্য সাহিত্যে হয়েছে, তা আমাদের এদিকে হয়নি। আমাদের যা হয়েছে তা আধ্যাত্মিক প্রেক্ষাপটে, এমনিতে আমরা সামাজিক সাহিত্যে ওই মাত্রায় নির্মমতার পরিচয় দিইনি। কোথাও একটা পেলব, করুণ, আদি অথবা বাৎসল্য ইত্যাদি রসে সাহিত্যের ইতি ঘটেছে। মানব চরিত্রের মারাত্মক মাত্রায় বিশ্লেষণ ঘটিয়ে তার ব্যবচ্ছেদ করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু অবশেষে বলা হচ্ছে – সবটাই মিথ্যা।
       এই মিথ্যাকে সরস করে তুলতে আমাদের কেউ কেউ বলে উঠল – এ সব লীলা। 'লীলা' শব্দের মধ্যে আমরা বলতে চাই যদিও এ সব মিথ্যা তবে উদ্দেশ্যগতভাবে ও বস্তুগতভাবে সেটা নির্দোষ, কারণ এর পশ্চাতে একজন সত্যময় সত্তা আছেন যে! আরেক পক্ষ অবিশ্যি এই তত্ত্বটার ধার ধারেন না, তারা বলে ওঠেন – সব মায়া, শূন্য। বুদ্ধের দর্শন যে পথে এগোতে এগোতে নাগার্জুনের শূন্যবাদে এসে দাঁড়িয়েছিল। মোটকথা, আমাদের মধ্যে এই মিথ্যাকে নিয়ে একটা সংজ্ঞাগত সমস্যা থাকলেও অস্তিত্বগত সংশয় ঘটেনি। কিন্তু আস্তিক্যবাদের দর্শনগুলো এই মিথ্যার পিছনে ধ্রুব সত্যের কথা জানানোর চেষ্টা করেছেন, যিনি আদতে ব্রহ্ম। কিন্তু বৌদ্ধ, জৈন ও চার্বাক সে পথে হাঁটেনি। তারা তাদের মত করে একটা পথ তৈরি করেছেন। যেমন বৌদ্ধধর্মের প্রধান একটা কথা 'করুণা'। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, এই 'করুণা' কথাটা যদি বৌদ্ধধর্মে না থাকত তবে একটা ‘বিশুদ্ধ আত্মহত্যার’ কথা ছাড়া বৌদ্ধধর্মের আর বিশেষ কিছু বলার থাকত না।
       তবে আবার আগের কথাটা বলি, সত্যকে জানার উপায় মিথ্যাকে 'মিথ্যা' বলে চিহ্নিত করা। এখন কথা হল এখানেও প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের একটা পার্থক্য। প্রাচ্য বলতে শুরু করল, আমি শরীর নই, কারণ শরীরের বাড়-বৃদ্ধি-ক্ষয়-ক্ষতিতে আমার চিত্তের 'আমি' বোধটির কিছুমাত্র হ্রাসবৃদ্ধি হয় না। সেইভাবেই আমার সুখ-দুঃখ আর উৎসাহ-অবসাদ। আমি বলি আমার সুখ-দুঃখ অনুভব হচ্ছে; আমার উৎসাহ-অবসাদ অনুভব হচ্ছে। অর্থাৎ, 'আমার হচ্ছে', কিন্তু তা 'আমি' নই, অর্থাৎ এগুলো মিথ্যা। এইভাবে সে একটা আত্মতত্ত্বের উপর দাঁড়াতে চায়।
       সক্রেটিসের কথা কিন্তু অন্য। তার কথা অনুযায়ী, তোমার জ্ঞান, বিশ্বাস, তথ্য কতটা সত্য বিচার করে দেখো। যার বেশিরভাগটাই মানসিক ও বৌদ্ধিক স্তর নিয়েই, সাথে সামাজিক ও বহির্বিশ্বের কথাও আছে। কিন্তু এই বিচারের মাধ্যমে মিথ্যাকে আর অধ্রুব অনুভবগুলোকে চিহ্নিত করার সাথে সাথে যে একটা চিত্তের স্থিরতা আসে সে কথাটাও যেন সেই সময়ের দর্শনে এসেছিল। যার থেকে স্টোয়িক দর্শনের উৎপত্তি। জেনো, অউরেলিয়াস, সেনেকা যে পথের পথিক, পরে কিছুটা শোপেনহাওয়ার। কিন্তু পাশ্চাত্যের এই দর্শনের সাথে আমাদের আত্মদর্শনের কোনো মিল নেই। কোনো অবিনাশী, ধ্রুব, অমর শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত আত্মার কথা কিন্তু কেউ বলেননি। আর বললেও সেটা ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে বলা, যে বিশ্বাসটারও তেমন কোনো গুরুত্ব নেই যে অর্থে যুক্তি-বিচারের মাধ্যমে নিজের মনুষ্যত্বকে জানার আগ্রহ আছে।
       মনুষ্যত্ব আর আত্মতত্ত্বের প্রধান পার্থক্য হল, একটা ইন্দ্রিয়জগতের মধ্যে আর অপরটা অতীন্দ্রিয় জগতের। পাশ্চাত্য প্রথমটার দিকে ঝুঁকেছিল, প্রাচ্য দ্বিতীয়টা। প্রথমটা দাঁড়িয়ে মানুষের সহজাত উপলব্ধি, শুভবুদ্ধি, মনন ইত্যাদির উপরে। কিন্তু পরেরটা দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ বিশ্বাসের উপরে। সমস্যা হল আজকের এই ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন বৌদ্ধিক ও বিজ্ঞানপ্রাণতার যুগে সেই বিশ্বাস পাই কোথায়? সেই পরম মঙ্গলময় সত্তার উপর ভার দিয়ে বাঁচার দিনই বা কোথায় সিসিটিভি আর সন্ত্রাসবাদের যুগে? সেই পরমমঙ্গলময় সত্তাই আজ সর্বাধিক বিপন্ন যেন। মানুষ আশ্রয় পায় কোথায় তবে আজ? একদিকে এই ভয়ংকর বিধ্বংসী আসুরিক মানবসত্তা, অন্যদিকে মানুষের একসাথে একত্রে সহমর্মিতায় থাকার আকুতি। কিভাবে এই যুযুধান দুই শক্তির লড়াইয়ের পরিণতি আঁকা থাকবে এই মহাবিশ্বের ইতিহাসে একদিন যদি পৃথিবী সত্যি শূন্য হয়ে যায় অস্তিত্বে? সে উপসংহার টানবে কে? মানুষের করুণা, ত্যাগ, পরার্থপরতা? না, হিংস্র, বর্বর, আত্মপরতা? জানি না আমরা। আমরা শুধু একটা পক্ষ নিয়ে দাঁড়াতে পারি কেবল। সেই পক্ষটা যতটা তাড়াতাড়ি নিই ততটা পথ হাঁটতে পারি, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারি। তারপর বোঝা যাবে যে জগতে যে দুটো পথ সত্যের দেখা হয়েছিল – আনন্দে আর বিষাদে – তার মধ্যেa কে ছিল সত্যের কাছে বেশি? পূর্ণ আনন্দময় সত্তা না অন্ধকারময় শূন্যতা।