নৃশংস খুন। প্রতিহিংসা। ভালোবাসা।
যতবার শুনি ততবারই চমকাই। ভাগ্যে ভালোবাসা অদ্দূর গড়ায়নি ভেবে নিশ্চিন্ত হই। চারপাশে ভালো করে মন বুলিয়ে নিই, এমন ধারা ভালোবাসার গন্ধ পাচ্ছি না তো কোনো বন্ধুর জীবনে!
যাকে ভালোবাসবে সে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে না, এ খুব কম জনের ভাগ্যে হয়। তার জন্যে হেদিয়ে মরার কোনো কারণ দেখি না। কাউকে নিজের দুর্বলতার কথা জানানো মানেই তো তার হাজারটা হাঙ্গামা 'অ্যাকসেপ্টেড' অঙ্গীকার করা। সে যেই জেনে গেল তুমি তার উপর দুর্বল, অমনি সে তার সামাজিক ভদ্রতার মুখোশ খুলে এক্কেবারে স্ব-স্বরূপে এসে জীবনে ল্যাণ্ড করবে। ব্যস ঝক্কি সামলাও এবার।
এখন "এ উচিৎ নয়"... "এটা আনফেয়ার"..."তোর এসব থেকে বেরিয়ে আসা উচিৎ ".... এ সব বন্ধু হিসাবে জ্ঞানের কোনো ভ্যাল্যু নেই আর তখন। যে মজে সে সব বোধশোধ হারিয়েই মজে। হাবুডুবু থেকে ভুড়ভুড়ি কেটে মাঝে মাঝে মাথা তোলে। "আমার সঙ্গে এই করেছে, সেই করেছে" বলে হাপুসহুপুস কেঁদেকেটে একশা করে। তুমিও কোমর বেঁধে বোঝাতে গেলে তার ভবিষ্যৎ - টবিষ্যৎ যাচ্ছেতাই টাইপের রিস্ক জোনে ঘুরঘুর করছে ইত্যাদি টিত্যাদি বলে…ও বাব্বা! দুদিন যেতে না যেতেই আবার দেখলে তার টিকির নাগাল পাচ্ছ না। সে আবার ডুব দিয়েছে। "ওরকম ও মাঝে মাঝে একটু করে রে.. এমনিতে মানুষটা ভালো। ভীষণ ভালো।" তুমিও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, লাভ ইজ ব্লাইন্ড-টাইণ্ড ভেবে বাড়ি চলে এলে। "তোরা ভালো থাকলে আমার কি" উদাসীন দার্শনিক টাইপের কথা নিজেকে বলে টলে আবার নিজের জীবনে ফিরে এলে।
এ হতেই থাকে। একটা ব্রেক-আপ হতে না হতেই সিজন টু স্টার্ট। এপিসোডের পর এপিসোড। মাঝে মাঝে গুলিয়েও ফেলতে পারো এক সিজনের এক এপিসোডের সঙ্গে আরেক সিজনের আরেক এপিসোড। ও গুলিয়েও কোনো লাভ নেই। যা হবার হবেই।
এখন এই যে ভালোবাসার মধ্যে একটা গ্র্যাণ্টেড এক্সপ্লয়টেশান, ইমোশান নিয়ে খেলা চলে, এগুলো কি অ্যাভয়েডেবল?
পাতি বাংলায়, না। এগুলো ওয়ান ওয়ে ট্রাফিকের মত। কেন, এর ব্যাখ্যা পাওয়া ভার। সব রিলেশানে এটা হয় না। টক্সিক রিলেশানে হয়।
এখন এই টক্সিক রিলেশানটা কি? রিলেশানটা টক্সিক, মানে টক্সিক। ভালো না। হেজে যাওয়া সম্পর্ক। বাপ-মা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, কেরিয়ার একদিকে। আর সে সম্পর্কের টাগ অব ওয়ার আরেক দিকে। কে জিতবে আর কে হারবে প্রশ্নটাই অবান্তর না একটা সম্পর্কে? সম্পর্ক কি খেলার ময়দান? না জুয়াড়ির টেবিল? কিন্তু টক্সিক সম্পর্কে সারাদিন ইগোর টাগ অব ওয়ার চলেই। হার জিতের প্রশ্ন প্রচ্ছন্নভাবে ডমিনেট করতেই থাকে। এই মন্থনে অমৃত বেরোয় না, বেরোয় বিষ। অল্প ঝাঁঝালো আর বেশি ঝাঁঝালো, এই যা পার্থক্য। আদতে বিষই। কে জিতবে, কে হারবে। এই লড়াই। কে কাকে কতরকম কৌশলে ডমিনেট করবে, ট্র্যাক থেকে সরাবে, ইনফ্লুয়েন্স করবে, কন্ট্রোল করবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ সম্পর্কে সুখ কোথায়? আর সুখ। এখন তো নেশা। কোনো নেশাখোরকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, মশায় আপনার এ উদ্ভট নেশা করে সুখ কোথায়? সে উত্তর দেবে একটা। কিন্তু সে উত্তর সুস্থ স্বাভাবিক মানসিকতায় হজম হবে না। এখানেও তাই। এক লড়াই শুরু হয়ে যায়। ইগোর বিকৃত লড়াই।
কেউ কেউ কার বেশি দোষ, কার কম দোষের বিচারে যায়। সেটা খুবই অপ্রাসঙ্গিক। সম্পর্কে যেমন হারজিতের প্রশ্ন নেই, তেমনই দোষগুণের প্রশ্নও আসে না। দুজন মানুষ, দোষেগুণে ভরা হবে। নিজেদেরকে নিজেরা স্পষ্ট জানবে। মানিয়ে নেবে। এই তো হল কথা। সেই মানানোর মধ্যে টক-ঝাল-মিষ্টি সবই থাকবে, কিন্তু বিকার থাকবে না। ভালোবাসা আসলে যখন ইগোর অনারে ওঠেবসে তখন বিকার জন্মাবেই। আর ভালোবাসা যখন কাণ্ডজ্ঞানের হাত ধরে চলাফেরা করে তখন খাদের ধারে পৌঁছানোর আগেই তাকে সামলে ফেলা চলে।
এই কাণ্ডজ্ঞান আর বিকার দুটো বড় শব্দ সম্পর্কে। কাউকে গ্রাস করে ভালোবাসা যায় না। কাউকে কামড়ে ধরে থেকে ভালবাসা যায় না। কাউকে শুধু শারীরিক আকর্ষণে, অর্থের ঔজ্জ্বল্যে, সামাজিক সুখসুবিধায় বশ করে ভালোবাসা যায় না। ভালোবাসা কোনো আবেগ না। বিচার না। ভালোবাসা একটা পজিটিভ সচল কাণ্ডজ্ঞান। বাধা পেলে রাস্তা খোঁজে। চাপতে গেলে ফোঁস করে ওঠে। দাবাতে গেলে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। দূরে ঠেললে অপেক্ষা করে। কাছে আনলে আশ্রয় হয়ে ওঠে। কিন্তু কোনো মতেই বিকার হয়ে ওঠে না, যদি না একটা অস্বাস্থ্যকর ইগোর বিষবাষ্প শিরায় শিরায় এসে মেশে।
উপায়? নেই। বিকার একটা স্ব-আরোপিত অন্ধত্ব। একমাত্র নিজে চাইলেই এর থেকে বেরিয়ে আসা যায়। শুধু চাওয়াটা আন্তরিক আর ঐকান্তিক হতে হয়। সব চাওয়া আন্তরিক হলেও, ঐকান্তিক হয় না। ঐকান্তিক চাওয়া মানে মরিয়া হয়ে ওঠা। কিন্তু টক্সিক সম্পর্কে ইগো এমনই কর্কটরোগের মত হয়ে ওঠে যে, সে যার সত্তাতে বেড়ে ওঠে তাকে শেষ না করা অবধি শেষ হয় না যে। সে অন্ধ তখন। সে জানে যে করে হোক তার ইগোকে জেতাতেই হবে, তাতে তার সত্য অর্থে মরণ হলেও। মরণ হয়ও। ইগো যতবার জিতে যায় সে যে ততবার নিজের বাকি সুস্থ সম্ভাবনাগুলোকে একটা একটা করে হত্যা করে, সে আর কে বোঝাবে তাকে? অবশেষে সব দরজা বন্ধ হয়। এক ইগোর দরজা খোলা থাকে - মৃত্যুর দিকে। কি আত্ম-লাঞ্ছনাময় সে মৃত্যু!