ফেসবুকে একটা ছবি নিয়ে খুব আলোড়ন হচ্ছে। বিয়ের টোপর মাথায় একজন সম্পূর্ণ নগ্ন নারী। এ দৃশ্য নতুন কিছু না, নানা ফটোগ্রাফির পেজে এরকম চিত্র ভুরিভুরি। বলা যেতে পারে পুরুষের নগ্নচিত্র তোলা হয় না কেন? কারণ অনেকের মতে পুরুষের শরীরে নাকি সেই সৌন্দর্য বিধাতা দেননি, যেই সৌন্দর্যে নারীকে ভরিয়ে তুলেছেন। কোনোদিনই এ যুক্তি আমার খুব একটা সৎ বলে মনে হয়নি, আজও হয় না।
আসল কারণ হল পুরুষের উর্বশী বাসনা। চিরকাল আছে, খুব সুক্ষ্ম বাসনা। ঠিক কামজ বলা যাবে না, আবার কামরহিত বলাও যাবে না। স্থূল কামাবেগ অনেকটা মার্জিত হয়ে বৌদ্ধিক স্তরে একটা শৈল্পিক ব্যঞ্জনা নিয়ে দাঁড়ায়। শিল্প, ললিত কলা, সুক্ষ্ম রসবোধ ইত্যাদি নিয়ে নারী সেখানে একজন খুব উঁচুদরের, উঁচুস্তরের মনোরঞ্জনের বস্তু। এখানে কয়েকটা শব্দে আমি মনযোগ আকর্ষণ করতে চাইছি --- এক, দর আর স্তর - দুটোই উঁচু হতে হবে, মানে সুক্ষ্ম আরকি। দুই, 'বস্তু' হতে হবে, মানে মানবিক সম্পর্কিত না। যেমন সেই বিশ্বসুন্দরীতে বুদ্ধিবৃত্তির মাপও নেওয়া হয় না? খানিক সেরকম। অর্থাৎ আমরা বলতে চাই, ওহে নারী, আমরা তোমার কটিদেশ, স্তনযুগল, উচ্চতা, তীক্ষ্মতা ইত্যাদি বাহ্যিক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর বিচারেই ক্ষান্ত দেব, এমন স্থূল রসজ্ঞ ভেবো না আমাদের, আমরা পুরুষ, আমরা জানি কি করে বস্তুর কদর করতে হয়, আমরা তোমার বোধ-বুদ্ধিরও পরিমাপ করব, হুম, এতই সুক্ষ্ম বিচারশক্তিসম্পন্ন আমরা।
রাজশেখর বসুর 'দ্বান্দ্বিক কবিতা' গল্পটা স্মরণ করাই। স্বামী বড় কবি, তার মানসলোক জুড়ে এক পরমাসুন্দরী যার উদ্দেশ্যে কবিতা লেখেন (আগে সেই স্থানে স্ত্রী ছিলেন, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের স্থূলতায় স্ত্রী সেই স্থান অধিকারের সুক্ষ্মতা হারান)। বন্ধুরা বলে কবিদের কল্পনায় একজন নারী থাকতে হয়, এ নাকি 'একরকম তান্ত্রিক নায়িকাসাধনা'। তো গল্পের ঘটনাপ্রবাহে স্ত্রীও একজন পুরুষকে কল্পনা করে কবিতা লিখতে শুরু করেন, সে কবিতাও খুব জনপ্রিয় হয়ে যায়। গৃহে অশান্তি বাধে। অবশেষে দু'জনেই কবিতা লেখা থেকে নিজেদের নিরস্ত করেন। অর্থাৎ কবিতাতেও সেই এক ধরণের উর্বশী কামনা রয়েই গেছে পুরুষদের, যা মহিলাদের ক্ষেত্রে হলে সামাজিক ন্যায়নীতির ভিত নড়ে যাবে, কারণ সতীত্ব শব্দটা নারীত্বের দায়।
উর্বশী ঘরের লোকও নয়, তথাকথিত বারবনিতাও নয়। উর্বশী স্বতন্ত্র। তার রূপ থাকবে, কাম থাকবে, আকর্ষণ করার ক্ষমতা থাকবে, কিন্তু বাঁধন থাকবে না। তাকে মানুষ হলে চলবে না। তাকে কল্পনা আর কামের মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়াতে হবে যে জায়গাটা ভরিয়ে রাখবে শিল্পের আচ্ছাদন। কেউ নাক সিঁটকালেই বলব, বর্বর, এর মধ্যেও নোংরামি খোঁজে, আরে বাবা আর কবে নিজেদের আধুনিক করবি রে বাপ! বিদেশে এমন মানুষ রাস্তায় হেঁটে গেলেও কেউ তাকায় না। আমাদের কল্পনার সেই 'বিদেশ' আর স্বর্গসুখবাসনার খুব একটা পার্থক্য নেই।
তাই নারী তুমি উলঙ্গ হয়ে দাঁড়াও। ভয় নেই, তাতে আমার পুরুষাঙ্গ উত্তেজিত হবে না, উত্থিত হবে না, আমার মধ্যের শিল্পের তৃষ্ণা দাবানলের মত বেড়ে উঠবে। আমি মুগ্ধ হব। আমি তারিয়ে তারিয়ে তোমায় দৃষ্টিসুখে ভোগ করব। আমি বলব, ব্যাপারটা আসলে ভীষণ নান্দনিক বুঝলেন, এ রস সবার জন্য না। আমার অমনি সেই সুরসভার কথা মনে পড়বে। সেখানেও নানা উর্বশীর গল্প। তারা নৃত্যগীতে পারদর্শী। তারা নানা অঙ্গ-বিভঙ্গ, ছলা-কলায় পারদর্শী। তারা নান্দনিক, কেবল নান্দনিক, শুধুই নান্দনিক।
রবীন্দ্রনাথে উপসংহার টানি -
নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী রূপসী,
হে নন্দনবাসিনী উর্বশী!
গোষ্ঠে যবে সন্ধ্যা নামে শ্রান্ত দেহে স্বর্ণাঞ্চল টানি
তুমি কোনো গৃহপ্রান্তে নাহি জ্বাল সন্ধ্যাদীপখানি,
দ্বিধায় জড়িত পদে কম্প্রবক্ষে নম্রনেত্রপাতে
স্মিতহাস্যে নাহি চল সলজ্জিত বাসরশয্যাতে
স্তব্ধ অর্ধরাতে।
উষার উদয়-সম অনবগুণ্ঠিতা
তুমি অকুণ্ঠিতা।
সুরসভাতলে যবে নৃত্য কর পুলকে উল্লসি
হে বিলোলহিল্লোল উর্বশী,
ছন্দে ছন্দে নাচি উঠে সিন্ধুমাঝে তরঙ্গের দল,
শস্যশীর্ষে শিহরিয়া কাঁপি উঠে ধরার অঞ্চল,
তোমার মদির গন্ধ অন্ধবায়ু বহে চারি ভিতে,
মধুমত্তভৃঙ্গসম মুগ্ধ কবি ফিরে লুব্ধচিতে
উদ্দাম সংগীতে।
নূপুর গুঞ্জরি যাও আকুল-অঞ্চলা
বিদ্যুৎ-চঞ্চলা।