Skip to main content

কোনো মানুষই কি আদতে ত্রুটিমুক্ত হয়? মহৎ মানুষের ত্রুটি কি তার মহত্বের ক্ষুণ্ণতা, নাকি সেটাই বাস্তবতা?

রামকৃষ্ণদেব বলছেন, কাজলের ঘরে থাকলে যতই সেয়ানা হও, কালি লাগবেই।

কাজলের ঘর কি?

মানুষের বোধে দুটো সত্য আছে, এক, ব্যবহারিক সত্য। দুই, চিত্তগত সত্য। নদীর জল, যে মানুষ শুধু ব্যবহারের জিনিস বলে জানে, সে মিথ্যা জানে না, সে অসম্পূর্ণ জানে। পরিবেশবিদ জানেন, নদীর সত্য মূল্য আমার কাপড়কাচা, স্নান, শৌচাদি সত্যের মূল্যে নয়, নদীর মূল্য এ সবের চাইতে অনেক বড়। একটি বাচ্চা একদিন পরিবেশের দুরবস্থার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিল। সে আমাদের প্রয়োজনের বাইরে গিয়ে পরিবেশকে দেখতে পেয়েছিল বলেই। অনুভব করেছিল বলেই।

মানুষের জীবনের গভীরে এই একটি সত্য খুব বড় সত্য। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ছোটো আমি - বড় আমি; রামকৃষ্ণদেবের ভাষায়, কাঁচা আমি - পাকা আমি; প্লেটোর ভাষায়, সাধারণ মানুষ - দার্শনিক; কান্টের ভাষায়, সাধারণ মানুষ - এনলাইটেন্ড মানুষ; উপনিষদের ভাষায়, ক্ষুদ্র সুখ - ভূমা সুখ কিম্বা দুটো পাখির গল্প; শান্তিদেবের বোধিচর্যাবতারের ভাষায়, সাধারণ মানুষ - বোধিসত্ত্ব; বাইবেলের ভাষায়, বাইরের জগৎ - ঈশ্বরের রাজ্য।

এই দুই সত্য নিয়েই মানুষের জীবন। আজকের দিনে যাকে বলছি শিক্ষিত, বোধসম্পন্ন, ম্যাচিওর মানুষ বনাম অশিক্ষিত, কাণ্ডজ্ঞানহীন, স্বার্থপর মানুষ।

রামকৃষ্ণদেব বলছেন, মান আর হুঁশ নিয়ে মানুষ। রামকৃষ্ণদেব শেষ আশীর্বাদ করছেন, চৈতন্য হোক।

এই হল কাজলের ঘরে থেকে কালিকে চেনার শিক্ষা। প্লেটোর দর্শন অনুযায়ী গুহা থেকে বাইরে বেরোবার শিক্ষা। ছায়াকে ত্যাগ করে কায়াকে অন্বেষনের শিক্ষা।

যতদিন যায় মানুষ আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হতে থাকে। ক্রমে মানুষের উপর অবিশ্বাস, হতাশায় গোটা সংসারটা বিষিয়ে ওঠে। এ আজকের দিন বলে না, এ-ই চিরকাল হয়ে এসেছে। কথামৃতে গানের উদাহরণে আছে, সংসার ধোঁকার টাটি, জ্ঞান হলে মজার কুটি।

যে মানুষই দীর্ঘদিন সংসারে মানুষকে নিয়ে আছে তার মানুষের উপর অবিশ্বাস আসবে এ স্বাভাবিক। মনুষ্যত্বকে প্রশ্নের চিহ্নে দেখবে, এও স্বাভাবিক। মহাত্মা বলছেন, মনুষ্যত্ব এক অসীম সমুদ্র। তার ক্ষুদ্র অংশ দূষিত হলেও সমগ্রটা নয়।

কিন্তু এই সমগ্রটাকে দেখব কি করে?

এই সমগ্রটাকে দেখার সাধনাকেই বলে শিক্ষা। জগতকে সত্য দৃষ্টিতে দেখার সাধন যেমন বিজ্ঞান, তেমনই মানুষকে তার স্বমহিমায় সত্য দৃষ্টিতে দেখার সাধনকে বলে দর্শন-ধর্ম।

প্লেটোর ভাষায় সক্রেটিস বলছেন, মানুষের ত্রুটিকে ব্যঙ্গ করে, উপহাস করে রাস্তা দেখানো যায় না। মানুষের প্রতি সহনশীলতা দরকার। স্পিনোজা বলছেন, আমি বুঝেছি, আর সব বোকা - এ অহংকার। এ ঠিক নয়। ঠিক এই একই কথা রামকৃষ্ণদেব বলছেন হাজরাকে, আমি বুঝেছি, আর সব বোকা, এ বুদ্ধি কোরো না। সবাইকে ভালোবাসতে হয়। সবার মধ্যেই তিনি।

রামকৃষ্ণদেবের এই 'তিনি', উপনিষদের ভূমা। মানুষের জীবনে সব চাইতে বড় অলৌকিকত্ব এই - এই দুর্বিষহ জীবনের কেন্দ্রে এক মহত্বের প্রতি তার আকর্ষণ। বাইরের জীবনে যাকে বলা হয় অ্যাডভেঞ্চার। নইলে সেদিন অমন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবকসম্প্রদায় কি কারণে সেই তথাকথিত অশিক্ষিত মানুষটার জীবনব্রত নিজেদের কাঁধে নিয়েছিল? একজন সুপণ্ডিত মানুষের দুর্দান্ত ক্ষুরধার ব্যাখ্যায় শিক্ষিত মানুষ আকর্ষিত হবে, এ বোধগম্য। কিন্তু সে মানুষটার কথায় তা তো ছিল না। তবে কি এমন ছিল যে অতগুলো শিক্ষিত যুবক পার্থিব জগতের সব সুখের সম্ভবনা জলাঞ্জলি দিয়ে অমন নিবেদিত প্রাণ হয়েছিল? সে আকর্ষণ ভূমার আকর্ষণ। মহত্বের আকর্ষণ।

মানুষের জীবনে এই অ্যাডভেঞ্চারের তৃষ্ণা, কঠিনকে জয় করে মহত্বের দিকে এগোনোর তৃষ্ণাকেই বলছি মনুষ্যত্ব। যা অর্জনের বস্তু। অনেক দুঃখ, অনেক ত্যাগ, অনেক কঠিন রাস্তাকে স্বীকার করে নিয়ে। যদি বলো, কেন এত কঠিন রাস্তায় যাব? তবে এর কোনো উত্তর হয় না।

মানুষকে ভালোবাসব, এ কথাটা খুব সোজা কথা না। কবীর যখন বলে, প্রেম, এ শব্দটার মধ্যেই সমস্ত ধর্মের মূল, যে কথাকে এ যুগে দাঁড়িয়ে বিবেকানন্দ বলছেন, জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর.. সে কথা কোনো স্লোগান নয়। সে কথা একটা অনুভব। যে অনুভব সেই মানুষগুলোর জীবনে ছড়িয়েছিটিয়ে মাঝেমধ্যেই ধরা দিয়েছে।

আবারও বলছি, মানুষকে ভালোবাসব, এ কথাটা বড় সোজা কথা নয়। এ কোনো বায়বীয় রোম্যান্টিসিজম নয়। এ কথা সাধনার কথা। চাইলেই পাওয়া যায় না। সারদাদেবী যখন বলছেন, ঈশ্বরলাভ করলে কি মাথায় দুটো শিং গজায়? না। হৃদয়টা মাঠ হয়ে যায়।

বড় কথা আর ছোটো কথার দ্বন্দ্ব চিরকাল আছে। থাকবেও। প্রয়োজনের চেষ্টা আর চিত্তের উদার মুক্ত জ্ঞানের অনুভবের মধ্যে আপাত দ্বন্দ্বও চিরটাকাল থাকবে। "ফোটা ফুল চায় না নিশা, / প্রাণে তার আলোর তৃষা, / কাঁদে সে অন্ধকারে…. যে থাকে থাক্-না দ্বারে, / যে যাবি যা-না পারে"।

রবীন্দ্রনাথ তার গানে এ ডাক প্রতিদিন আমাদের সামনে আনছেন। আমরা কেউ সাড়া দিচ্ছি, কেউ দিচ্ছি না, কেউ 'দেব দেব' ভেবেও দিয়ে উঠতে পারছি না।

মানুষের মধ্যে সঙ্কীর্ণতা আছে, স্বার্থপরতা আছে, শোষণ পীড়ন করার ক্ষমতা আছে, সব আছে। এগুলো বাস্তব। কিন্তু মানুষের মধ্যে এ সবের ঊর্ধ্বে ওঠার ক্ষমতাও আছে। তাই শিক্ষা আছে, চর্চা আছে, সাধন আছে, চেষ্টা আছে, আত্মত্যাগ আছে, দুর্বিষহ দুঃখ স্বীকার করার তাগিদ আছে।

তা বলে কি নকল নেই? আছে। কিন্তু নকল মহতেরই হয়। চোরের নকল কেউ করে না। করে সাধুর। দ্য ভিঞ্চির ছবি, পিকাসোর ছবি নকল বিক্রি হয়। কোনো সামান্য মানের ছবির নকল হয় না। তেমনই মহতের নকল হয়, কিন্তু তার অর্থ মহত্ব নকল নয়। নীৎশের মত নৈরাশ্যবাদী দার্শনিকও এক কল্পিত মহামানবের সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে অহং প্রতিষ্ঠিত। চেতনার মহত্ব সাধ্য নয়। বার্ট্রান্ড রাসেল সেই কথাতেই নীৎসের দর্শনকে সরিয়ে অন্য দর্শনের দিকে এগিয়ে গেছেন।

যে ক'জন মানুষের নাম উল্লেখ করলাম, তারা কি সব ত্রুটিমুক্ত? না। বিবেকানন্দ একটা কথা মনে রাখতে বলেছিলেন, মনে রাখিস, ত্রুটিগুলো সমস্ত মানুষজাতির, কিন্তু তার উৎকর্ষতাটা তার সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়।

যে মানুষদের নাম উল্লেখ করলাম তাঁরা বহু মানুষের কাছে মহাপুরুষভাবে স্মরণীয়। কারণ তাঁরা ত্রুটিহীন ছিলেন বলে নয়, কারণ তাঁদের সেই রক্তমাংসের শরীরের জীবনেই সেই মহত্বের ছায়া পড়েছিল বলে। তাঁরা আয়নার মত। আয়নার গঠন শতাংশে ত্রুটিমুক্ত হয় না, কিন্তু সেখানে যে মহাকাশের প্রতিবিম্ব পড়ে সেখানে আমরা আমাদের মুক্তির রাস্তা পাই। আস্থা পাই। তাই তাঁরা প্রাতঃস্মরণীয় হন। পূজ্য হন। তাঁদের অস্বীকার করলে তাঁদের কোনো ক্ষতি হয় না। আমরা আমাদের ক্ষুদ্র করে ফেলি আরো।

 

অন্ধকারের উৎস-হতে উৎসারিত আলো

    সেই তো তোমার আলো!

সকল দ্বন্দ্ববিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো

    সেই তো তোমার ভালো ॥

পথের ধুলায় বক্ষ পেতে রয়েছে যেই গেহ

    সেই তো তোমার গেহ।

সমরঘাতে অমর করে রুদ্রনিঠুর স্নেহ

    সেই তো তোমার স্নেহ ॥

সব ফুরালে বাকি রহে অদৃশ্য যেই দান

    সেই তো তোমার দান।

মৃত্যু আপন পাত্রে ভরি বহিছে যেই প্রাণ

    সেই তো তোমার প্রাণ।

বিশ্বজনের পায়ের তলে ধূলিময় যে ভূমি

    সেই তো স্বর্গভূমি।

সবায় নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছ তুমি

    সেই তো আমার তুমি ॥