সৌরভ ভট্টাচার্য
30 June 2020
জন্ম থেকেই বলা হল, মাথা নীচু করো। কোথায়? ওই ছবির ফ্রেমের সামনে। ওই পাথরের মূর্তির সামনে। ওই মাটির মূর্তির সামনে। উনি গুরুদেব, ওনার সামনে। উনি বয়োজ্যেষ্ঠ, ওনার সামনে। উনি শিক্ষক, ওনার সামনে।
‘মাথা নীচু’ পর্ব চলছেই। একটা বাচ্চা বুঝতে পারছে না কি তাদের মহত্ব, কেন সে মাথা নীচু করবে? সে শুধু জানে তাকে মাথাটা নীচু করে যেতে হবে, কারণ বড়রা বলছেন। বড়দের কথাটা শুনতেই হয়। সমস্যা হচ্ছে, এই বিনা মহত্বের অনুভবে মাথা নীচু করাটা ক্রমে অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। গাছকে দেখলে মাথা নীচু করে, পাথর দেখলে মাথা নীচু করে, নদী দেখলে মাথা নীচু করে, আগুন দেখলে মাথা নীচু করে, বিশেষ কোনো সাজ দেখলে মাথা নীচু করে, পোশাকের রঙ দেখে মাথা নীচু করে -- এই লিস্টের কোনো শেষ নেই। কিন্তু মোদ্দা কথাটা অনভ্যাসই রয়ে যায় – মহতের কাছে মাথা নীচু করার আনন্দ, তৃপ্তি, স্নিগ্ধতা। সে জানে মাথা নীচু করলেই সে রক্ষা পেয়ে যাবে, মাথা নীচু করলেই তার সব অমঙ্গল চলে যাবে, মাথা নীচু করলেই কোনো অদৃশ্য শক্তির অনির্দিষ্ট কারণে ক্রোধের হাত থেকে সে রেহাই পেয়ে যাবে। মেরুদণ্ড নীচু হওয়ার অভ্যাসটুকু রপ্ত করে ফেলে বটে, কিন্তু নীচু হওয়ার মাধুর্যটুকু থেকে বঞ্চিত রয়ে যায়।
মহৎকে অনুভব করতে পারার শিক্ষা আমাদের ছোটবেলা থেকে দেওয়া হয় না। নানা চাতুরী, নানা প্রতিযোগিতায় জেতার ন্যায্য-অন্যায্য কৌশল নানাভাবে শেখানো হতে থাকে। কোথায় কখন কতটা নীচু হতে পারলে আখেরে লাভ হওয়ার সম্ভাবনা –- তার একটা রাফ হিসাবও হয়ে যায়, কিন্তু আদতে লাভের লাভ কিছু হয়ে ওঠে না।
পাশ্চাত্য দর্শনে অমন ঈশ্বরমগ্ন দার্শনিক স্পিনোজা, যিনি বার্ট্রান্ড রাসেলের মত অজ্ঞেয়বাদী দার্শনিকের ও আইনস্টাইনের মত বিজ্ঞানীর সবচাইতে শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার মানুষ ছিলেন, তিনি কোনোদিন এই নীচু হওয়ার অভ্যাসকে ভালো চোখে দেখেননি। তিনি একে বোধের অপূর্ণতাই বলেছেন। তবে এর উল্টো কথাটাও কোনো প্রাজ্ঞের সিদ্ধান্ত নয়, যে ঔদ্ধত্যই তবে সঠিক; কথাটা তাও নয়। “অতিবাড় বেড়ো না ঝড়ে পড়ে যাবে, অতি নীচু হোয়ো না ছাগলে মুড়ে খাবে”, অনেকটা এই প্রবাদের কাছাকাছি হয় তো।
কিন্তু আমাদের এই বিনা মহতের কাছে নীচু হওয়ার তবে প্রেরণাটা কি? ক্ষমতার অন্ধ অতিবোধ। মানে ক্ষমতাকে নীতিহীন বিশ্বাস করা। কেন? যুগান্তরের অন্ধকারের ভয়। অন্যায্য ভয়। অযৌক্তিক ভয়। ভয় যত অমূলক, নীতিহীন ক্ষমতার প্রতি মোহও তত প্রবল। আমার তখন প্রায় সব কিছুকেই প্রবল অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাশালী বলে মনে হয়। এক নিজের প্রতি বিশ্বাস ছাড়া। নিজের যুক্তি-বুদ্ধি-সাধারণ জ্ঞান সমস্তকে আচ্ছন্ন করে বসে আছে নীচু হয়ে থাকার অভ্যাস। এ নম্রতা না, এ বিকার। সাংঘাতিক বিকার। যুগান্তরের বিকার। এর অন্যথা হলেই তা ঔদ্ধত্য। যেমন অত্যন্ত দুর্বল ব্যক্তির পক্ষে যে মানুষ সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলায় ওঠে তাকেই তার তেনজিং নোরগের মত বোধ হয়, এও তেমন। অকারণে মাথা নীচু করার অভ্যাস তৈরি হয়নি এমন মানুষ এরকম ভীরু সমাজের কাছে অবশ্যই দাম্ভিক, উদ্ধত বলে গণ্য হবে এতে আর আশ্চর্য কি আছে? আর এই বিকার সমাজের এমন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকেছে যে যদি কোনো চিকিৎসক, কোনো শিক্ষক, কোনো উকিল তার যথার্থ প্রাপ্যটুকু নিয়ে, যোগ্য কাজটি সুচারুরূপে করার জন্য তৎপর হন, তবে তিনি ঈশ্বর হয়ে ওঠেন সাধারণের চোখে। কারণ সাধারণ মানুষ জেনে গেছে যে সে অকারণে নিজেকে নীচু না করলে তার ন্যায্য প্রাপ্তিটুকুও পাবে না। এ বিশ্বাস, এ অভ্যাস, এ অসুস্থতা। তবু এটাই স্বাভাবিক হয়ে আছে। তাই ঈশ্বর বলে পায়ে পড়তেও বাধে না, তাকে শয়তান বলে শারীরিক নিগ্রহ করতে কিম্বা কুৎসা রটাতেও বাধে না – দুটোই একই অসুস্থ মানসিকতার দুটো দিক।
তবে কি শ্রদ্ধা-বিশ্বাস থাকবে না? অবশ্যই থাকবে। কিন্তু তা যথার্থ মহতের দিকে আপনি স্বতঃ উৎসারিত হোক। বিনা মতলবে। মহৎকে চেনা কঠিন, আমি অনেকের মুখে শুনেছি। কথাটা পুরো সত্য নয়। আংশিক সত্য। যার সুরের বোধ নেই, বা সুরের রসিক যে নয়, সে পণ্ডিত রবিশঙ্করের মাহাত্ম্য অনুভব করবে না। যে দর্শনের প্রতি আগ্রহ রাখে না, সে কান্ট কিম্বা স্পিনোজার মাহাত্ম্য বুঝবে না। সেইটাই স্বাভাবিক। তাই সে সম্পর্কে উদাসীন থাকবে, এও কাম্য। কিন্তু যে যে বিষয়ে আগ্রহী সে সেই বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ মানুষের পরিচয় পাবেই পাবে। একজন মানুষকে সব ক্ষেত্রে সব মহাজনদের যথার্থ পরিচয় পেতেই হবে এমন বালাই কেউ দেয়নি। কিন্তু তা বলে শুধুমাত্র জোর করে গুণীকে গুণী না জেনেই, মহৎকে মহৎ না বুঝেই যদি সে বলে, এই তো আমি মাথা নীচু করে নিলাম, এইবার আমায় ছুটি দাও, পুরষ্কার দাও -– সে আখেরে এসে তীরে তরী ডুবিয়েই ছাড়ে। সমস্তটাই যে ফাঁকিতে ভরে গিয়েছে তার।
কবীর একটা দোঁহায় লিখেছিলেন, তোমরা পাথরের কাছে মাথা নীচু করে করে পাথর হয়ে গেছ। কথাটার মর্মার্থে একটা খোঁচ আছে। আমাদের ঈশ্বর একদিন ছিলেন সত্য, চেতনা ও আনন্দস্বরূপ। সমস্ত সৃষ্টির কেন্দ্র, তথা এ বিশ্বের কেন্দ্র তিনি। এ খুব একটা বড় কথা ছিল। ধীরে ধীরে মানুষ হল তার প্রতিভূ। অবতার হল, গুরু হল। অর্থাৎ অসীম, নৈর্ব্যক্তিক সত্তা হল সসীম, ব্যক্তি। দল হল। নানা কপট অবতার, গুরু, সিদ্ধপুরুষের ভিড় শুরু হল। যারা সত্যিকারের উদার তারা এই দাবীকে অস্বীকার করলেন। বললেন, এই কথা পুরো খাঁটি না, সমুদ্রের ঢেউ হয়, ঢেউয়ের কোনো সমুদ্র হয় না। তারা বললেন, গুরু একমাত্র সচ্চিদানন্দ। আবার অনেকে এদিকের কথা ওদিকের কথা মিলিয়ে একটা রফা করতে চাইলেন। এই ইন্দ্রিয় নশ্বর জগত আর সেই অতীন্দ্রিয় অবিনশ্বর জগতের মধ্যে রফা হল। দল হল। ব্যবসা জমল। ক্রমে গড মাফিয়াদের জন্ম হল। মানুষ তত্ত্ব ছেড়ে ব্যক্তি নিয়ে মজে গেল। ফাঁকি যত নির্লজ্জতার সীমা পেরোতে লাগল তার গোঁড়ামি আর নির্বোধ আচরণ তত দল বেঁধে গোষ্ঠীবেষ্টিত হয়ে দানা বাঁধতে শুরু করল। ভালোবাসা, চেতনা, জ্ঞান, সহনশীলতা – তার অসীমত্বের সংজ্ঞা হারিয়ে ব্যক্তি আর দলের সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হতে লাগল। মানুষ নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে মুক্তি মুক্তি খেলতে লাগল। এক খামখেয়ালী, পক্ষপাতদুষ্ট, দাদাগিরি স্বভাবযুক্ত ব্যক্তিরূপ ঈশ্বরের আবির্ভাব হল। “আমি চোখ বুজে পথ পাইনে বলে কেঁদে ভাসাই পাড়া” -- এই হল গিয়ে অবস্থা।
এর মধ্যে কেউ কেউ সাবধান করে গেল। কেউ কেউ চীৎকার করে বলে গেল, বারবার বলে গেল, যে মিথ্যার রাস্তায় মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের মাথা ততদিনে নীচু হতে হতে এমন নীচু হয়ে গেছে যে উদার আকাশ, উদার আলো আমাদের কাছে কপট বলে বিশ্বাস হতে শুরু করেছে। আমরা ‘সিনিক’ হয়ে পড়লাম, যেখানে আমাদের ‘স্কেপটিক’ হলে আশার আলো ছিল। একদিন যদি কেউ থেমে ভাবত যে কেন আমি নকুলদানা নিয়ে অসীমের সামনে দাঁড়াব? কেন আমি যাকে তাকে আমার গুরু মেনে তার পায়ে মাথা খুঁড়ে মরব? যে আমায় চেনে না, যে একটা দলের দলপতির বেশি কিছু না তাকে কেন আমি আমার সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার অর্ঘ্যটি দেব? যা চিরকালের চেতনা সেকি ইতিহাসের কোনো একটা কালে, কোনো এক মহান ব্যক্তির জীবনে আবিষ্কৃত হয়ে লুপ্ত হয়ে গেছে? সেকি আজ নেই? উপনিষদ যখন বলে, ‘সে আজও আছে, কালও থাকবে,’ কার কথা বলে? আমার হৃদয়ের দিকে যে ইঙ্গিত করে, সে কার দিকে? সেকি কোনো অতীতকালের কোনো এক মানুষের জীবনের দিকে ইঙ্গিত করে নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলেছে? বাকি সত্য বলতে যা বোঝায় তা হল তার ছবি আর পাথরের মূর্তি? বা অতীতের ভাবালাপ? আজকের জন্য কিচ্ছু সত্য নেই? মাধ্যাকর্ষণ সূত্রটি যদি শুধুমাত্র নিউটনের মুখের দিকে তাকিয়ে আজ বেঁচে থাকত, তবে বিজ্ঞানও আজ জমে যাওয়া মজা পুকুরের মত দলে পরিণত হত, শ্রেণী হত না। বিদ্যালয়ে শ্রেণীর ভাগ আছে, দলের ভাগ নেই। শ্রেণী ক্রমবিবর্তমান, দল ক্রমবর্ধমান হতে পারে, কিম্বা ক্ষীয়মাণ, কিন্তু বিবর্তমান নয়।
আমরা কোনোদিন হয়তো মানতে চাইব না অজ্ঞতার সুখের চাইতে, মূর্খের নিরাপত্তার চাইতে সত্যের মুখোমুখি হয়ে নিজের দায়ভার নিজে নেওয়াতেই মঙ্গল। সত্যের উপর চোখ রাখতে গেলে সত্যদৃষ্টি থাকতে হয়। তখন মেরুদণ্ডের ক্ষণে ক্ষণে যেখানে সেখানে নীচু হওয়ার অভ্যাসটি ত্যাগ হয়, নম্রতায় ঈর্ষা আর বিকারের চাষ না হয়ে মাধুর্যের বোধ হয়, কারণ নম্রতা মানে তখন সত্যের সীমারেখার উপলব্ধি। কল্পনার পাগলা ঘোড়া না।