সৌরভ ভট্টাচার্য
18 March 2019
ধর্ম অনুভবের বিষয়। সেই আদিকাল থেকে নানা অনুভবী মানুষ এসেওছেন ধর্মের জগতে, অনুভবে তাঁদের তারতম্য থাকলেও কেউ তেমন ধারার হিংস্র নন। ঈশ্বর বোধে, আত্মা বোধে তাঁদের অনুভব আলাদা। কারোর কাছে কালী, কারোর কাছে কৃষ্ণ, কারোর কাছে স্বর্গস্থ পিতা ইত্যাদি। ভারতীয় দর্শনে আত্মা অনেকটা অংশ জুড়ে থাকলেও, বুদ্ধের অনুভবে আবার আত্মা বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই। এঁদের প্রত্যেকের অনুভবের কাছে এনারা প্রত্যেকে খাঁটি থেকেছেন। আবার নীৎজে, রাসেল ইত্যাদি নাস্তিক মানুষেরাও তাঁদের অনুভবের বোধের কাছে নিজেরা খাঁটি থেকেছেন।
সত্যটি তবে কি? আসলে 'ফ্যাক্ট' যে অর্থে সত্য, 'সত্য' সে অর্থে সত্য নয়। নীতিগত সত্যে মানুষে মানুষে ভেদ আছে। মিল আছে শুধু বস্তুগত সত্যে। আজ আঠারোই মার্চ, দু'হাজার উনিশ, এই কথাটা পৃথিবীর একটা বড় গোলার্ধের মানুষ স্বীকার করে নেবেন। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়জ স্তরে আমাদের তেমন ভেদ নেই। কিন্তু যেই সেটা চিন্তার জগতে, নীতির জগতে এলো অমনি এক এক জনের অনুভূত সত্যের মধ্যে ফারাক তৈরি হল।
গোলমাল এতেও হয় না। গোলমাল হয় যখন অনেকজন মানুষ মিলে কোন একটা অননুভূত সত্যকে স্থির ধ্রুব জেনে মানতে শুরু করেন। অর্থাৎ সত্য তখন অনুভবের না হয়ে মানার বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। এই হল গোল। মানুষ যাকে অনুভব করে তা নিয়ে তার কোনো সমস্যা হয় না, কারণ তাকে সে এত ভিতরে পায় যে কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বললেও সে তার বিরোধিতাকে হয় মূঢ়তা নয় তার বোধের বাইরে কিছু একটা মেনে নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে। সমস্যা হয় তার মানার বিরুদ্ধে কথা বললে। যাকে সে মানে তাকে অনুভব করতে পারে না বলেই মানে। মানুষে মানুষে যা কিছু বিরোধের মূল এই মানা। আর সব মানার মূল কোনো ভয়, যে ভয় তার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতার বাইরে।
এখন গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে চলতে গেলে কিছু কিছু জিনিস তাকে মেনেই নিতে হয়, কারণ মেনে না চললে সে আলাদা, সে পৃথক। সেই আলাদা হয়ে বাঁচার সাহস বেশিদিন মানুষের থাকে না। তার একটা গোষ্ঠী আশ্রয় দরকার হয়। এই গোষ্ঠী আশ্রয়ের চাহিদা তার সেই সভ্যতার সূচনা থেকে। দল বাঁধার তাগিদ। দল ছাড়া মানুষ বাঁচে না। যদি মানার গোষ্ঠী দল বেঁধে বাঁচে, তবে না-মানার মানুষেরও দল তৈরি হয়। আবার না মানা আর মানার মধ্যে সংঘর্ষ। কোথাও সম্মুখ সমর, কোথাও ঠাণ্ডা লড়াই।
সত্যটি তবে কি? আসলে 'ফ্যাক্ট' যে অর্থে সত্য, 'সত্য' সে অর্থে সত্য নয়। নীতিগত সত্যে মানুষে মানুষে ভেদ আছে। মিল আছে শুধু বস্তুগত সত্যে। আজ আঠারোই মার্চ, দু'হাজার উনিশ, এই কথাটা পৃথিবীর একটা বড় গোলার্ধের মানুষ স্বীকার করে নেবেন। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়জ স্তরে আমাদের তেমন ভেদ নেই। কিন্তু যেই সেটা চিন্তার জগতে, নীতির জগতে এলো অমনি এক এক জনের অনুভূত সত্যের মধ্যে ফারাক তৈরি হল।
গোলমাল এতেও হয় না। গোলমাল হয় যখন অনেকজন মানুষ মিলে কোন একটা অননুভূত সত্যকে স্থির ধ্রুব জেনে মানতে শুরু করেন। অর্থাৎ সত্য তখন অনুভবের না হয়ে মানার বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। এই হল গোল। মানুষ যাকে অনুভব করে তা নিয়ে তার কোনো সমস্যা হয় না, কারণ তাকে সে এত ভিতরে পায় যে কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বললেও সে তার বিরোধিতাকে হয় মূঢ়তা নয় তার বোধের বাইরে কিছু একটা মেনে নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে। সমস্যা হয় তার মানার বিরুদ্ধে কথা বললে। যাকে সে মানে তাকে অনুভব করতে পারে না বলেই মানে। মানুষে মানুষে যা কিছু বিরোধের মূল এই মানা। আর সব মানার মূল কোনো ভয়, যে ভয় তার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতার বাইরে।
এখন গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে চলতে গেলে কিছু কিছু জিনিস তাকে মেনেই নিতে হয়, কারণ মেনে না চললে সে আলাদা, সে পৃথক। সেই আলাদা হয়ে বাঁচার সাহস বেশিদিন মানুষের থাকে না। তার একটা গোষ্ঠী আশ্রয় দরকার হয়। এই গোষ্ঠী আশ্রয়ের চাহিদা তার সেই সভ্যতার সূচনা থেকে। দল বাঁধার তাগিদ। দল ছাড়া মানুষ বাঁচে না। যদি মানার গোষ্ঠী দল বেঁধে বাঁচে, তবে না-মানার মানুষেরও দল তৈরি হয়। আবার না মানা আর মানার মধ্যে সংঘর্ষ। কোথাও সম্মুখ সমর, কোথাও ঠাণ্ডা লড়াই।
তবে চিন্তার মূলে এসে একটা কথাই দাঁড়ালো। আমার কথা হচ্ছে যে, এই যে সত্য সত্য করে দুনিয়া কাবার হয়ে গেল, সেই সত্য কি তবে মানুষের বোধনির্ভর অবশেষে? সত্য বলে যা কিছু তা সবই আমার বোধের উপর? সেই 'আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ'? বেশ, তবে সেই বোধ কি? সেও কি একান্ত নির্ভরযোগ্য?
এইখানে খুব গোলমাল। বোধশক্তি এক একজনের এক এক রকম। মানুষ নিজের বোধের তুল্য আরেকটা মানুষের দেখা না পেলে পাগলাতে শুরু করে। সে ভাবে আমি কি তবে এতটাই ভুল? হ্যাঁ, এইটাই ভাবে। কারণ সত্যের আরেকটা শব্দ – ঠিক। আমি কি ঠিক অনুভব করছি? আমি কি ঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছি? আমি কি ঠিকটাই ভাবছি?
সে তার নিজের ঠিকের সাথে অন্যের ঠিক মেলাতে যায়। মেলে কিছুটা, আবার মেলেও না অনেকটা। মানুষ কপটও তো হয়। সে তার অনুভবের ঠিকের বাইরে কোনো গূঢ় মতলবে অভিনয় করেও তো কাজ হাসিল করার পন্থা জানে। সেই নিয়েও আরেক সমস্যা। তাই এই অনুভবের ঠিক আর লোকের মানার ঠিকের গোলমালে সেই মানুষটার জেরবার অবস্থা যে অভিনয় করতে চাইছে না। যে নাম লেখাতে চাইছে না কোনো দলেই। সে কি করে তখন? সে একা হয়। সে খ্যাপা হয়। সে আলোচনার বস্তু হয়। নিন্দা আর স্তুতি দুই-ই তার ভাগ্যে জুটবে কিন্তু অন্তরের আরাম সে পায় কই? কারণ তার বোধের সত্যকে সে কারোর সাথে মিলিয়ে নিতে পারছে না। কেউ কেউ হয়ত মানতে চাইছে, বুঝতে চাইছে না।
তবু এটাই রাস্তা। কেউ কারোর হয়ে বোধ করে দিতে পারে না। কেউ কারোর হয়ে এক পা-ও হেঁটে দিতে পারে না। কেউ কারোর হয়ে একটা প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজে দিতে পারে না। এই ভীষণ লড়াইয়ে সে একা। তার ত্রাণ নেই। একটা মাত্র ফাঁকির পথ ছিল অন্যের জুতোতে পা গলানো, কিন্তু সে তো গলাতে চাইছে না।
আসলে তার বাইরের সমস্যার চাইতে ভেতরের সমস্যা প্রাণান্তকর। সে বুঝছে না তার বোধশক্তি নিজেও কতটা ত্রুটিমুক্ত। কতটা সে সত্যের কাছাকাছি আসতে ব্যগ্র? কতটা সে আত্মনির্ভরশীল। কতটা সে আত্মমোহে আচ্ছন্ন? কে উত্তর দেবে? কোন বই তাকে এর সমাধান দেবে? কেউ না। তাকে নিজেকেই খুঁজতে হবে। একাই খুঁজতে হবে। বারবার ভুল হবে। সাথে একজনই সাথি --- তার ধৈর্য। তার একান্ত সত্যানুগত্য। আর কি? আর কিচ্ছু না... সেই তার প্রেম, সেই তার জীবন, 'মরণেরে করে চিরজীবননির্ভর / এরা পরকে আপন করে আপনারে পর...'
এইখানে খুব গোলমাল। বোধশক্তি এক একজনের এক এক রকম। মানুষ নিজের বোধের তুল্য আরেকটা মানুষের দেখা না পেলে পাগলাতে শুরু করে। সে ভাবে আমি কি তবে এতটাই ভুল? হ্যাঁ, এইটাই ভাবে। কারণ সত্যের আরেকটা শব্দ – ঠিক। আমি কি ঠিক অনুভব করছি? আমি কি ঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছি? আমি কি ঠিকটাই ভাবছি?
সে তার নিজের ঠিকের সাথে অন্যের ঠিক মেলাতে যায়। মেলে কিছুটা, আবার মেলেও না অনেকটা। মানুষ কপটও তো হয়। সে তার অনুভবের ঠিকের বাইরে কোনো গূঢ় মতলবে অভিনয় করেও তো কাজ হাসিল করার পন্থা জানে। সেই নিয়েও আরেক সমস্যা। তাই এই অনুভবের ঠিক আর লোকের মানার ঠিকের গোলমালে সেই মানুষটার জেরবার অবস্থা যে অভিনয় করতে চাইছে না। যে নাম লেখাতে চাইছে না কোনো দলেই। সে কি করে তখন? সে একা হয়। সে খ্যাপা হয়। সে আলোচনার বস্তু হয়। নিন্দা আর স্তুতি দুই-ই তার ভাগ্যে জুটবে কিন্তু অন্তরের আরাম সে পায় কই? কারণ তার বোধের সত্যকে সে কারোর সাথে মিলিয়ে নিতে পারছে না। কেউ কেউ হয়ত মানতে চাইছে, বুঝতে চাইছে না।
তবু এটাই রাস্তা। কেউ কারোর হয়ে বোধ করে দিতে পারে না। কেউ কারোর হয়ে এক পা-ও হেঁটে দিতে পারে না। কেউ কারোর হয়ে একটা প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজে দিতে পারে না। এই ভীষণ লড়াইয়ে সে একা। তার ত্রাণ নেই। একটা মাত্র ফাঁকির পথ ছিল অন্যের জুতোতে পা গলানো, কিন্তু সে তো গলাতে চাইছে না।
আসলে তার বাইরের সমস্যার চাইতে ভেতরের সমস্যা প্রাণান্তকর। সে বুঝছে না তার বোধশক্তি নিজেও কতটা ত্রুটিমুক্ত। কতটা সে সত্যের কাছাকাছি আসতে ব্যগ্র? কতটা সে আত্মনির্ভরশীল। কতটা সে আত্মমোহে আচ্ছন্ন? কে উত্তর দেবে? কোন বই তাকে এর সমাধান দেবে? কেউ না। তাকে নিজেকেই খুঁজতে হবে। একাই খুঁজতে হবে। বারবার ভুল হবে। সাথে একজনই সাথি --- তার ধৈর্য। তার একান্ত সত্যানুগত্য। আর কি? আর কিচ্ছু না... সেই তার প্রেম, সেই তার জীবন, 'মরণেরে করে চিরজীবননির্ভর / এরা পরকে আপন করে আপনারে পর...'
কে আপন কে পর?...